ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাহানারা ইমামের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মারক বক্তৃতা

বাংলাদেশে গণহত্যাকারী পাকিস্তানীদের বিচার চাইলেন পাঞ্জাবী কবি

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ২৭ জুলাই ২০১৭

বাংলাদেশে গণহত্যাকারী পাকিস্তানীদের বিচার চাইলেন পাঞ্জাবী কবি

স্টাফ রিপোর্টার ॥ একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যাকারী পাকিস্তানীদের বিচারের দাবিতে পাকিস্তানী তরুণদেরই এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন সেদেশের কবি আহমদ সালিম। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান সরকার এখনও অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনি। বাংলাদেশ এখন বাস্তবতা। পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশ এখন উন্নত এবং অধিকতর সার্বভৌম। আমাদের নতুন প্রজন্ম অধিক আলোকিত, কম তমসাচ্ছন্ন।’ বাংলাদেশে গণহত্যাকারী পাকিস্তানীদের বিচারের দাবি জানান তিনিও। বুধবার বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ২৩তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ‘বাংলাদেশের গণহত্যার নিন্দা ও স্বীকৃতি সচেতন পাকিস্তানীদেরও দাবি’ শীর্ষক স্মারক বক্তৃতায় এসব কথা বলেন তিনি। ১৯৭১ সালে বাঙালীদের পক্ষে জনমত তৈরি করতে ছয় মাস কারাদ-ও পেয়েছিলেন এই পাঞ্জাবী কবি। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত ওই অনুষ্ঠানে কবি আহমদ সালিম এবং ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট, ল এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজকে ‘জাহানারা ইমাম স্মৃতি পদক’ প্রদান করা হয়। স্মারক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আমি পাকিস্তানের মুখপাত্র নই। সে দেশের সরকার কিংবা সংসদের প্রতিনিধিও নই। আমি একজন পাঞ্জাবী কবি, সেই বিনম্র যোগ্যতায় আমি বাংলাদেশের জনগণের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনী এবং তাদের দোসররা এদেশে যে গণহত্যা সংঘটিত করেছিল তার জন্য।’ বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের অবস্থান এখনও এলোমেলো অবস্থায় আছে বলে উল্লেখ করে কবি আহমদ সালিম বলেন, পাকিস্তানের পরিবেশ পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে এবং বহু পাকিস্তানী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তবুও সরকারী পর্যায়ে ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি এখনও এলোমেলো অবস্থায়। অনুষ্ঠানে উপস্থিত পাকিস্তানের দুই তরুণ লেখক আনাম জাকারিয়া এবং হারুন খালিদের নাম উল্লেখ করে আহমদ সালিম বলেন, এই প্রজন্মের এখন দায়িত্ব হলো এগিয়ে আসা এবং বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার জন্য সরকারের বোধোদয় ঘটানো এবং যারা বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটিত করেছে তাদের বিচার যেন করা হয় এবং সেই সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের নিকট ক্ষমা চাওয়া হয়- এ নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। কবিতা লেখা ছাড়াও ১৯৬৬ সাল থেকে পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সঙ্গে যুক্ত থাকার কথা বক্তৃতায় জানান কবি আহমদ সালিম। পাঞ্জাব ছাত্র ইউনিয়নের এই নেতা হিসেবে ১৯৭০ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় সক্রিয় থাকার কথাও বলেন তিনি। ১৯৭১ সালে অবদানের জন্য ২০১২ সালে তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানায় বাংলাদেশ সরকার। বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জেনারেল ইয়াহিয়ার অবস্থানের বিষয়ে প্রথম কবিতা ছাপানোর পরই গ্রেফতার হওয়ার কথা জানিয়ে তাকে কারাগারে পাঠানোর সময়ের বর্ণনা দেন কবি আহমদ সালিম। তিনি বলেন, আমাকে সামরিক আদালতে হাজির করা হলে বিচারক আমাকে ছয় মাসের কারাদ-ে দ-িত করেন। তখন আমি ম্যাজিস্ট্রেটকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি কি নিশ্চিত যে পরবর্তী ছয়মাস আপনি ক্ষমতায় থাকবেন? এরপর ক্ষিপ্ত হয়ে বিচারক আমাকে পাঁচটি বেত্রাঘাত করার আদেশ শাস্তিতে যোগ করেন। তিনি আরও বলেন, আমাকে অন্যান্য প্রশ্নের সঙ্গে এই প্রশ্নটি করা হয়েছিল- আপনি পাঞ্জাবী হয়ে পাঞ্জাবী সেনার সমালোচনা করছেন। আমার উত্তর ছিল সোজা। যারা মানুষ হত্যা করে, তাদেরকে পাঞ্জাবী বা পাঠান বলা হয় না। ’৭১ এর আগস্টে আমার বিচার হয়। ছয় মাস শেষ হওয়ার আগেই ১৬ ডিসেম্বরের আগমন ঘটে এবং আমার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়। অনুষ্ঠানে পাকিস্তানের মৌলবাদবিরোধী লেখক হারুন খালিদ বলেন, বাংলাদেশে যে গণহত্যা হয়েছে সেটা পাকিস্তান সরকারকে স্বীকার করতেই হবে। পাকিস্তানের নতুন প্রজন্ম এই বিষয়ে ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে উঠছে। তারা একজন আরেকজনের সঙ্গে বিষয়টি আলাপ-আলোচনাও করে থাকে। এখন সরকারকে সেদিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজ করা দরকার। আরেক মৌলবাদবিরোধী লেখক আনাম জাকারিয়া বলেন, আমরা এখানে যারা গণহত্যার শিকার হয়েছে তাদের পরিবারের কষ্টটা আমরা বুঝতে পারব না। কিন্তু আমরা সেই কষ্টগুলো খোঁজার চেষ্টা করছি এবং কিছুটা অনুভব করতে চাইছি। পাকিস্তানের সরকার পর্যন্ত আমরা হয়তো সেগুলো পৌঁছে দিতে পারব না। কিন্তু সেখানকার নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা এই কষ্টের কথাগুলো জানাব। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, সময় এসেছে পাকিস্তনের জন্য সরকারীভাবে ক্ষমা চাওয়ার। তাদেরকে ক্ষমা চাইতে হচ্ছে নিঃশর্তভাবে। পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের যে বিচার কাজ চলছে তাতে বিরোধিতা না করে গণহত্যার বিচারে সহযোগিতা করার। নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি শামসুল হুদার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে ইনস্টিটিউট অব কনফ্লিক্ট ল এ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আবদুর রশীদ, শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীর ছেলে তানভীর হায়দার চৌধুরী, শহীদ বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারের মেয়ে শমী কায়সার এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী ডাঃ আলীম চৌধুরীর মেয়ে ডাঃ নুজহাত চৌধুরী বক্তব্য দেন।
×