ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনে অংশ গ্রহণে ॥ আমলারা চান দ্রুত সুযোগ, কঠোর বিধি চায় ইসি

প্রকাশিত: ০৫:৪৩, ২৭ জুলাই ২০১৭

নির্বাচনে অংশ গ্রহণে ॥ আমলারা চান দ্রুত সুযোগ, কঠোর বিধি চায় ইসি

শাহীন রহমান ॥ সরকারী চাকরি থেকে অবসরের পরই নির্বাচনে অংশ নেয়ার সুযোগ দিতে সরকারী আমলারা চান আইন সংস্কারের। অপরদিকে সরকারী কর্মকর্তারা যাতে অবসরের পরই প্রার্থী হতে না পারেন সে জন্য ইসি কর্মকর্তারা আরও বেশি বিধিনিষেধের বেড়াজালে আটকাতে চান তাদের। আইন অনুযায়ী সরকারী চাকরি থেকে অবসরের তিন বছর অতিবাহিত না হলে কেউ নির্বাচনের সুযোগ পাবেন না। সম্প্রতি সরকারী কিছু কর্মকর্তা এই আইনী বিধিনিষেধ তুলে দেয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। অপরদিকে ইসির মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা আইন সংস্কারের জন্য যে সুপারিশ পাঠিয়েছেন সেখানে সরকারী কর্মকর্তাদের ভোটে আসতে তিন বছরের বিধিনিষেধের পরিবর্তে পাঁচ বছর করার আহ্বান জানিয়েছেন। তাদের অভিমত, এতে সরকারী আমলাদের রাজনৈতিক অভিলাষ থেকে মুক্ত রাখা যাবে। একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে একটি রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়েছে। রোডম্যাপে ইসির অন্যান্য কার্যক্রমের পাশাপাশি আইন কাঠামো পর্যালোচনা এবং সংস্কারের কথাও বলা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে নির্বাচন পরিচালনার জন্য নির্বাচন কমিশন ধাপে ধাপে আইন কাঠামো তৈরি করেছে। পরিবেশ-পরিস্থিতি পরিবর্তনের মুখে বর্তমান আইন ও বিধিমালার কোন কোন ক্ষেত্রে সংশোধনী আনার মাধ্যমে তা আরও কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। ইসি কর্মকর্তারা জানান, ভোট প্রক্রিয়া আরও অর্থবহ করতে এবং সহজতর হয় এমন উদ্যোগ নিতে মূল আইনী কাঠামোর আওতায় ক্ষেত্রেবিশেষে কতিপয় প্রয়োজনীয় ধারা প্রবর্তন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এজন্য তারা বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণের পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সুপারিশ গ্রহণ করছে। ইতোমধ্যে মাঠ পর্যায়ে কর্মকর্তারা যেসব আইনী সংস্কারের প্রস্তাব করেছেন তা ইসির পক্ষ থেকে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। মাঠ পর্যায়ের পাঠানো সুপারিশে একাধিক আইন সংস্কারের পাশাপাশি তারা ‘সরকারী কর্মকর্তাদের অবসরের পর ৫ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না’ বিধান যুক্ত করার সুপারিশ করেছেন। বর্তমান আইন অনুযায়ী সরকারী কর্মকর্তাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে অবসরের পর তিন বছরের বিধিনিষেধ রয়েছে। এছাড়াও রিটার্নিং এবং সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পেতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে সংস্কারের প্রস্তাব করা হয়েছে। সশস্ত্র বাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় আনা, রিটার্নিং অফিসারকে প্রার্থিতা বাতিল এবং আচরণবিধি লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে বিচারিক হাকিমদের মতো ক্ষমতা দেয়া, প্রার্থীদের জামানতের টাকা বাড়ানো, কোন প্রার্থী নিজেকে ‘স্বশিক্ষিত’ বলে দাবি করলেও সেজন্য সনদ নেয়ার বিধান চালু এবং রাজনৈতিক দলগুলোকে তদারকিতে আনতে নির্বাচনী আইন সংস্কারের সুপারিশও করেছেন ইসি কর্মকর্তারা। ইসির আইন সংস্কার সংক্রান্ত কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম। এ বিষয়ে মাঠ কর্মকর্তাদের ভাষ্য জানতে সংলাপের আগে ১০ আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও জ্যেষ্ঠ জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কাছ থেকে আইন সংস্কারের জন্য মতামত সংগ্রহ করে কমিটি। নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম বলেন, মাঠ পর্যায়ের মতামত নিয়েছি। এখন সেগুলো রাজনৈতিক দলসহ অংশীজনের সংলাপে তুলে ধরা হবে। আলোচনার ভিত্তিতে আইন কাঠামো সংস্কারের খসড় চূড়ান্ত করা হবে। পরে আইন সংশোধনের জন্য প্রস্তাব দেয়া হবে। ইসি কর্মকর্তারা বলেন, বর্তমান আইনে সরকারী চাকরি থেকে অবসর ও অপসারণের পর তিন বছর অতিবাহিত না হলে কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন না। কিন্তু সরকারের কোন পদ থেকে পদত্যাগ করলে তার ক্ষেত্রে তিন বছরের বাধ্যবাধকতা থাকবে কিনা, সেটা স্পষ্ট নয়। এক্ষেত্রে আইনের স্পষ্টীকরণের জন্য আইন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তার অনেকে আইনের এই ধারায় ‘পদত্যাগ’ শব্দটিও যুক্ত করার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে সরকারী কর্মকর্তাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে ৫ বছরের বিধিনিষেধ আরোপ করার সুপারিশ করেছেন। তাদের যুক্তি হলো, এটা করা হলে নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক সরকারের অধীনে চাকরিরত আমলাদের রাজনৈতিক অভিলাষ থেকে মুক্ত রাখা যাবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ১২ অনুচ্ছেদে (উপধারা এফ ও এইচ) বলা হয়েছে, সরকারী চাকরি থেকে অবসর বা অপসারণের তিন বছর পার না হলে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া যাবে না। সশস্ত্র বাহিনী বা সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান ও সরকারী চাকরিতে চুক্তিভিত্তিক চাকুরের ক্ষেত্রেও একই বিধান প্রযোজ্য। ইতোমধ্যে সরকারী আমলাদের অনেকে নির্বাচন কমিশনে গিয়ে এই ধারা বাতিলের জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ইসির পক্ষ থেকে অবশ্য তাদের জানানো হয়েছে আলোচনার ভিত্তিতে আইন সংস্কারের সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন বিগত নির্বাচন কমিশন আমলাদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি রোধ করতে অবসরের তিন বছর পার না হলে নির্বাচন করতে পারবে না মর্মে একটি ধারা আরপিওতে যোগ করেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের নেতাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলে অন্তত তিন বছর সদস্য থাকার বাধ্যবাধকতা আরোপ করেন। কিন্তু রকিব উদ্দিন কমিশনের সময় রাজনৈতিক নেতাদের দলের সদস্যপদ থাকার তিন বছরের বাধ্যতামূলক বিধান বাতিল করা হয়েছে। তবে ‘সরকারী কর্মকর্তাদের অবসরের তিন বছর পার না হলে নির্বাচন করতে পারবেন না’ বিধানটি বহাল রাখা হয় তখন। বর্তমানে এই ধারায় সংশোধনী আনার জন্য কতিপয় আমলার পক্ষ থেকে আহ্বান জানানো হয়েছে। জানা গেছে, ইসির রোডম্যাপ ঘোষণার আগে আইন সংস্কারসহ যেসব উদ্যোগ নেয়া হয় সেখানে আমলারা পরামর্শ দিয়েছেন যে আইন সংস্কার করে আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার পথটা যেন সহজ করা হয়। তারা চান আইন সংস্কার করে সরকারী কর্মকর্তাদের অবসরের ‘তিন বছর পার না হলে নির্বাচন করতে পারবেন না’ এই ধারা আরপিও থেকে তুলে দেয়া হোক; যাতে অবসরের পরই নির্বাচনে অংশ নিতে কোন বাধা না থাকে। রোডম্যাপ ঘোষণার আগেই সাবেক কয়েক আমলা আইন সংস্কার করে তাদের নির্বাচনের বাধা হয়ে দাঁড়ানোর বিধানটি বিলোপ করার প্রস্তাব দেন। তবে বিশেষজ্ঞরা তখন আমলাদের এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেন, আমলাদের প্রস্তাব মেনে তাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার পথ সহজ করতে প্রার্থিতার শর্ত শিথিল করা কোনভাবেই সমীচীন হবে না। তিন বছরের ওই বাধা না থাকলে অনেকেই চাকরিতে থাকা অবস্থায় নিজের এলাকায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে ক্ষেত্র তৈরির চেষ্টা করতে পারেন। বিধানটি তুলে দিলে প্রশাসনে দলীয় প্রভাব আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে উল্লেখ করেন। এর মধেই ইসির মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তরাও তাদের সুপারিশে সরকারী আমলারা যাতে অবসরের পরই নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন সে জন্য তাদের অবসরের পর তিন বছরের পরিবর্তে ৫ বছরের বিধিনিষেধ আরোপের পক্ষে মত দিয়েছেন। তবে ইসি কর্মকর্তারা জানান, একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আগামী ৩১ জুলাই থেকে সুশীল সমাজের সঙ্গে সংলাপ শুরু হবে ইসির। ইতোমধ্যে ৬০ বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সংলাপে অংশ নেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এছাড়া পর্যায়ক্রমে গণমাধ্যম, রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে সংলাপের বিষয় রোডম্যাপে চূড়ান্ত করা হয়েছে। এই সংলাপে যেসব মতামত আসবে তার ভিত্তিতেই আইন সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হবে। এ বিষয়ে এখনই কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
×