ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা মোট আসনের চেয়ে কম

এবার পাবলিক ভার্সিটি ও সরকারী মেডিক্যালে ভর্তি নিয়ে উদ্বেগ নেই

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৬ জুলাই ২০১৭

এবার পাবলিক ভার্সিটি ও সরকারী মেডিক্যালে ভর্তি নিয়ে উদ্বেগ নেই

বিভাষ বাড়ৈ ॥ ২০১৫ সালের এসএসসি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ স্কোর জিপিএ-৫ পাওয়া প্রায় ৭৩ হাজার শিক্ষার্থী এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় এসে তাদের জিপিএ-৫ হারিয়েছে! এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়া এক লাখ ১১ হাজার ৯০১ মেধাবী শিক্ষার্থীর মধ্যে এইচএসসিতে সেই স্কোর ধরে রাখতে পেরেছে মাত্র ৩৭ হাজার ৯৬৯ জন। বাকিরা হারিয়েছে তাদের জিপিএ-৫। তবে উচ্চ মাধ্যমিকে হঠাৎ জিপিএ-৫ শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র ৩৭ হাজার ৯৬৯ জনে নেমে আসায় দেশের সবচেয়ে কাক্সিক্ষত উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে ভর্তির পথ খুলেছে সর্বোচ্চ মেধাবীদের। অন্যান্য বছর লক্ষাধিক শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পাওয়ায় আসন দিতে ব্যর্থ হয়েছে কাক্সিক্ষত প্রতিষ্ঠান দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলো। ‘জিপিএ-৫ পেয়েও ভর্তি হতে পারবেন না পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যালে’ ভালমানের প্রতিষ্ঠানে আসন সঙ্কটের মাঝে লক্ষাধিক জিপিএ-৫ পাওয়ার কারণে প্রতিবছরই উদ্বেগে থাকতে হয়েছে সর্বোচ্চ মেধাবী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের। কিন্তু এবার জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীদের সংখ্যা মোট আসনের চেয়ে কম হওয়ায় আগের উদ্বেগ কেটে গেছে। অন্তত এবার জিপিএ-৫ পাওয়াদের আসনও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারী মেডিক্যালে নেই- এমন খবরে উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হচ্ছে না কাউকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদসহ সংশ্লিষ্টরা আগেই বলে দিয়েছেন, বাংলাদেশ এক্সামিনেশন ডেভেলপমেন্ট ইউনিট বা বেদুর নতুন কঠোর খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতির কারণেই এবারের এসএসসির মতো এইচএসসিতেও পরীক্ষায় পাসের হার কমার সঙ্গে কমেছে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যাও। কঠোর ও যথাযথ খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতির ফলে অব্যাহত সাফল্যে বড় ধরনের ছেদ পড়েছে। ২০০৩ সালে গ্রেডিং পদ্ধতি চালুর পর প্রায় প্রতিবছরই পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। এক বছরের ব্যবধানেই পাসের হার প্রায় ৬ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৬৮ দশমিক ৯১ শতাংশে। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৩৭ হাজার ৯৬৯ জন, যা গতবারের চেয়ে ২০ হাজার ৩০৭ জন কম। বেড়েছে শতভাগ ফেল করা প্রতিষ্ঠান, কমেছে শতভাগ পাস করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও। জানা গেছে, ২০১৫ শিক্ষাবর্ষে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ২৬৬ জন। এর মধ্যে পাস করে ১২ লাখ ৮২ হাজার ৬১৮ শিক্ষার্থী। জিপিএ-৫ পায় এক লাখ ১১ হাজার ৯০১ জন। এবার তাদের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেছে ৮ লাখ ১ হাজার ৭১১ শিক্ষার্থী। সারাদেশে জিপিএ-৫ (গ্রেড পয়েন্ট এভারেজ) পেয়েছে ৩৭ হাজার ৯৬৯ জন। গত বছরের উচ্চ মাধ্যমিক থেকেও এবার জিপিএ-৫ কম পেয়েছে প্রায় ২১ হাজার। আর এই সংখ্যাটাই শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় উচ্চ শিক্ষাঙ্গনে ভর্তির উদ্বেগ বেশ খানিকটা কমিয়ে দিয়েছে বলে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে উচ্চশিক্ষা স্তরে সরকারী-বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিক্যাল-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির জন্য এইচএসসি উত্তীর্ণদের আসন সঙ্কট হবে না বলে আগেই জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে উচ্চশিক্ষায় আসন ১০ লাখের বেশি। এর মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারী-বেসরকারী সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেই আসন ছয় লাখ ৩৬ হাজারের মতো। জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের অধিকাংশের পছন্দের তালিকায় থাকে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগরসহ বড় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), মেডিক্যালের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে। সরকারী সাধারণ (মেডিক্যাল বা বিশেষায়িতগুলো নয়) বিশ্ববিদ্যালয়েই ৩৯ হাজারের মতো আসন রয়েছে। ইউজিসির জানিয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন দুই হাজার ২০০ কলেজে রয়েছে তিন লাখ ৯৮ হাজার ৯৩০টি আসন। আর অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন প্রায় ৩৯ হাজার। আসনের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয় হাজার ৬৮৮টি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চার হাজার ৭২২টি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চার হাজার ৬৭৪টি, বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪০টি, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৭৭টি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯০টি, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হাজার ৬৫৫টি, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হাজার ২০০টি আসন রয়েছে। ৪২টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পাঁচটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থী নেই। তবে এবার স্বল্প পরিসরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি শুরু হতে পারে। এছাড়া বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে এক লাখ ৮৯ হাজার আসন। এর বাইরেও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে আসন রয়েছে। কিছু শিক্ষার্থী স্টাডির জন্য বিদেশ যায়। আবার অনেকের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য করার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ফলে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের এমন ভালমানের প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি নিয়ে আসন সঙ্কট থাকবে না বলেই বলছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। এদিকে সরকারী মেডিক্যাল কলেজগুলোতে আসন রয়েছে দুই হাজারের বেশি আসন। বুয়েটে রয়েছে এক হাজার ৩০টি। জিপিএ-৫ পাওয়া বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা মেডিক্যাল ও অন্যান্য প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে ভর্তির ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়। বাণিজ্য ও মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য বড় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। ভালমানের প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাপ হওয়ায় বাধ্য হয়েই মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের বিশাল অংশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তবে এ বছর জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরা সহজেই ভর্তি হতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এবারও হচ্ছে না ক্লাস্টার বা গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা এতদিন আশার সঞ্চার হলেও এবারও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে হচ্ছে না ক্লাস্টার বা গুচ্ছ ভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা। শিক্ষার্থীদের স্বার্থে সেশনজট কমানো ও কোচিং বাণিজ্যের দাপট সামলাতে ভর্তি পরীক্ষা কিছুটা এগিয়ে আনা সম্ভব হলেও তাদের বহু বছরের দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিক্যাল কলেজের মতো এক সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে না। শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তবে সেই উদ্যোগে সাড়া নেই বড় কোন বিশ্ববিদ্যায়ের। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষার্র্থী ও অভিভাবকদের গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষার দাবি পূরণ হচ্ছে না। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আপত্তির কারণে ভেস্তে গেছে এ প্রক্রিয়া। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সবসময়েই বলে আসছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষা গ্রহণ না করে নিজস্ব নিয়মেই পরীক্ষা নেয় তাহলে করার কিছু নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উদ্যোগ নিলে আমরা সব ধরনের সমর্থন দেব। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। আমরা তাদের জোরও করতে পারি না। কোন সিদ্ধান্ত আমরা তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারি না। সূত্রগুলো বলছে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষা নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি। বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদের নেতৃবৃন্দ বলছেন, বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের মতো করে পরীক্ষা নেয়ার পক্ষে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েট নিজেদের স্বতন্ত্র মান বজায় রাখতে চায়। একই মত দিয়েছে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ও। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিদ্যমান ভর্তি পদ্ধতিকে ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলে অভিহিত করেছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার কারণে প্রতি বছর কোচিং সেন্টারগুলো ৩২ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য করে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ভর্তি পরীক্ষার কারণে শিক্ষার্থীদের বহু টাকা ব্যয় করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের সংসদে পাস করা আইন দিয়ে পরিচালিত হয় বিধায় তাদের আমরা কিছু চাপিয়ে দিতে পারি না। বহুদিন ধরে আলোচনা হলেও গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা না হওয়ায় হতাশ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। গত বছর ব্যর্থ হলেও শিক্ষার্থীদের স্বার্থে এবার একই ধরনের প্রতিষ্ঠানে মেডিক্যাল কলেজের মতো এক সঙ্গে পরীক্ষা নেয়া হবে বলে আশা করেছিলেন তারা। ক্লাস্টার পদ্ধতি গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে সরকারকে অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়। নতুন কোন পদ্ধতি গ্রহণে আপত্তি জানিয়েছে বাকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একাডেমিক কাউন্সিল।
×