ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর পরামর্শ

কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধিমুখী নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২৭ জুলাই ২০১৭

কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধিমুখী নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে সামনে রেখে কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধিমুখী নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের প্রথমার্ধের (জুলাই-ডিসেম্বর) ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এ মুদ্রানীতি ঘোষণা করেন গবর্নর ফজলে কবির। এ সময় তিনি মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের জন্য সঞ্চয়পত্রে উচ্চ মুনাফার হার ও রেমিটেন্স কমে যাওয়ায় ঝুঁকির কথা উল্লেখ করেন। এ জন্য সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ায় সরকারের ঋণের বোঝা বাড়তে থাকায় এর সুদহার কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে গবর্নর বলেন, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের নতুন মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতের ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ। গত জানুয়ারি-জুন মেয়াদের মুদ্রানীতিতে বেসরকারী খাতে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হলেও মে পর্যন্ত সময়ে এ খাতে ঋণ বেড়েছে ১৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে সরকারী খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১২ দশমিক ১ শতাংশ, যা আগের মুদ্রানীতিতে ১৬ দশমিক ১ শতাংশ ছিল। আর জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের জন্য অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ১৫ দশমিক ৮ শতাংশ। জানুয়ারি-জুন মেয়াদের মুদ্রানীতিতে এই লক্ষ্য ছিল ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি কমিয়ে এনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘সংকোচনমূলক’ মুদ্রানীতি দিল কি নাÑ এ প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে গবর্নর বলেন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশে আটকে রাখার যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে নতুন মুদ্রানীতির মাধ্যমে সেটা সম্ভব। গবর্নর বলেন, দেশের উত্তর-পূর্ব হাওড়াঞ্চলে বিগত অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে আকস্মিক বন্যায় ফসলহানির কারণে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির কিছুটা উর্ধমুখী প্রবণতা এখনও বিদ্যমান। তবে প্রতিবেশী ভারতে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি দুই শতাংশের নিচে নেমে আসায় এবং ২০১৭ সালের শুরু থেকে জ্বালানি তেল ও অন্যান্য মুখ্য পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারমূল্য নিম্নমুখী বা স্থিতিশীল থাকায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি পরিমিত রাখা যাবে বলে আশা করা যায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে (মাসওয়ারি) জুন মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ। আর অর্থবছরের গড় মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। সঞ্চয়পত্রের বিক্রি বাড়ায় সরকারের ঋণের বোঝা বাড়তে থাকায় এর সুদহার কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন অর্থনীতিবিদরা। এবারের মুদ্রানীতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকও একই সুপারিশ করেছে। নতুন মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে, অচিরেই সঞ্চয়পত্রগুলোর মুনাফার হার বিদ্যমান বাজার সুদ হারের সঙ্গে অবশ্যই সম্পর্কিত করতে হবে। সঞ্চয়পত্রের উচ্চ মুনাফার হার সরকারের সুদ ব্যয়ভার বাড়াবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর ফজলে কবির। তিনি বলেন, জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের সঞ্চয়পত্রগুলোর বাজার সুদহারের সঙ্গে সংগতিহীন উচ্চ মুনাফা হার সরকারের জন্য অতিরিক্ত ব্যয়ভার সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর বলেন, সঞ্চয়পত্রের উচ্চ মুনাফার হার সরকারের সুদ ব্যয়ভার বাড়াবে। এছাড়া মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী সরকারী-বেসরকারী প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বন্ড বাজারের বিকাশ বাধাগ্রস্ত করবে। তিনি বলেন, এর ফলে মুদ্রানীতির কার্যকারিতার জন্য দরকারি সুষ্ঠু ট্রান্সমিশন চ্যানেলের বিকাশও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তাই অচিরেই সঞ্চয়পত্রগুলোর মুনাফা হার বিদ্যমান বাজার সুদহারের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে হবে। গবর্নর বলেন, সঞ্চয়পত্র মধ্যম আয়ের লোকদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাদের একটু একটু সঞ্চয় একদিন উদ্যোক্তা হতে সহায়তা করে। এই জন্য সঞ্চয়পত্র সুদের হার নিয়ে সরকার অনেক চিন্তাভাবনা করছে; বিশেষ করে এটাকে একটি বিধিবদ্ধ ও যৌক্তিক হারের মধ্যে আনার ব্যাপারে প্রচেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, এ ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্র বিক্রির ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সীমা বেঁধে দেয়া যেতে পারে কিংবা আমাদের আউটলেটগুলোতে ক্রেতার জাতীয় পরিচয়পত্রের সংযুক্তি থাকতে পারে। যাতে ১ জনে অধিক কিনছেন কি না তা শনাক্ত করা সম্ভব হয়। গত ৩০ জুন শেষ হওয়া ২০১৬-১৭ অর্থবছরের ১১ মাসেই প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকার নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এই অঙ্ক গত অর্থবছরের মূল বাজেটের লক্ষ্যের চেয়ে আড়াই গুণ এবং সংশোধিত বাজেটের চেয়েও ২ হাজার কোটি টাকা বেশি। গত ২৮ জুন বাজেটের সমাপনী বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সুদের হারের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির সরাসরি সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরে এই হার কমিয়ে আনার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে বাজেট আলোচনায় সংসদ সদস্যরা মধ্যবিত্তের সঞ্চয়ের এই মাধ্যমে সুদ হার না কমানোর পরামর্শ দেন। বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের ঘোষিত আর্থিক নীতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে প্রতি অর্থবছরে দুটি মুদ্রানীতি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। জানুয়ারি-জুন মেয়াদের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়েছিল গত বছরের ২৯ জানুয়ারি। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে গবর্নর বলেন, আমরা মূলত ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি (সহযোগী) প্রতিষ্ঠানের এক্সপোজার নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করেছে কিনা তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণে রাখি। যখন কোন ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান এই সীমা অতিক্রম করে আমরা তাদের সতর্ক করি। যাতে তারা নির্ধারিত সীমার মধ্যে থাকতে পারে। তিনি বলেন, এই বিষয়টি ছাড়া আমরা মুদ্রানীতিতে পুঁজিবাজারের সঙ্গে আর সংশ্লিষ্টতা দেখি না। আর কোন পুঁজিবাজার নিয়ে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) তো আছেই। তারা সার্বক্ষণিক এই বাজারে বিভিন্ন বিষয় পর্যবেক্ষণে রেখেছে। মুদ্রানীতিতে পুঁজিবাজারের অবস্থাকে প্রাণবন্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, পুঁজিবাজারে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান সূচক ২০ শতাংশ বেড়েছে। আর ২০১৭ অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে পুঁজিবাজারের প্রাইস ট্রেন্ট (প্রবণতা) ছিল প্রাণবন্ত। আলোচ্য সময়ে বিদেশী পোর্টফোলিওতে বিনিয়োগ বেড়েছে প্রায় ৩ গুণ। বিশেষ করে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা অনেক বেশি আকৃষ্ট হয়েছে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে। এছাড়া বাংলাদেশের পুঁজিবাজার ফ্রন্টিয়ার অর্থনীতিতে অন্তর্ভুক্তিসহ সব মিলে ইতিবাচক অবস্থানে রয়েছে। ফ্রন্টিয়ার মার্কেট হচ্ছে উন্নয়নশীল দেশের সেই পুঁজিবাজার, যার আকার বেশ ছোট, যার প্রোডাক্ট খুবই সীমিত, যেখানে বিনিয়োগকারীরা উচ্চ মুনাফা প্রত্যাশা করে। এ ধরনের বাজারে উঠানামাও অনেক বেশি। দেশের পুঁজিবাজারে বন্ড মার্কেট চালুর ব্যাপারে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গবর্নর এস কে সুর চৌধুরী। তিনি গবর্নর ফজলে কবিরের বরাত দিয়ে বলেন, বন্ড মার্কেট চালু করা বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব। এ ব্যাপারে জোর প্রচেষ্টা চলছে। এস কে সুর বলেন, বন্ড মার্কেট নিয়ে আমরা অনেক দিন ধরে কাজ করছি। এ ক্ষেত্রে সঞ্চয়পত্র অনেকটাই বাধার সৃষ্টি করছে ঠিকই। তবে সরকার চাইলে বন্ড ইস্যু করার মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করতে পারে। এমনকি ইসলামী ব্যাংকে রিজার্ভ থাকা সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বন্ড ইস্যু করার মাধ্যমে মেগা প্রকল্পের জন্য সরকার নিতে পারে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বন্ড নিয়ে আমাদের দেশে সচেতনতার অভাব রয়েছে। অন্যান্য দেশের বন্ড বিক্রির জন্য মেলা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়। আমরা এখনও অত দূর এগিয়ে যেতে পারিনি। বন্ড মার্কেট চালু হলে আমরা এ নিয়ে আরও কাজ করতে পারব। ডেপুটি গবর্নর বলেন, পুঁজিবাজারে প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি মার্কেট বেশ ভাল অবস্থানে রয়েছে। এ বাজারে অন্যান্য প্রোডাক্ট আনারও চেষ্টা চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রচেষ্টায় আশা করছি, বন্ড মার্কেট সৃষ্টিতে ইতিবাচক সাফল্য আসবে। ঘোষিত মুদ্রানীতিতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার কমিয়ে ধরায় মুদ্রা সরবরাহ, সুদের হার তথা অর্থনীতিতে কোন প্রভাব পড়বে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঘোষিত মুদ্রানীতি গতানুগতিক। কোন খাতেই এর বড় কোন প্রভাব পড়বে না। ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে তিনি বলেন, আগের মুদ্রানীতিগুলোতে ঋণ প্রবৃদ্ধির যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল তা অর্জিত হয়নি। প্রকৃত প্রবৃদ্ধির হার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশ কম। ঋণের চাহিদা কম থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক এবার লক্ষ্যমাত্রা সমন্বয় করেছে। এ সময় ডেপুটি গবর্নর আবু হেনা মোহাম্মদ রাজি হাসান ও এস কে সুর চৌধুরী, বাংলাদেশ ব্যাংকের চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট উপদেষ্টা আল্লাহ মালিক কাজেমি, প্রধান অর্থনীতিবিদ ফয়সাল আহমেদ, প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মোঃ আখতারুজ্জামানসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
×