ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাদুঘরের ছাদ চুইয়ে পানি ॥ মুক্তিযুদ্ধ ও জয়নুল গ্যালারি ক্ষতিগ্রস্ত

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২৭ জুলাই ২০১৭

জাদুঘরের ছাদ চুইয়ে পানি ॥ মুক্তিযুদ্ধ ও জয়নুল গ্যালারি ক্ষতিগ্রস্ত

মোরসালিন মিজান ॥ জাদুঘরের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের গ্যালারিতে ঢুকে গেছে বৃষ্টির পানি। গত কয়েকদিনের টানা বর্ষণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একাধিক গ্যালারি। অত্যন্ত সুরক্ষিত গ্যালারির কোনটিতে টপটপ করে বৃষ্টি পড়ছে। কোনটির দেয়াল চুইয়ে নামছে জল। ছাদে জমা হওয়া পানি দ্রুত নির্গমনের সুযোগ না পেয়ে ভেতরে প্রবেশ করেছে। এর ফলে বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জাতীয় জাদুঘর ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলা। মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারির একাংশ বৃষ্টিতে মোটামুটি ধুয়ে গেছে। রক্ষা পায়নি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের মহামূল্যবান শিল্পকর্ম দিয়ে সাজানো গ্যালারি। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটসহ অন্যান্য ক্ষতির আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় আজ বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক বন্ধের দিন জাদুঘরের সকল কর্মকর্তা কর্মচারীকে অফিস করার নির্দেশ দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর দেশের সবচেয়ে বড় জাদুঘর ও সংগ্রহশালা। এখানে বিভিন্ন গ্যালারিতে ঐতিহাসিক, প্রতœতাত্ত্বিক, নৃ-তাত্ত্বিক, শিল্পকলা ও প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কিত অসংখ্য নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে। জায়গার অভাবে স্টোরে সংরক্ষিত হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অবজেক্ট। এ অবস্থায় একাধিক গ্যালারিতে পানি ঢুকে যাওয়ায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। পানি ঢোকা শুরু হয় গত মঙ্গলবার থেকে। বুধবার অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। এদিন ক্ষতিগ্রস্ত গ্যালারিগুলো ঘুরে দেখে হতবাক হয়ে যেতে হয়। ভবনের তৃতীয় তলা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেলা দুইটার দিকে মুক্তিযুদ্ধ গ্যালারিতে গিয়ে দেখা যায়, ধুয়া মোছার চিহ্ন। এর পরও মেঝেতে পানি জমে আছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলে মেজনিন ফ্লোর। উত্তর দিকের দেয়ালটি কয়েকদিন ভিজিয়ে রাখা সুতি কাপড়ের মতো। নরম এবং অমসৃণ। সাদা রং বাদামী হয়ে গেছে। এখানে ওখানে ফুলে উঠেছে সুপারির মতো। অথচ এই দেয়ালের পুরোটাজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ আলোকচিত্র। ভিজে নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে ১২টি ছবি নামিয়ে রাখা হয়েছে। গ্যালারিটিতে প্রজেক্টরের সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরা হয়। সেই প্রজেক্টরের গা ঘেঁষে নেমে গেছে পানি। বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিটের আশঙ্কায় এদিন তাই প্রজেক্টর বন্ধ রাখা হয়। মুক্তিযুদ্ধ কর্নার থেকে সামান্য এগোলে জয়নুল গ্যালারি। বেলা আড়াইটার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, সুন্দর সুসজ্জিত গ্যালারির একটি কোণ ভিজে একাকার হয়ে গেছে। জয়নুলের বিখ্যাত দুর্ভিক্ষ সিরিজের ছবিগুলো যে দেয়ালে স্থাপন করা হয়েছে তার ঠিক সামনে টপ টপ করে বৃষ্টির পানি পড়ছিল। বহু টাকা ব্যয়ে নতুন করে সাজানো গ্যালারির কার্পেট ভিজে ভারি হয়ে গেছে। জুতা পরা পা এগিয়ে দিতেই দেবে গেল! একই চিত্র দেখা গেল পাশে অবস্থিত ৩৫ নম্বার গ্যালারিটিতে। এখানেও দেশের খ্যাতিমান শিল্পীদের চিত্রকর্ম। বরেণ্য শিল্পী মোহাম্মদ ইকবালের বিশালাকার ক্যানভাসের খুব কাছে চলে এসেছে জল। পশ্চিম দিকের ছাদ দিয়ে পানি পড়ছিল। নিচে অস্থায়ীভাবে কোন পাত্রও বসানো হয়নি। ফলে পানি মেঝের অনেকটাজুড়ে ছড়িয়ে ছিল। অভিন্ন চিত্র ৩৪ নম্বর গ্যালারির। পশ্চিম দিকের দেয়ালে অনেকগুলো জল রং। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ঢাকার ঈদ ও মহররম পালনের ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। এই ছবিগুলোর পাশেই বৃষ্টির পানি। স্যাঁতস্যাঁতে দেয়াল। পলেস্তরা খসে পড়ছে। টানা বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জাদুঘরের চতুর্থ তলার একাধিক গ্যালারি। সাড়ে তিনটার দিকে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কোরিয়ান জাতীয় সংস্কৃতি কক্ষের একটি গ্লাস শোকেসের ওপরের অংশ ছুঁয়ে দিয়েছে বৃষ্টির জল। চাইনিজ ও সুইজারল্যান্ডের নিদর্শনের মাঝখানের ভেজা দেয়ালে বিদ্যুতের তার বের হয়ে আছে। এই ফ্লোরের ৪১ নম্বর গ্যালারির অবস্থা আরও খারাপ। এখানে দারু শিল্পের বিভিন্ন নিদর্শন দিয়ে সাজানো ওয়াল শোকেস। উঁকি দিয়ে দেখা যায়, একটি শোকেসের ভেতরে ঢুকে গেছে পানি। বঙ্গভবনের তোষাখানা থেকে সংগৃহীত নিদর্শনগুলোর কাছাকাছি দূরত্বে পৌঁছে গেছে পানি। এ অবস্থায় যতদ্রুত সম্ভব জাদুঘরের পুরোটা ভাল করে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা জরুরী বলে মনে করা হচ্ছে। একই চিন্তা থেকে আজ বৃহস্পতিবার জাদুঘরের কর্মকর্তা কর্মচারীদের নির্ধারিত ছুটি বাতিল করেছে কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি দেখভাল করার দায়িত্ব জাদুঘরের সহকারী প্রকৌশলী মনিরুল ইসলামের। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, জাদুঘরের ছাদের গঠনটা একটু অন্যরকম। থিকনেস খুব কম। তাছাড়া জাদুঘর ৩৬ বছরের পুরনো বিল্ডিং। হেভি রেইনফল হলে পানি জমে যায়। কোন দিক দিয়ে পানি ঢুকছে এখনও জানা যায়নি বলে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। একই বিষয়ে কথা হয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী সঙ্গে। প্রতিষ্ঠানের বহুবিধ সংস্কারের কাজ করেছেন তিনি। নানা কর্মসূচীও চলমান আছে। কিন্তু এত কিছুর পরও জাদুঘরের গ্যালারিতে কী করে পানি ঢুকে গেল? জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি আসার পর ২০১৫ সালে ছাদ সংস্কারের কাজ করিয়েছি। এরপর আর সমস্যা হচ্ছিল না। কিন্তু এবার অতি বৃষ্টির কারণেই হয়ত পানি ঢুকে গেছে। তবে আমরা সবাই সতর্ক ছিলাম। তাই কোন নিদর্শনের ক্ষতি হয়নি। জাতীয় জাদুঘর ভবনটি অনেক পুরনো জানিয়ে তিনি বলেন, সাময়িক সংস্কার করে আর আসলে কাজ হবে না। সামগ্রিক সংস্কার জরুরী। স্থায়ী সমাধান চাই। এর পর কিছুটা দুঃখ করেই তিনি বলেন, অর্থের অভাবে সে কাজে হাত দিতে পারছি না। কিন্তু এভাবে চললে, জাদুঘরটির কী হবে? কে দেবে সেই উত্তর?
×