ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

টাঙ্গাইলে কমছে পানি, বাড়ছে ভাঙ্গন

প্রকাশিত: ০৬:২৭, ২৬ জুলাই ২০১৭

টাঙ্গাইলে কমছে পানি, বাড়ছে ভাঙ্গন

নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল, ২৫ জুলাই ॥ সদর, ভূঞাপুর, মির্জাপুর, কালিহাতী, দেলদুয়ার, গোপালপুর ও নাগরপুর উপজেলায় যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীর পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনার ভূঞাপুর স্লুইসগেট পয়েন্টে বিপদসীমার ৩০ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার সাতটি উপজেলায় ভয়াবহ ভাঙ্গনে শত শত বাড়িঘরসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদ্রাসা যমুনা, ধলেশ্বরী ও স্থানীয় নদীগুলোর পেটে চলে যাওয়ায় নদীপাড়ের মানুষের কপাল পুড়ছে। সেই সঙ্গে এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগবালাই, বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব। গত তিনদিনের ভাঙ্গনে সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের চরপৌলি এলাকার দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, একটি মসজিদ ও একটি মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং দুই শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এছাড়া মাহমুদনগর ও কাতুলী ইউনিয়নেও নদীভাঙ্গনের কারণে সর্বস্বান্ত হয়েছে শতাধিক পরিবার। আর ওইসব পরিবারের লোকজন আশ্রয় নিয়েছে অন্যের বাড়িতে। তবুও যেন যমুনার করালগ্রাস তাদের পিছু ছাড়ছে না। তাদের আশ্রয়স্থল সেই বাড়িগুলোও এখন হুমকির মুখে। এ কারণে অনেকেই আগে থেকে তাদের বাড়িঘর, আসবাবপত্রসহ জীবিকার একমাত্র অবলম্বন তাঁতশিল্পের যন্ত্রপাতি সরিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ভূঞাপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্র জানায়, অর্জুনা ইউনিয়নে ৬০৫ ও গাবসারা ইউনিয়নে ৬৬৯ পরিবারের বসতভিটা ভাঙ্গনে যমুনার পেটে চলে গেছে। এছাড়া বন্যায় অর্জুনা ইউনিয়নে ৩ হাজার ৪৫২ পরিবার, গাবসারা ইউনিয়নে পাঁচ হাজার ২০০ পরিবার, নিকরাইল ইউনিয়নে প্রায় ৪ হাজার পরিবার ও গোবিন্দাসী ইউনিয়নের এক হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভাঙ্গনে ও বন্যায় ক্ষতিগস্ত পরিবারগুলোতে দেখা দিয়েছে নানা রোগবালাই। প্রায় প্রতিটি পরিবারেই সর্দি, জ্বর, আমাশয়সহ পানিবাহিত রোগ দেখা দিয়েছে। কালিহাতী উপজেলায় গোহালিয়াবাড়ী, সল্লা ও দশকিয়া এ তিনটি ইউনিয়নে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মির্জাপুর উপজেলার বহুরিয়া ও ফতেহপুরসহ এবারের বন্যা ও নদীভাঙ্গনে জেলার ১২ উপজেলার মধ্যে সাতটি উপজেলার ২৯টি ইউনিয়নের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের তালিকা করা হচ্ছে। তালিকা করণের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়নি বিধায় তা প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে না। বাসস্থান, খাদ্য, ওষুধ ও পানীয় জলের অভাবে ওইসব এলাকার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। অসহায় পরিবারগুলোর সাহায্যে সরকারী-বেসরকারী কোন প্রতিষ্ঠান এখনও এগিয়ে আসেনি। টাঙ্গাইল সদর উপজেলার ভাঙ্গনকবলিত এলাকায় দেখা যায়, মালামাল সরিয়ে নেয়ার জন্য ভাল কোন রাস্তা না থাকায় নদীপথে নৌকা নিয়ে ছুটছেন পরবর্তী বাসস্থানের খোঁজে। আবার কেউ কেউ বাড়িঘর ও আসবাবপত্র রেখে দিয়েছেন দূরে কোথাও অন্যের বাড়িতে কিংবা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে। কাকুয়া ইউনিয়নের চরপৌলী এলাকার স্বামী পরিত্যক্ত আখলিমা। গত বছর তার শেষ সম্বলটুকু যমুনার পেটে চলে যায়। সেই সঙ্গে তার কপালটাই পুড়তে শুরু করে। পরে তিনি আশ্রয় নেয় জয়নাল আবেদিন নামে এক তাঁত মালিকের বাড়িতে। কিন্তু গত কয়েকদিনের করাল থাবায় জয়নাল আবেদিনের বাড়িটিও হুমকির মুখে। ফলে বাড়ির মালিক সবকিছু ভেঙ্গে প্রায় দুই কিলোমিটর দূরে আরেক জায়গায় ঘর তৈরির কাজ শুরু করেছেন। একই এলাকার নুরুন্নাহার, বাছাতন বেগম, আম্বিয়া আক্তার জানান, গত বছর থেকে এবারের ভাঙ্গনের তীব্রতা অনেক বেশি। গত তিনদিনের ভাঙ্গনে তাদের বাড়িঘর সব নদীর পেটে চলে গেছে। ইতোমধ্যেই সদর উপজেলার চরপৌলি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মিন্টু মেমোরিয়াল উচ্চ বিদ্যালয়সহ মসজিদ, মাদ্রাসা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান সিরাজ জানান, পানি কমতে থাকায় ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি অবহিত করা হয়েছে। অতিদ্রুত ভাঙ্গন ঠেকাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে। তিস্তার ভাঙ্গনে দিশেহারা রাজুমোস্তাফিজ, কুড়িগ্রাম থেকে জানান, তিস্তা নদীর ব্যাপক ভাঙ্গনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে ভাঙ্গনকবলিত মানুষরা। পানি কমে যাওয়ার পর তীব্র স্রোতে ভেঙ্গে যাচ্ছে আবাদি জমিসহ বসতবাড়ি। দু’সপ্তাহের মধ্যে ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে স্কুল, বাঁধ, রাস্তা, বাজার, মসজিদ-মন্দিরসহ অনেক স্থাপনা। ভাঙঙ্গ রোধে ব্যবস্থা না নেয়ায় ভাঙ্গনকবলিতরা এখন অসহায় হয়ে পড়েছে। তৈয়বখাঁ এলাকা ঘুরে দেখা গেল, ভাঙ্গনকবলিতদের আর্তনাদ। মঙ্গলবার সেখানে উপস্থিত থাকার সময়েই তিনটে বাড়ির ভিটে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেল। টিনের ঘর সরাতে গিয়ে ফনিন্দ্রনাথ (৬৫) জানালেন, ২২ বছর এই ভিটায় ছিলাম। জমি ছিল, পুকুর ছিল, সুপারির বাগান ছিল। সবই এখন নদীতে। এখন নিজের থাকার জায়গা নেই। পাশর্^বর্তী গোপাল অধিকারীর বাড়ির খোলা মাঠে আশ্রয় নিয়েছি। কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের তৈয়বখাঁ মৌজাটি এখন হারিয়ে যাচ্ছে তিস্তা নদী। চলতি মাসে আড়াইশ’ বসতবাড়িসহ, তৈয়বখাঁ বাজার, স্কুল, মসজিদ, মাদ্রাসা, মন্দিরসহ পুকুর, সুপারি বাগান চলে গেছে নদীগর্ভে। তৈয়বখাঁর সোমনারায়ণ এলাকার মালেকা (৫২) জানান, এক এক করে চারবার বাড়ি ভাঙতে হয়েছে। পরবর্তীতে এক শতক জমিতে বাড়ি করলেও তাও দু’দিন হয় নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেল। যাওয়ার আর জায়গা নেই। মানুষের আশ্রয়ে থাকতে হবে এখন। নদী ভাঙ্গা এলাকার মানুষ রিলিফ চায় না। চায় শুধু একটু কাজ আর নদীশাসন।
×