ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

স্কুল কলেজ অফিসযাত্রী সবাই চরম ভোগান্তিতে;###;রাস্তায় চলছে নৌকা ;###;বুধবার সারাদেশে বৃষ্টি হয়েছে ৯শ’ মিমি

দুদিন একটানা বৃষ্টি ॥ থেমে গেছে নগরী

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৭ জুলাই ২০১৭

দুদিন একটানা বৃষ্টি ॥ থেমে গেছে নগরী

রাজন ভট্টাচার্য ॥ রাজধানীর রেডিসন হোটেলের পরে মিরপুর ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে হাতের বাম পাশে তাকালে চোখে পড়বে ভিন্ন রকমের একটি সাইনবোর্ড। এর আগে এমন সাইনবোর্ড রাজধানীতে আর দেখা যায়নি। টানা বৃষ্টিপাতের কারণে ফ্লাইওভারের মুখ ডুবে গেছে পানিতে। গাড়ির চাকার সঙ্গে ঢেউ আছড়ে পড়ছে। তার নিচের সড়কপথটি যে ভাল তা কে জানে। তাই তো ‘পানির নিচে রাস্তা ভাল’-এমন সাইনবোর্ড টাঙ্গানো হয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক উত্তর বিভাগের পক্ষ থেকে। জনস্বার্থে ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বাস্তবতা হলো, এই সাইনবোর্ডই রাজধানীর জলজট পরিস্থিতি বোঝার জন্য যথেষ্ট। অর্থাৎ কোন প্রেক্ষাপটে এমন সাইনবোর্ড ঝুলানো হতে পারে সহজেই তা অনুমান করা যায়। আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, সোমবার সকাল ছয়টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ছয়টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ তিন হাজার ৩৩৫ মিলিমিটার। মঙ্গলবার সকাল থেকে বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে এক হাজার ৩৮ মিমি। সোমবার থেকে বুধবার সকাল পর্যন্ত রাজধানীতে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৭৯ মিমি। বুধবার দেশজুড়ে দিনভর বৃষ্টিপাত হয়েছে প্রায় ৯০০ মিমি। গত তিনদিনে সারাদেশে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে অন্যান্য বছর বর্ষাকালেও (আষাড়-শ্রাবণ) এত পরিমাণ বৃষ্টি হয় না। এর মধ্যে পানি সম্পদমন্ত্রী আভাস দিয়েছেন, আসছে মাসে দেশে বড় ধরনের বন্যা হতে পারে। তাই বৃষ্টিপাত শেষ, তা বলা যাবে না। সামনে বৃষ্টির সঙ্গে দুর্ভোগ আরও পোহাতে হবে এটা অনেকটাই নিশ্চিত। তিনদিনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত। এতে গোটা রাজধানী পানিতে থৈ থৈ। জলজট, যানজট আর পরিবহন সঙ্কট মিলিয়ে ভোগান্তি মাত্রা ছাড়িয়েছে নগরবাসীর জীবনে। ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে ঘণ্টায়। পরিস্থিতি নিজ চোখে দেখতে সিটি কর্পোরেশনের দুই মেয়রকেও হাঁটু পানিতে নামতে দেখা গেছে। এর মধ্যে বিভিন্ন এলাকায় সড়ক কাটা ও ভাঙ্গা সড়কের কারণে দুর্ভোগ কতটা মাত্রা ছাড়াতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি সচিবালয় থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ এলাকা, এমপি হোস্টেল, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে পরিচিত মতিঝিলসহ গুরুত্বপূর্ণ সকল স্থাপনাতেই ছিল পানি আর পানি। জলাবদ্ধতা। এক কথায় বললে, গোটা রাজধানীই যেন পানিতে ভাসছিল। বিভিন্ন এলাকায় মানুষের বাসাবাড়িতেও পানি ওঠে। নগরীর নিম্নাঞ্চলে দেখা দিয়েছে বন্যা। বেইলী রোড, মালিবাগসহ কয়েকটি সড়কে গাড়ি নষ্ট হয়ে পড়ে থাকতেও দেখা গেছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় নৌকা চলতেও দেখা যায়। যানবাহন কম থাকা ও সড়কে বেশি পানি হওয়ার কারণে নগরীর পুরানা পল্টনসহ আশপাশের এলাকায় নৌকা চলতে দেখা গেছে। জলাবদ্ধতার কারণে নগরবাসী এক প্রকার ঘরে অবরুদ্ধ হয়ে পড়লেও এ নিয়ে ওয়াসা ও সিটি কর্পোরেশনকে খুব একটা তৎপর হতে দেখা যায়নি। এই দুই সেবা সংস্থার কর্মীদের পানি নিষ্কাশনে তৎপরতা খুব একটা লক্ষ করা যায়নি। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণেই এই দুর্ভোগ। তিলে তিলে রাজধানীর প্রায় ৬৩টি খাল নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। গতিপথ বদলে কোন রকমে হাতেগোনা কয়েকটি খাল টিকে এখন কালের সাক্ষী হয়ে আছে। অনেক খালের খাস জমি নিজের নামে করে নিয়েছে ভূমিদস্যুরা। ব্রক্ষ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদীকে ধ্বংস করা হয়েছে। ভরাট করা হয়েছে বিলঝিল। নগরীতে পুকুর এখন হাতে গোনা যাবে। সব মিলিয়ে পানি ধারণের কোন ব্যবস্থাই রাজধানীতে নেই। সব মিলিয়ে অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা ও বন্যা দেখা দেয়। রাজধানীর জলাবদ্ধতা বিপর্যয় নিয়ে বুধবার দিনভর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলে নানা আলোচনা। অনেকেই নিজ নিজ এলাকার ভোগান্তির চিত্র ফেসবুকে পোস্ট করতে দেখা গেছে। ভিআইপি সড়কে পানি বিমানবন্দর থেকে টাকামুখী সড়কটি ভিআইপি সড়ক হিসেবে পরিচিত। বিদেশী অতিথিরা এই সড়কটিই ব্যবহার করেন। অথচ গুরুত্বপূর্ণ সড়কটিও অল্প পানিতেই জলমগ্ন হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টায়ও জলাবদ্ধতা কাটে না। নিয়মিত কুড়িল ফ্লাইওভার ব্যবহাকারীদের অভিযোগ, বর্ষা মৌসুমের শুরু থেকেই কুড়িল ও বনানী ফ্লাইওভারের গোড়ায় পানি জমে জলাবদ্ধতা স্থায়ী রূপ নিলেও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) এগিয়ে আসেনি। দেশের সবচেয়ে ভিআইপি এ সড়কপথে এখন থৈ থৈ পানি মাড়িয়ে ফ্লাইওভার চড়ে গাড়ি। আবার অনেকেই পানির নিচে খাদ আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে পারেন না। এ কারণে ফ্লাইওভারের রেলিং ঘেঁষে গাড়ি ওপরে উঠতে গিয়ে যানজট লেগে যাচ্ছে। হাঁটু পানিতে ডুবেছে ফ্লাইওভার গোড়ায় অংশ। পানি সরে যাওয়ার জন্য একটি ড্রেন রয়েছে, কিন্তু তাতে পানি ঠিকমতো সরছে না। ড্রেনটির পেছনের অংশে যেখানে পানি গড়িয়ে পড়ার কথা সেটির মুখ বন্ধ। এ কারণে পানি জমে ফ্লাইওভারের প্রবেশমুখে বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ট্রাফিক পুলিশ সাইনবোর্ড দিয়ে গাড়ি চালকের ভয় দূর করতে চেয়েছে। কিন্তু পানি সরিয়ে দিয়ে ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঠিক করে দিতে আসছে না ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন। এখানে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট আসাদ জানান, জলাবদ্ধতা কমে গেলে ‘পানির নিচে রাস্তা ভাল’ লেখা সাইনবোর্ডটি সরিয়ে নেয়া হবে। এখানে পানি থাকায় লোকজন গাড়ি নিয়ে ভয় পাচ্ছেন। ফ্লাইওভারে উঠতে গিয়ে অনেকে থেমে যাচ্ছেনÑ এ কারণে এটি লাগানো হয়েছে। পানিতে ভাসছে গাড়ি মিরপুর ১২ নম্বর সড়কের অবস্থা বেহাল। এর মধ্যে সড়কে পানি আর পানি। যানবাহন যা চলেছে তাও ঝুঁকি নিয়ে। এই সড়কে অন্তত ২০টি গাড়ি গর্তে পড়ে বিকল হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। বৃষ্টি কমার পর গাড়ি সরানো হয়। একই চিত্র দেখা গেছে, শান্তিনগর ও রাজারবাগ এলাকায়। শান্তিনগর কাঁচাবাজার সড়কে দেখা গেছে অন্তত ৬টি প্রাইভেটকার প্রায় ডুবো ডুবো অবস্থা। আশপাশের লোকজন জানিয়েছেন, বেশি পানির কারণে গাড়িগুলো বিকল হয়ে যায়। বৃষ্টি না থামায় চালক রাস্তার পাশে গাড়ি রেখে চলে গেছে। রাজারবাগ সড়কেও থৈ থৈ ঢেউয়ের মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রাইভেটকার, অটোরিক্সা বিকল হয়ে পড়ে থাকতে দেখা গেছে। নিউমার্কেট এলাকাতেও এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে। পুরনো ঢাকার একাধিক এলাকায় পানি বেশি হওয়ায় নৌকা দিয়ে মানুষ পারাপার করতে দেখা যায়। রামপুরা ব্রিজ থেকে মালিবাগ রেলগেট এলাকা মানেই মহাদুর্ভোগের কেন্দ্রস্থল। ভাঙ্গাচোরা সড়ক, বিশাল বিশাল গর্ত আর, বিভিন্ন সেবা সংস্থার রাস্তা কেটে রাখার কারণে জলাবদ্ধতায় মাত্রা ছাড়ায় কষ্ট। কয়েকটি কাভার্ড ভ্যান এই রুটে উল্টে যেতে দেখা গেছে। মৌচাক, মালিবাগ, ওয়্যারলেস গেট, বেইলী রোড, রমনাসহ আশপাশের এলাকায় জলাবদ্ধতা বেশি হওয়ায় দিনভর দুর্ভোগ পোহাতে হয় এই এলাকার মানুষদের। পুরো কমলাপুর রেলস্টেশন দেখলে মনে হবে একটি বিশাল পুকুর। মাঝখান দিয়ে চলছে গাড়ি। ডুবো ডুবো রিক্সা। কিছু মানুষও চলার চেষ্টা করছেন। বৃষ্টির পানিতে পথশিশুদের দৌড়ঝাঁপ। যারা বিভিন্ন গন্তব্য থেকে ট্রেনে করে কমলাপুরে আসেন তাদের এ দৃশ্য দেখে চোখ কপালে ওঠার মতো। যারা কমলাপুরের উদ্দেশে যান তাদের তো ভোগান্তির শেষ নেই। একে তে পরিবহন সঙ্কট। তারপর বাড়তি ভাড়ার সমস্যা তো আছেই। পার্টি অফিসে পানি রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন নিয়ে হন জনপ্রতিনিধি। কিন্তু সেই জনপ্রতিনিধিদের দলীয় কার্যালয়গুলোও জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পায়নি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বৃষ্টিতে গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে শুরু করেও আশপাশের এলাকা নদীতে পরিণত হয়। যতদূর চোখ যায় পানি আর পানি। সঙ্গে ঢেউ। বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এলাকায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় ভেঙ্গে নতুন ভবন করার প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু সড়কটি ডুবে ছিল। আশপাশের দোকানপাটে পানি উঠতে দেখা যায়। পুরনো ভবনটি থাকলে নির্ঘাত ভেতরে পানি উঠত। নয়া পল্টন এলাকাজুড়ে পানির রাজ্য। মতিঝিল থেকে আরামবাগ, ফকিরাপুল, কাকরাইল, বিজয়নগর, শান্তিনগরসহ আশপাশের মূল সড়ক থেকে অলিগলি সবখানেই পানি আর পানি। দোকানপাট, ভবনেও পানি ঢুকতে দেখা গেছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও পানি ঢুকতে দেখা যায়। কাকরাইলে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়েও পানি ঢুকেছে। দুপুরে জাপা কার্যালয়ে একটি বৈঠক আহ্বান করেছিলেন দলটির মহাসচিব। নেতাকর্মীদের পানি ভেঙ্গে কার্যালয়ে প্রবেশ করতে দেখা গেছে। পার্টি অফিস বলে কথা নয়, নিউমার্কেটের ভেতরের চিত্র দেখলে বোঝার কোন উপায় ছিল না এখানে প্রতিদিন হাজারো মানুষের সমাগম থাকে। দেখতে মনে হবে চারদিক ঘিরে রাখা একটি বিশাল আয়তনের পুকুর। একই চিত্র খিলগাঁও সিটি কর্পোরেশন মার্কেটেরও। মৌচাক মার্কেটসহ পেছনের সবকটি মার্কেট এলাকা ছিল জলমগ্ন ও ক্রেতাশূন্য। পথে পথে পরিবহন সঙ্কট ও যানজট বৃষ্টির কারণে পরিবহন সঙ্কট যেতন তীব্র ছিল তেমনি যানজটও ছিল বেশ। বিশেষ করে গণপরিবহনের সংখ্যা ছিল একেবারেই কম। সবচেয়ে বেশি চলেছে প্রাইভেটকার ও রিক্সা। ফলে বিভিন্ন সড়কের পয়েন্টে পয়েন্টে মানুষের জলা দেখা গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা শেষে ভ্যানে অথবা পায়ে হেঁটে নগরবাসীকে বিভিন্ন গন্তব্যে যেতে দেখা গেছে। নগরীর শাহবাগ, মালিবাগ, ধানম-ি, খিলক্ষেত, এয়ারপোর্ট, মৌচাক, ফার্মগেট, কাওরানবাজার, সায়েন্সল্যাব, এ্যালিফ্যান্ট রোড, বনশ্রী, খিলগাঁও, ফকিরাপুল, মতিঝিল, মিরপুর, গাবতলী, প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন এলাকায় দুর্ভোগের চিত্র দেখা গেছে। এসব এলাকায় একদিকে যেমন যানবাহন সঙ্কট, অন্যদিকে যানজটের কারণে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে ঘরের বাইরে আসা মানুষদের। বর্ষার শুরু থেকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ঢিলে তালে চলছে উন্নয়ন কাজের খোঁড়াখুঁড়ি। বৃষ্টি হলেই শুরু হয় জলাবদ্ধতা। এ কারণে কোথাও দেখা দেয় গণপরিবহন সঙ্কট, আবার কোথাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে স্থবির হয়ে যায় নগরী। বুধবার সকাল থেকে পরিবহন সঙ্কট আর যানজটের তীব্রতা ধারণ করে অসহনীয় পর্যায়ে। এ কারণে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়েছে কর্মব্যস্ত মানুষদের। স্কুল ও কলেজগামী শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি হয়েছে চরমে। সড়কে কিছু বাসের দেখা মিললেও সিটিং সার্ভিসের নামে অধিকাংশ বাস দরজা বন্ধ করে চলাচল করছে। তারা গণপরিবহনে সিটিং সার্ভিসের লেবাস লাগিয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে। শাহবাগে অপেক্ষমাণ যাত্রী আজমল উদ্দিন বলেন, ‘মিরপুরে যাওয়ার উদ্দেশে বাসের জন্য এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করার পর একটি বাসে উঠেছি। বিকল্প অটো সার্ভিস নামের পরিবহনটি সিটিং সার্ভিসের নামে বিআরটিসি নির্ধারিত ভাড়ার তিনগুণ বেশি নিয়েছে।’ এদিকে পল্টন-শাহবাগ এলাকায় তীব্র যানজট দেখা দেয়ায় হাইকোর্টের সামনে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে রওনা দিয়েছেন বেসরকারী একটি কোম্পানির কর্মকর্তা মনসুর। এ বিষয়ে জানতে চাইলে, প্রেসক্লাবের সামনে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি নতুন কিছু নয়। বৃষ্টি হলেই ঢাকাজুড়ে যানজট ও পরিবহন সঙ্কট দেখা দেয়। আজও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।’ সংসদ ভবন এলাকাতেও ছিল পানি আর পানি। সরকারী প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি কাজী কেরামত আলী বৈঠক শেষ করে ওই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ঢাকায় এমন বৃষ্টি খুব কমই হয়। এ বৃষ্টিতে সাধারণ মানুষের অনেক অসুবিধা হয়। প্রাণহানি ঘটে, ফসলের ক্ষতি হয়। তবুও আমরা অনেকে বৃষ্টি ও এর পানি ভালবাসি। কারণ, এটি আল্লাহর অশেষ নেয়ামত। এদিকে, জাতীয় সংসদের সামনের রাস্তা মানিক মিয়া এভিনিউ, দুই পাশে মনিপুরীপাড়া ও মিরপুর রোডÑ পুরোটাই বুধবার সকালে জলমগ্ন ছিল। ফলে সংসদে কর্মরতদের ঢুকতে অনেক সমস্যা হয়। তবে যারা সংসদের বাস ব্যবহার করে অফিসে যান, তাদের তেমন কোন সমস্যা হয়নি। সংসদ এলাকায় এমন পানি জমা নিয়ে কথা হয় সংসদের প্রধান হুইপ আ স ম ফিরোজের সঙ্গে। তিনি জানান, বুধবার সকালে এমন বৃষ্টি হয়েছে যে ড্রেনেজ ব্যবস্থাও তা সামলাতে পারেনি। তবে আগামীতে যাতে এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয় সে জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। মহাখালীর একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের চাকরিরত অনীক সকালে পান্থপথের বাসা থেকে অফিসে পৌঁছেছেন সোয়া দুই ঘণ্টায়। তিনি জানান, ভারি বৃষ্টির কারণে রাস্তায় যানবাহন অন্যদিনের তুলনায় কম। ফলে গাড়ি পেতেই সবার সমস্যা হচ্ছে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ সড়কে জলাবদ্ধতার কারণে যানজটে আটকে থাকতে হচ্ছে দীর্ঘ সময়। ফার্মগেট বাসস্ট্যান্ড থেকে বিজয় সরণির মোড় পর্যন্ত এক কিলোমিটার যেতেই আমার লেগেছে ৫৫ মিনিট। মনিপুরীপাড়ার এক নম্বর গেট থেকে বিজয় সরণি মোড় পেরিয়ে পুরো রাস্তায় পানি জমে আছে। এনজিওকর্মী কল্লোল জানান, দক্ষিণ বনশ্রী থেকে গুলশান এক নম্বরে যেতে সময় লেগেছে প্রায় দুই ঘণ্টা। প্রগতি সরণিতে পানি জমে থাকায় ওই সড়কে দীর্ঘ যানজটের কথা জানিয়েছেন তিনি। বিমানবন্দর সড়কে বনানীগামী রাস্তা যানজটে এক প্রকার অচল হয়ে থাকতে দেখা যায় বেলা ১০টার পর। শেওড়া বাসস্ট্যান্ডে যাত্রী ওঠানামার জন্য বাসগুলো এলোমেলোভাবে থামানোয় খিলক্ষেত থেকে শেওড়া পর্যন্ত যানজট রয়েছে। উন্নয়ন কাজ চলায় যমুনা ফিউচার পার্কেও পর থেকে প্রগতি সরণির প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তায় যানজট থাকায় তার চাপ পড়ে সড়কের অন্যান্য অংশেও। খিলক্ষেত ফ্লাইওভার থেকেই থেমে থাকা যানবাহনের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। মেরুল বাড্ডা থেকে পল্টন মোড়ে আসতে অন্য সময় ৪০ মিনিট থেকে এক ঘণ্টা লাগলেও বুধবার দুই থেকে তিন ঘণ্টা লাগছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজের জন্য মালিবাগের পুরো এলাকাতেই নাজুক পরিস্থিতি। এর মধ্যে কোথাও কোথাও হাঁটু পানি জমে থাকতে দেখা গেছে। গুলিস্তানের ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম জানান, মেরুল বাড্ডা থেকে পল্টনে যাওয়ার জন্য সকাল ৮টা থেকে পৌনে ৯টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও কোন বাসে উঠতে পারেননি। ইস্কাটন, পান্থপথ, রাজাবাজার ও রায়ের বাজারে ভেতরের প্রায় সব গলিতে পানি জমে। স্থানীয় বাসিন্দাদের বাসা থেকে বের হওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। বাসাবো, মায়াকানান, পুরনো ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় পানি ঢুকেছে বাড়ির নিচতলাতেও। মিরপুর সড়কের পুরো যানজটের কারণ যে ধানম-ি ১৬ নম্বর সড়কের মোড় সেটা কেন এই অবস্থায় ফেলে রাখা হচ্ছেÑ এ প্রশ্নের জবাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান বলেন, ‘এখানে পানি জমলে ঘণ্টা খানেক সময় লাগে পানি নামতে। এ এলাকা থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য আমরা মডেল সড়কের পাইলট প্রকল্প নিয়েছি। ইতোমধ্যে পরিকল্পনাও জমা নেয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলেই এই এলাকার হয়রানি বন্ধ হবে।’ পানিতে মেয়রদ্বয় বৃষ্টির পানি দ্রুত সরাতে ও জলাবদ্ধতা দূর করতে ঢাকা ওয়াসার কাজ সিটি কর্পোরেশন করছেন বলে দাবি করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন। বুধবার দুপুরে নগরীর বিভিন্ন স্থানে অতি বর্ষণজনিত সৃষ্ট জলাবদ্ধতা পরিদর্শনের সময় মেয়র এসব কথা বলেন। এ সময় সাংবাদিকদেরও প্রশ্নের জবাবে মেয়র জানান, গত কয়েকদিনের অতি বর্ষণের কারণে নগরীর বিভিন্ন স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। ডিএসসিসির কর্মীরা এটি নিরসনের লক্ষ্যে কাজ করছে। আশা করি, বৃষ্টি থামার ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে পানি অপসারিত হয়ে যাবে। সাঈদ খোকন বলেন, জলাবদ্ধতা দূর করা সিটি কর্পোরেশনের কাজ নয় এটি মূলত ঢাকা ওয়াসার কাজ। তারপরও নাগরিকদের ভোগান্তির চিন্তা করে আমাদের সিটি কর্পোরেশনের লোকজন মাঠে নেমে এসব কাজ করছেন। মূলত সমস্যার সময় ওয়াসার লোকজনকে মাঠে পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে তাদের আন্তরিকতা কম। ঢাকায় একসঙ্গে ১০০ রথকে ১৫০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে পানি অতিক্রম হয়ে যাওয়ার মতো ড্রেনেজ সিস্টেম নেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী এটা করা হলে এ সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়া যেত। এ পরিদর্শনকালে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বিলাল, প্রধান প্রকৌশলী ফরাজী শাহাবুদ্দিন আহমদসহ সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তাগণ উপস্থিত ছিলেন। মেয়র আনিসুল হকও পানি পরিস্থিতি দেখতে রাস্তায় নামেন। তিনি বলেন, জলাবদ্ধতা নিসরসনে আমাদের হাতে আলাদিনের চেরাগ নেই। রাতারাতি সবকিছু বদলে দেয়া যাবে না। কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আশা করি, আস্তে আস্তে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এক বছর সময় চাই স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন ওয়াদা করে বলেন, আগামী বছর থেকে ঢাকায় জলাবদ্ধতা থাকবে না। বুধবার সচিবালয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত আলোচনা সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এ কথা বলেন। মন্ত্রী বলেন, ‘আমি প্রমিজ করছি, সামনের বছর থেকে আর এসব (জলাবদ্ধতা) দেখবেন না। কিছুদিনের মধ্যই নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে।’ মন্ত্রী বৃষ্টির কারণে বর্তমান জলাবদ্ধতাকে অস্বাভাবিক পরিস্থিত উল্লেখ করে বলেন, ‘এই পরিস্থিতিটা আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি, কোন জায়গাতে আটকা পড়ছি। সে জায়গায় দ্রুত ব্যবস্থা নেব। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানান, তারা জরিপ করে দেখেছেন যে, ঢাকার ৪৬টি খালের মধ্যে ১৮টির উন্নয়ন করতে হবে। এগুলো অবশ্যই করতে হবে। ওয়াসাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, ভারি বৃষ্টি হলেও যাতে তিন ঘণ্টার মধ্যে পানি নিষ্কাশন হয়।
×