ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

তুফফাহুল জান্নাত মারিয়া

অভিমানের জল

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ২৭ জুলাই ২০১৭

অভিমানের জল

বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি হচ্ছে, ঠিক যেন স্বচ্ছ মুক্তোর দানা। মেয়েটা জানালার গ্রীল ধরে উদাস দৃষ্টি মেলে বাইরে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার ইচ্ছে করছে এক্ষুনি বাড়ি চলে যেতে, বাড়ি গিয়ে দলবেঁধে নদীতে ঝাপাঝাপি করতে। এখন বাড়ি থাকলে হয়ত ওরা দলবেঁধে শালুক কুড়িয়ে সেদ্ধ করত তারপর এক এক করে আয়েশ করে খেত। সেদ্ধ শালুকের কেমন একটা তিতকুটে স্বাদ, তবুও ভালো লাগে। মেয়েটার চোখ ফেটে জল আসতে চায় কষ্টের জল, অভিমানের জল। ঘরের চার দেয়ালে বন্দী এক পাখি যেন। প্রতিদিন তাকে ঘরের বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাওয়া হয়। তার মালিকের বক্তব্য ‘কাজের মেয়েকে বিশ্বাস আছে নাকি?’ ভদ্রমহিলা পান থেকে চুন খসলে মেয়েটার চামড়া খসানোর ব্যবস্থা করেন। নিজের ভেতরে একটা প্রাণ ঠিকই যত্ম করে লালন করছেন কিন্তু পেটের দায়ে যে তার বাড়িতে এসেছে তার বিন্দুমাত্র ভুলে খেসারত দিতে হয় তিলে তিলে। শোন ভদ্রলোক, যে অপরিচ্ছন্ন শরীর দেখে তুমি নাক সিটকাও, জেনে নিয়ো সেই অপরিচ্ছন্নতার আড়ালে ওদের একটা হৃদয় আছে সেই হৃদয় তোমার চেয়ে পরিচ্ছন্ন। সেই হৃদয়ে ওরা গোপনে ছোট ভাইকে লাল জামা কিনে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে, অসুস্থ বাবার ওষুধ কেনার টাকা জমায়, মায়ের জন্য অল্প দামী চুড়ি কেনে। অথচ বিনিময়ে তুমি দিয়েছো ইস্ত্রির সেঁক, জুতোর বাড়ি, কঠিন হাতের থাপ্পড়। ভদ্রলোক, এসির হাওয়া খেতে খেতে বিবেকটাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ো না, কে জানে সেই মিলিয়ে যাওয়া বিবেকের জন্য এক সময় আফসোস হতেও পারে। চোখ বন্ধ করে একবার ভেবো, যে মেয়ে নিজের বাড়িতে একা থাকতে ভীষণ ভয় পেত, আজ সে গুটিসুটি হয়ে স্যাঁতস্যাঁতে ফ্লোরে একা একা ঘুমায়। তুমি জানতেও চাওনি কত রাত নির্ঘুম কেটেছে, কতবার ভেবেছে এই বুঝি কেউ পা টেনে ধরল! একটু স্নেহের পরশ পেতে কতবার নীরবে চোখের জল ফেলেছে, তুমি জানো না। পাশের বাসার কাজের মেয়েটা প্রায়ই আমাদের বাসায় এসে বসে থাকত। মাকে দেখতাম এটা ওটা দিত মেয়েটাকে। মধ্যবিত্ত পরিবারের আমরা, খুব বেশি সামর্থ্য নেই কিন্তু বিনা সামর্থ্যে যেটা দেওয়া যায় সেটা স্নেহ, ভালোবাসা। অথচ বিনা সামর্থ্যরে এই জিনিসটা দিতেই আমাদের সবচেয়ে বেশি কার্পণ্য। তাদের বাসার মালিক যেদিন বাসা পরিবর্তন করল আর সাথে মেয়েটাকেও নিয়ে গেল আমার মায়ের সে কী হাউমাউ করে কান্না! সাথে মেয়েও কাঁদে। আমরা দুই বোন যখন বাসা থেকে হলে চলে আসি তখন আমার মায়ের সেই কান্নার সাথে ঐ মেয়েটার জন্য কান্নার পার্থক্য খুঁজে পাইনি। মেয়েটা সবার কাছে নিছক কাজের বুয়া হতে পারে, কিন্তু সবার আগে সে একজন মানুষ, পেটের দায়ে পড়া অসহায় মানুষ। অসহায় মানুষের প্রতি মমত্ববোধ কেবল কাগজে কলমে স্থান না পাক। সেই মমত্ববোধ হৃদয়ের ভেতরে স্থান পাক অন্তত নিজের বিবেকের কাছে স্বচ্ছ থাকার জন্য হলেও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
×