ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পুরস্কারের চলচ্চিত্র

প্রকাশিত: ০৩:৩৫, ২৭ জুলাই ২০১৭

পুরস্কারের চলচ্চিত্র

কবে প্রেক্ষাগৃহে বসে সিনেমা উপভোগ করেছেন, এমনটা আর হয়ত মনেও আসে না বয়সীজনের। আর তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশই চেনে না বা জানে না প্রেক্ষাগৃহ কী জিনিস। পরিবর্তনের ধারায় কত কি যে হারায়! মর্নিং শো, ম্যাটিনি শো, ইভিনিং শো, নাইট শো- শব্দগুলো বেশ উচ্চারিত বিশ শতকের আশির দশকেও। তারপর কোথায় মিলিয়ে গেল সেই শব্দগুচ্ছ। ছিল যা বাঙালীর বিনোদনের অন্যতম মাধ্যমটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বেশ রমরমা অবস্থান নিয়ে বিশ শতকের বিশ্বজুড়ে মানুষের বিনোদনের, শিক্ষার ও সংস্কৃতির বিকাশে সিনেমা তথা বায়স্কোপ বা চলচ্চিত্র একচ্ছত্র অবস্থান নিয়ে সগর্বে সদর্পে দাঁড়িয়েছিল। বিশ্বের অন্যান্য স্থানে তার অবস্থান এখনও বলিষ্ঠ হলেও এই বাংলাদেশে তার অবস্থান রসাতলে গেছে বললে ভুল হবে না। অথচ গত শতকের শেষ দশকগুলোতে এই শিল্প ক্রমশ বিস্তৃতি লাভ করেছিল। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সামরিক জান্তা শাসকরা চলচ্চিত্র শিল্পকে নষ্ট ভ্রষ্ট জগতে পরিণত করার জন্য যাচ্ছেতাই ভাবে এর ব্যবহার করেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে চলচ্চিত্র শিল্পের উন্নয়নের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। জান্তা শাসকদের তা পছন্দ হয়নি। এমনকি তারা যেসব চলচ্চিত্রের দৃশ্যপটে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি ছিল, তা মুছে দেয়। প্রতিবাদ উঠেছিল চলচ্চিত্র দর্শকদের পক্ষ হতে। বঙ্গবন্ধুর সময় আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবও হয়েছিল এদেশে। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের বিস্তার ঘটে দ্রুত। এই আন্দোলন নান্দনিক, সৃজনশীল, বিকল্প ধারার চলচ্চিত্র দর্শন এবং নির্মাণের প্রতি তরুণ প্রজন্মকে আকর্ষণ শুধু নয়, প্রশিক্ষিত হবার সুযোগও করে দিয়েছিল। চলচ্চিত্র বিষয়ে প্রশিক্ষণের জন্য উদ্যমীদের বৃত্তি দিয়ে বিদেশেও পাঠিয়েছিলেন। সিনেমা বিষয়ক সাপ্তাহিকীর পাশাপাশি ধ্রুপদী চলচ্চিত্র বিষয়ক সাময়িকীও প্রকাশিত হতো। দেশজুড়ে প্রেক্ষাগৃহ নির্মাণে এগিয়ে এসেছিলেন বিত্তবানরা। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পৌঁছে গিয়েছিল সিনেমা। বহু স্থানে সে সময় সিনেমা দেখাকে বলা হতো, বই দেখা। এ যেন একটি গ্রন্থপাঠ এবং পাঠের সুখাস্বাদন। এই উপমহাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটিও করেছিলেন পূর্ববঙ্গের মানিকগঞ্জের বাঙালী হীরালাল সেন। অবশ্য কৃতজ্ঞতা বোধহীনতার কারণে তার নামে এদেশে কোন পুরস্কার চালু করা হয়নি। ভারতে গোড়ার দিকের নির্মাতা দাদাভাই ফালকের নামে পুরস্কার চালু রয়েছে। চলচ্চিত্রজনদের কাছে যার প্রাপ্তি সীমাহীন। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই এদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের যাত্রা ও বিকাশ। এফডিসি নির্মাণ শুধু নয়, সুস্থ ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি এগিয়ে এসেছিলেন। জনগণের কাছে দ্রুত পৌঁছে যাওয়ার বার্তা প্রদানের বড় মাধ্যম হিসেবেই চলচ্চিত্রের প্রতি তার গভীর আগ্রহ ও আকর্ষণ ছিল। ষাট দশকে এদেশে চলচ্চিত্রের পরিধি বাড়তে থাকে। পাকিস্তানী উর্দু ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলা সিনেমার টিকে থাকা সহজ ছিল না। কিন্তু তারপরও বাঙালী চলচ্চিত্র নির্মাতা ও কুশলীরা থেমে থাকেননি। অবশ্য তারা বাধ্য হয়েছিলেন উর্দু ভাষায় ছবি নির্মাণে এবং বাংলা সিনেমার উর্দু ভাষান্তরে। পাকিস্তানীরা বাংলা ছবির দর্শক না হলেও বাঙালীরা বাধ্য ছিল উর্দু ছবির দর্শক হতে। পঁয়ষট্টি সালে পাক-ভারত যুদ্ধের আগে ভারতীয় বাংলা ছবি এদেশেও প্রদর্শিত হতো। পাকিস্তান সরকার বাংলা চলচ্চিত্র নির্মাণে অর্থ লগ্নিও করত না, পৃষ্ঠপোষকতা দূরে থাক। বাঙালীকে রীতিমতো লড়াই করতে হয়েছে বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে। তাই রূপকথা, লোকগাথা নিয়ে এন্তার সিনেমা বানানো হয়েছে। বিশ শতকের শেষ দশক থেকে বিএনপি-জামায়াত জোটের বিদ্বেষী মনোভাবের কারণে চলচ্চিত্র পথ হারায়। অশ্লীলতায় আকীর্ণ সিনেমা নির্মিত হতে থাকলে দর্শক প্রেক্ষাগৃহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সেই করুণ দশা থেকে খুব একটা উত্তরণ ঘটেনি। শেখ হাসিনার সরকার চলচ্চিত্রকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিলেও বাস্তবতায় তা সেই অবস্থানে যেতে পারেনি। দেশে প্রেক্ষাগৃহ এখন হাতেগোনা। বছরে দু’একটা ভাল সিনেমা নির্মিত হয়। চলচ্চিত্রের এই করুণ ও ভগ্ন দশার মধ্যেও সরকার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রদান করে যাচ্ছে। কিন্তু পুরস্কার নিয়ে প্রশ্ন ওঠে প্রায় সময়ই। এমনও হয়েছে যে, জুরি বোর্ডের সদস্য নিজস্ব নির্মিত চলচ্চিত্রকে নানা শাখায় পুরস্কৃত করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুরস্কারের ব্যাপারে প্রভাবিত করার চেষ্টা বন্ধের আহ্বানও জানিয়েছেন। গণমাধ্যমের এক বিশাল দিগন্ত চলচ্চিত্র শিল্প বিকশিত হোক, গণমানুষের আশা আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটুকÑ সেটাই হবে বাস্তবসম্মত এবং সবার কাম্য।
×