ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আল জাজিরা ॥ স্বাধীন কণ্ঠনাকি প্রচারের বাহন

প্রকাশিত: ০৭:২৪, ২৬ জুলাই ২০১৭

আল জাজিরা ॥ স্বাধীন কণ্ঠনাকি প্রচারের বাহন

আল জাজিরা উপসাগরের ক্ষুদে ধনাঢ্য রাষ্ট্র কাতারে অবস্থিত। এই কাতারের ওপর ক্ষেপে গিয়েই আল জাজিরার ওপর খড়গহস্ত হয়েছে সৌদি আরব। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে আমিরাত, বাহরাইন ও মিসর। এরা সবাই দেশটির ওপর কঠোর অবরোধ দিয়েছে। এদের চোখে কাতারের অপরাধ অসংখ্য। ইরানের সঙ্গে কাতারের বন্ধুত্ব আছে। কাতার এমন বহু লোককে আশ্রয় দিয়েছে যাদের সৌদি আরব পছন্দ করে না। এদের মধ্যে আছে আল কায়েদা ও মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে যুক্ত লোকজন মধ্যপ্রাচ্যে পরিহাসের শেষ নেই। সৌদি আরবের কথাই ধরা যাক। সেখানে মহিলাদের গাড়ি চালানোর অধিকার নেই। পুরুষ অভিভাবকের লিখিত অনুমতি ছাড়া তারা দেশের বাইরে যেতে পারে না। বোরখা না পরে প্রকাশ্যে হাজির হতে পারে না। সেই সৌদি আরবই আবার জাতিসংঘের নারী অধিকার কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়। সে দেশটিতে রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশ থেকে শুরু করে অনেক কিছুর ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। যেখানে গণতন্ত্রপন্থী ব্লগার রাইফ বাদাবিকে হাজার ঘা বেত্রদ- ও ১০ বছর কারাদ- দেয়া হয়েছে সেই দেশের রাজতন্ত্র এখন আরব বিশ্বের একমাত্র বড় ও স্বাধীন সম্প্রচার কেন্দ্র ‘আল জাজিরা’কে বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা করছে। স্বাধীন মত প্রকাশের ওপর এ এক মারাত্মক আঘাত। চীন যদি ব্রিটেনকে বলে বিবিসি বন্ধ করে দাও তাহলে ব্যাপারটা যা দাঁড়ায় এও অনেকটা তেমনি। আল জাজিরা উপসাগরের ক্ষুদে ধনাঢ্য রাষ্ট্র কাতারে অবস্থিত। এই কাতারের ওপর ক্ষেপে গিয়েই আল জাজিরার ওপর খড়গহস্ত হয়েছে সৌদি আরব। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে আমিরাত, বাহরাইন ও মিসর। এরা সবাই দেশটির ওপর কঠোর অবরোধ দিয়েছে। এদের চোখে কাতারের অপরাধ অসংখ্য। ইরানের সঙ্গে কাতারের বন্ধুত্ব আছে। কাতার এমন বহু লোককে আশ্রয় দিয়েছে যাদের সৌদি আরব পছন্দ করে না। এদের মধ্যে আছে আল কায়েদা ও মুসলিম ব্রাদারহুডের সঙ্গে যুক্ত লোকজন। সর্বশেষ ঘটনা হলো, সৌদি আরব ও অন্যরা শর্ত দিয়েছে যে কাতার আল জাজিরা বন্ধ করাসহ ১২টি শর্ত পূরণ করলে অবরোধ তুলে নেয়া হবে। এখন কথা হলো আল জাজিরার ওপর এরা সবাই ক্ষেপল কেন? সে উত্তর পাওয়ার জন্য একটু পেছনের দিকে যাওয়া যাক। সৌদি অসহিষ্ণুতা না থাকলে কিন্তু আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই সংবাদ চ্যানেলটির আবির্ভাব হয়ত কখনই ঘটত না। একদম গোড়ার দিকে কাতারের অর্থায়নে গঠিত এই চ্যানেলটি ভাল স্টাফ পেতে বেশ বেগ পাচ্ছিল। ঠিক সে সময় সৌদি আরব বিবিসির অতি বস্তুনিষ্ঠ আরবী ভাষার চ্যানেলটিকে সৌদি স্যাটেলাইটের সংযোগ বন্ধ করে দেয়। ফলে চ্যানেলটি বন্ধ হয়ে যায়। চ্যানেলের কয়েক ডজন সাংবাদিক সহসা বেকার হয়ে পড়েন। তারা চাকরির সন্ধান করতে থাকেন। আল জাজিরা তাদের নিয়ে নেয়। ১৯৯৬ সালে সংবাদ চ্যানেলটি আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হলে এই সাংবাদিকরাই সংবাদ সম্প্রচার করতে থাকে এবং এক্ষেত্রে তারা বিবিসির মান অনুসরণ করে চলেন। অচিরেই আল জাজিরা এক স্বাধীন, বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যম হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়। এর রিপোর্টিং, উত্তপ্ত ও প্রাণবন্ত বিতর্ক, সকলের মত প্রকাশ করার সুযোগ একাংশিত হয় এবং জনপ্রিয়তা পায়। আরব বিশ্বের স্বৈরাচারী শাসক বিরোধীদের সংবাদ পরিবেশনায়ও কোন ছাড় দেয়া হয় না। শুধু রেহাই দেয়া হয় কাতারীদের। ইসলামপন্থী, বিরুদ্ধবাদী প্যান আরব জাতীয়তাবাদী সবাই এখানে প্লাটফর্ম পেয়ে যায়। বস্তুতপক্ষে চ্যানেলটি হয়ে দাঁড়ায় ‘কণ্ঠহীনদের কণ্ঠস্বর।’ চ্যানেলটি এ অঞ্চলের শাসক শ্রেণীর বিরক্তি ও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে একটা না একটা সময় এ অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি দেশ থেকে এটি বিতাড়িত হয়েছে। কিন্তু স্টেশনটি চরমপন্থী বক্তব্যকেও প্রশ্রয় দিয়েছে ও প্রচার করেছে। এটি লাদেনের বার্তা প্রচার করেছে এবং ইসলামী তাত্ত্বিক ইউসুফ আর কুরাদাবির নিজস্ব টকশোতে সহিংসতার পক্ষে কথা বলার সুযোগ দিয়েছে। বৈরুতে আল জাজিরার ব্যুরোর প্রধান একবার সাজাপ্রাপ্ত এক জঙ্গীর জন্মদিনের অন এয়ার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন। ২০১১ সালের আরব বসন্তের সময় আল জাজিরা প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছিল। গণঅভ্যুত্থানের খবর এই চ্যানেলে যেভাবে পরিবেশিত হয়েছিল তা আন্দোলনে মোড় পরিবর্তন ঘটিয়ে দেয়। এর রিপোর্টাররা অকুস্থল থেকে বিক্ষোভের সচিত্র সংবাদ পরিবেশন করেন। চ্যানেলটি বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী ও পর্যবেক্ষকদের তথ্যের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়ায়। মিসরে গণঅভ্যুত্থানের সময় আল জাজিরার ওয়েব ট্রাফিক আড়াই হাজার গুণ বেড়ে যায়। তাহ্রীর স্কোয়ারে বিক্ষোভকারীদের কণ্ঠে সেøাগান ওঠে। ‘আল জাজিরা জিন্দাবাদ।’ বলা বাহুল্য, আল জাজিরার এই ভূমিকা প্রতিবেশী দেশগুলো সুনজরে দেখেনি। তারা আশঙ্কা করে যে এই অভ্যুত্থান উপসাগরের দেশগুলোতেও ছড়াতে পারে। অভ্যুত্থানের পরিণতিতে মিসরে ক্ষমতায় আসে মুসলিম ব্রাদারহুড। উপসাগরীয় শাসকরা আরও শঙ্কিত বোধ করে অনেকে এই প্রচার মাধ্যমটিকে কাতারের পররাষ্ট্র দফতরের স্বাার্থের বাহক হিসেবে দেখে। গত এপ্রিলে ইয়েমেনে ১২ জন সৌদি সৈন্য নিহত হলে আল জাজিরা তাদের ‘শহীদ’ বলে উল্লেখ না করায় রিয়াদ ক্ষেপে যায়। ইয়েমেনের লড়াইয়ে সৌদি নতৃত্বাধন কোয়ালিশন থেকে কাতার বহিষ্কৃত হওয়ার পর থেকে এই যুদ্ধের ওপর আল হাজিরার সংবাদ পরিবেশনা উত্তরোত্তর সমালোচনাধর্মী হয়ে উঠে। এখন আল জাজিরাকে বন্ধ করে দেয়ার জন্য কাতারের ওপর চাপ বাড়ছে। সংবাদ প্রতিষ্ঠানটি হয়ত শেষ পর্যন্ত টিকে যাবে তবে এর সুর নরম করতে হবে। চলমান ডেস্ক সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×