ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

কয়েক লাখ পানিবন্দী

প্রকাশিত: ০৪:৫৫, ২৭ জুলাই ২০১৭

কয়েক লাখ  পানিবন্দী

মোঃ খলিলুর রহমান, নারায়ণগঞ্জ থেকে ॥ গত কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণের আবারও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ- ডেমরা (ডিএনডি) প্রজেক্টের ভেতরে অবস্থিত রাজধানী ঢাকার ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, কদমতলী, নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জ থানা এলাকার বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক আকারে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। খোদ পাউবোর কর্মকর্তারাই জানান, বর্তমানে ডিএনডির নিচু এলাকার বাড়িঘর ও রাস্তাঘাট আড়াইফুট পানিতে তলিয়ে আছে। এতে ডিএনডির অভ্যন্তরে বসবাসরত কয়েক লাখ বাসিন্দার জনজীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্ভোগ। কোন কোন এলাকায় রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় রাস্তায় বালির বস্তা ও সাঁকো তৈরি করে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে। আর যেসব এলাকায় পানি একটু বেশি সেসব এলাকায় মানুষ এখন নৌকায় চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে। ডুবে গেছে গ্যাসের চুলা। ফলে রান্নাবান্নাও বন্ধ। অনেক এলাকার বহুতল ভবনের নিচ তলায় পানিতে ডুবে গেছে। এমনিতেই গত দেড় থেকে দু’মাস ধরে ডিএনডির অনেক এলাকায় লাগাতার জলাবদ্ধতার মধ্যে লোকজন জীবনযাপন করে আসছিল। কিন্তু গত তিনদিনের টানা প্রবল বর্ষণে আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বলে ভুক্তভোগীরা জানান। এদিকে পুরো ডিএনডি প্রজেক্টের অভ্যন্তরে জমে থাকা পানি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলের পাম্প হাউসের ৫১২ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন চারটি পাম্পের সাহায্যে ইনটেক খাল দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে নিষ্কাশন করা হচ্ছে। কিন্তু পাম্পগুলো ৫০ বছরের পুরনো হওয়ায় এর কার্যক্ষমতা অনেক কমে গেছে বলেও পাউবোর কর্মকর্তারা স্বীকার করেছেন। বুধবার বিকেলে শিমরাইল পাম্প হাউসে গিয়ে ৫১২ কিউসের ক্ষমতাসম্পন্ন ৪টি পাম্পই চলতে দেখা গেছে। এছাড়াও ৫ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন আরও ১৫টি পাম্প চালু রয়েছে বলেও পাম্প হাউসের কর্তৃপক্ষ জানান। ১৯৬৬-৬৮ সালে রাজধানী ঢাকার ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, শ্যামপুর, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লার থানা এলাকার ৮ হাজার ৩শ’ ৪০ হেক্টর এলাকা নিয়ে ডিএনডি বাঁধটি নির্মিত হয়। বর্তমানে ডিএনডিতে প্রায় ২০ লাখ লোক বসবাস করছে। এদের মধ্যে কয়েক লাখ বাসিন্দা গত দেড় থেকে দুই মাস ধরে পানিবন্দী অবস্থায় দিনাতিপাত করছে। ঢাকার ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, কদমতলী, শ্যামপুর, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লা থানার বিভিন্ন এলাকা এখন পানির নিচে। কোন কোন এলাকায় স্থানভেদে ১ থেকে ৩ ফুট পানিতে তলিয়ে আছে বলে জানা গেছে। ময়লা-আবর্জনার মিশ্রিত পানিতে এলাকাবাসীকে চলাচল করতে হচ্ছে। ডিএনডি এলাকাটি ঢাকা-৪, ঢাকা-৫ ও নারায়ণগঞ্জ-৪ সংসদীয় আসনের এলাকায় পড়েছে। গত তিন দিনের বর্ষণে জলাবদ্ধতা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। ফতুল্লার সেহচর এলাকা বর্ষণের পানিতে থৈ থৈ করতে দেখা গেছে। অনেকের বাড়িঘরের ভেতরেও পানি ঢুকেছে। গ্যাসের চুলাও ডুবে গেছে। তাই ঘরে চৌকিতে মাটির চুলা বসিয়ে রান্না করতে বাধ্য হচ্ছে অনেকেই। রুবিনা বেগম জানান, জলাবদ্ধতার কারণে প্রায় দুই মাস ধরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। মাঝেমধ্যে কয়েক দিনের জন্য পানি ঘর থেকে নামলেও গত তিন দিনের বৃষ্টিতে আবারও ঘরে পানি ঢুকেছে। আর কিছুদিন বৃষ্টি হলে থাকার মতো কোন স্থানই থাকবে না। সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি দক্ষিণপাড়ার বাসিন্দা ফজলুল হক জানান, মিজমিজি দক্ষিণপাড়ায় ঘরে ঘরে পানি। রাস্তাঘাট পানির নিচে। তিনি জানান, দ্রুত পানি নিষ্কাশনের অভাবে একটু বৃষ্টি হলেই ডিএনডিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। তার দাবি, পাম্প হাউসের প্রধান নিষ্কাশন খালটি ১০ ফুট গভীর করা হলে ও ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা হলে দ্রুত পানি নিষ্কাশন হবে। পাম্প হাউসের নিষ্কাশন খালের ৪-৫ কিলোমিটার পর্যন্ত কুচুরিপানা, ময়লা-আর্জনায় ভরে গেছে। এগুলো পরিষ্কার করলে দ্রুত পানি নেমে যাবে। তিনি আরও জানান, একনেকে পাস হওয়া ৫৫৮ কোটি টাকার যে প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে তা দ্রুত বাস্তবায়ন করলে ডিএনডির জলাবদ্ধতা দূর হবে। ফতুল্লার কুতুবপুরের বাসিন্দা সুলতানের ঘরেও হাঁটুর ওপর পানি। সুলতানা জানান, আগের বৃষ্টিতেই আমরা পানিতে তলিয়ে গেছি। রান্নাবান্না বন্ধ। বাজারঘাট করতে পারছি না। কদমতলীর বড় পুকুরপারের বাসিন্দা জয়নাল আবেদীন জানান, গত দু’মাস ধরে এখানকার রাস্তাটি পানিতে ডুবে আছে। কিছুতেই পানি দূর হচ্ছে না। গত তিন দিনের প্রবল বর্ষণের আরও জলাবদ্ধতা বেড়েছে। বড় পুকুরপার এলাকায় রাস্তায় বাঁশের সাঁকো তৈরি করে চলাচল করতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার কুতুবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনিরুল আলম সেন্টু তার এলাকায় ব্যাপক জলাবদ্ধতার সৃষ্টির কথা স্বীকার করে জানান, জলাবদ্ধতার দূর করার জন্য আমরা শুনেছি সাড়ে ৫শ’ কোটি টাকার একটি প্রকল্প একনেকে পাস হয়েছে। সেটা বাস্তবায়ন হলেই ডিএনডির জলাবদ্ধতার দূর হবে। শিমরাইল পাম্প হাউসের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আব্দুল জব্বার ব্যাপক জলাবদ্ধতার কথা স্বীকার করে জানান, ডিএনডির ভেতরের পানি ৫০ বছরের পুরনো পাম্প হাউসের ৫১২ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন ৪টি পাম্প দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদীতে পানি নিষ্কাশন করা হয়। অথচ পাম্পগুলোর কার্যক্ষমতা কমে গেছে। বর্তমানে এগুলো শতকরা ৬০ ভাগ পানি নিষ্কাশন করতে পারছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ২নং পাম্পটি ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও ঝুঁকি নিয়ে চালু রাখা হয়েছে। যাতে দ্রুত পানি নিষ্কাশন করা যায়। এছাড়াও ২২টি ৫ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্পের মধ্যে ১৫টি পাম্প চালু রাখা হয়েছে। তিনি আরও জানান, বর্তমানে স্বাভাবিকের চেয়ে ডিএনডির ভেতরে আড়াই ফুট পানিতে ডুবে আছে।
×