ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মাসুদা ভাট্টি

আওয়ামী লীগ ॥ সরকারী দল নয় জনগণের দল হওয়া জরুরী

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২৬ জুলাই ২০১৭

আওয়ামী লীগ ॥ সরকারী দল নয় জনগণের দল হওয়া জরুরী

সরকারের মেয়াদ শেষে সরকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে জনগণ কী চায়? এ রকম একটি প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করার সময় অনেক আগেই পার হয়ে গেছে- তবুও যে কোন সময়ই ভাল সময় এই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনার জন্য। এই প্রশ্নটি নিয়ে গুরুগম্ভীর আলোচনায় যাওয়ার আগে একটি সাধারণ প্রশ্নকে সামনে আনতে চাই। তবে প্রশ্নটি তোলার আগে তার কিছু ভূমিকাও দেয়ার প্রয়োজন। গত এক থেকে দেড় মাসের পত্র-পত্রিকা হাতে নিয়ে দেখলে আমরা দেখতে পাই যে, সরকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নিয়ে কোন ইতিবাচক সংবাদ নেই। আমরা ঢালাওভাবে এ কথা বলতে পারি যে, মিডিয়া সরকারের ভাল চায় না, কিন্তু মিডিয়া চাইলে খারাপ সংবাদ প্রকাশ করতে পারে কিন্তু মিডিয়া চাইলেই বানিয়ে বানিয়ে ভাল খবর দিতে পারে না। এটা মিডিয়ার ব্যর্থতা কিংবা সফলতা নয়, বরং এটা মিডিয়ার সীমাবদ্ধতা। হয়ত সামান্য ঘটনাকে ফুলিয়ে ফঁাঁপিয়ে দীর্ঘ করে বর্ণনা করা যায় কিন্তু কোন ইতিবাচক খবর না ঘটলে সেটাকে প্রকাশের কোন সূত্র থাকে কি? তার মানে এই যে একের পর এক নেতিবাচক সংবাদ আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রকাশিত হচ্ছে, তার সবটাই কি বানানো বা শত্রুতার জের ধরে? এমনটি ভাববার কোন কারণ নেই, মিডিয়াকর্মী হিসেবেই এ কথা বলতে পারি যে, আওয়ামী লীগের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল হয়েও অনেক সাংবাদিক/সম্পাদক আসলে বাধ্য হন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশে। হ্যাঁ, সংবাদ এড়িয়ে যাওয়া বা কিল করা হয়ত সম্ভব, কিন্তু তাতে পাঠকের সামনে সাংবাদিক/সম্পাদককে অবস্থান হারাতে হয়, সেটাও কোনভাবেই সুস্থ সাংবাদিকতা হতে পারে না। তার মানে হচ্ছে, এই মুহূর্তে দেশের মিডিয়াকে আসলে বাধ্য হয়েই আওয়ামী লীগ সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করতে হচ্ছে। কারণ, কোন ইতিবাচক ঘটনা জন্ম দিতে ব্যর্থ হচ্ছে আওয়ামী লীগ, বিশেষ করে তৃণমূল আওয়ামী লীগ। জেলা বা উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন থেকে সরকারী দল হিসেবে প্রভাব বিস্তারের যেসব ঘটনার খবর প্রতিদিন পত্রিকা/টেলিভিশন অফিসে পৌঁছাচ্ছে তার অর্ধেকও যদি প্রকাশিত হয় তাহলে বিষয়টি কারও জন্যই খুব একটা স্বস্তিদায়ক হওয়ার কথা নয়। হ্যাঁ, আমরা এ কথা বলতেই পারি যে, এরা কি প্রকৃত আওয়ামী লীগ? আসলে দ্বিতীয় যে প্রশ্নটি তুলব এতক্ষণ যে ভূমিকাটি দিলাম সেটি হলো, প্রকৃত আওয়ামী লীগ আসলে কারা? এই প্রশ্নের উত্তরে আমাদের এক বাক্যে বলতে হবে যে, শেখ হাসিনা যে আওয়ামী লীগের কথা প্রতিদিন বলেন এবং যে স্বপ্ন প্রতিদিন বাঙালীকে দেখান সেই স্বপ্ন যিনি ধারণ করেন তিনিই আসলে প্রকৃত আওয়ামী লীগার। এক্ষেত্রেও সম্ভবত একটু ব্যাখ্যার দরকার আছে। শেখ হাসিনা শুরু থেকেই একটি কথা বারবার বলেন যে, তিনি ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত একটি বাংলাদেশ গড়তে চান। এ জন্য তিনি পৃথিবীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতেও পিছপা নন। বিশ^ব্যাংকের মতো শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সংস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। অল্পের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে না পারা শক্তিশালী হিলারি ক্লিনটন ও তার এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন। এর বাইরে আরও অনেক ঘটনা আছে যা শেখ হাসিনাকে প্রায় প্রতিদিন মোকাবেলা করতে হচ্ছে প্রথমে বাংলাদেশ ও দেশের জনগণ এবং তারপর তার রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগের জন্য। শেখ হাসিনা চাইলেই কিন্তু এই যুদ্ধ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারতেন এবং তার পক্ষে এই সরিয়ে নেয়াতে ব্যক্তিগত লাভই বরং বেশি। কারণ, ইতোমধ্যেই তিনি আন্তর্জাতিকভাবে যে রাজনৈতিক সুনাম অর্জন করেছেন তাতে বাকি জীবন সে সুনামকে ভাঙ্গিয়ে বিভিন্ন সভা-সেমিনারেও যদি বক্তৃতা করে বেড়ান তাতেও তার চলে যাবে। কিন্তু তিনি তো সে পথ বেছে নেননি, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, সম্মানহানির ঝুঁকি নিয়ে তিনি লড়ে যাচ্ছেন এবং মূলত সেটি বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের মানুষের জন্যই, যার মধ্যে তার দলের সমর্থক গোষ্ঠীও রয়েছে। এখন বলুন, সবার আগে যদি তার দলের সমর্থক গোষ্ঠী বা সদস্যরাই যদি তাকে না বোঝে বা তার কাজের ভার না নেয় তাহলে তিনি কাদের দিয়ে, কার ভরসায় এতবড় ঝুঁকি নিচ্ছেন? মজার ব্যাপার হলো, সরকারী দলের সমর্থক হলে যে সব সুবিধাদি পাওয়া যায় স্বাভাবিকভাবেই সেই লোভে পড়ে দলে দলে মানুষ নিজেদের সরকারী দলের সমর্থক বলে প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে যায়। অনেক সময়ই তাদের ভিড়ে প্রকৃত সমর্থক খুঁজে বের করা দায় হয়ে পড়ে এবং পড়ছেও। কিন্তু যেসব ঘটনা ও দুর্ঘটনা জাতীয় গণমাধ্যমের নেতিবাচক শিরোনাম হিসেবে আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠিত করছে তার দায় কি কেবল এই নব্য সমর্থকদের? পুরনো ও আসল সমর্থকদের কি কোন দায় নেই? সবচেয়ে বড় কথা হলো, যদি নব্য আওয়ামী লীগাররা দোষী হয়ও তাহলে পুরনোরা কেন তাদের ঠেকাতে সমর্থ হচ্ছে না? এখানেও সেই একই কথা শুনতে হচ্ছে, তা হলো নেতৃত্ব পর্যায় থেকেই এই নব্যদের ঢালাওভাবে সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে আর প্রকৃত ও পুরনোরা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। যদি এটাই সত্য হয় তাহলে আওয়ামী লীগের জন্য যে সত্যি সত্যিই সামনে বিপদ অপেক্ষা করছে তাতে কোনই সন্দেহ নেই। আরেকটি প্রশ্ন তুলতেই হচ্ছে। সরকার একটি স্থায়ী প্রতিষ্ঠান, সেই প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব ন্যস্ত হয় রাজনৈতিক দলের ওপর, সেটি জনগণই দিয়ে থাকে। কিন্তু সরকার পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয়ও রাজনৈতিক দলকে দিতে হয়। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন ও বিচার বিভাগের মধ্যকার সম্পর্ককে একটি সুনির্দিষ্ট মাত্রায় নিয়ে যেতে না পারলে সরকার হিসেবে যে কোন রাজনৈতিক দলেরই দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক। যে প্রশ্ন এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে উঠেছে। যেমন বরিশালে একজন সরকারী কর্মকর্তাকে আদালতের নির্দেশে ঘণ্টাখানেক শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে (যদিও অনেকেই বলছেন যে, আদালত তাকে শাস্তি দেয়নি বরং তাকে অপেক্ষা কক্ষে বসিয়ে রাখা হয়েছিল) এবং পুলিশ তাকে গ্রেফতার করছে এমন দৃশ্য দিয়ে সামাজিক গণমাধ্যম ভরিয়ে ফেলা হয়েছে। সরকার দলীয় একজন স্থানীয় নেতা সেই সরকারী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে জাতির পিতার ছবি বিকৃতির অভিযোগে মামলা দায়ের করেছেন। বিষয়টি শেষাবধি একটি হাস্যকর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং মানুষ এ কথাই বলতে শুরু করেছে যে, দেশে কি আর কোন সমস্যা নেই যে একটি শিশুর আঁকা ছবিকে কেন্দ্র করে এতটা তোলপাড় শুরু হয়েছে? তবে যারা বোদ্ধা তারা কিন্তু ঠিকই বুঝতে পারছেন যে, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বের কাঁধে বন্দুক রেখে আসল খেলাটি খেলছে অন্য কেউ, যারা চাইছেন নির্বাহী ও বিচার বিভাগের মধ্যকার দ্বন্দ্বকে আরও স্পষ্ট করে তুলতে। এমনকি রাজনীতিকে কদর্য করে তুলতে ঘটনাটিকে নানা রহস্যে মুড়ে উপস্থাপনও এখন আর গোপন নেই কারও কাছে। এখন কেউ কেউ বরিশালের বিতর্কিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে ইউএনওর বিরোধকে উস্কে দিতে চাইছেন। জেলা প্রশাসকের ভূমিকাকেও রহস্যজনক বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এখন বলুন এই বরিশাল-কা-ের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ কে? এ কথা কি নির্দ্বিধায় বলা যায় না যে, সরকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগই এই ঘটনার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষ? আমার মনে হয়, রাজনীতিতে এ রকম তুচ্ছ ঘটনাই শেষাবধি একটি বিশাল ইস্যু হয়ে ওঠে বা উঠতে পারে। অপরদিকে দেশে এ যাবতকালে পুলিশের হাতে সাধারণ নাগরিকের যতগুলো মার খাওয়ার ঘটনা ঘটেছে তাতে সবার আগে আঙ্গুল উঠেছে সরকারের দিকেই। কারণ, পুলিশ সরাসরি সরকারের অংশ। প্রতিনিয়ত সাধারণ জনগণের সঙ্গে এই বাহিনীর যোগাযোগ হয়, ফলে তাদের কোন ঘটনাই জনমনে একাধারে প্রশ্ন তৈরি করে, অনাস্থা তৈরি করে এবং অন্তে সরকারের সঙ্গে জনগণের দূরত্ব তৈরিতে কাজ করে। বাংলাদেশের পুলিশের ভাল কোন কাজ নেই এ কথা সরকারের চরম শত্রুও বলতে পারবে না কিন্তু প্রতিবাদ দমনের নামে যখন পুলিশ নির্মম হয়ে ওঠে তখন সেটাই হয়ে ওঠে জনগণের সামনে সবচেয়ে বড় ইস্যু। কারণ, নিরাপত্তার নামে নির্যাতন কখনও কার্যকর ব্যবস্থা হতে পারে না, হওয়া উচিত নয়। শুরুতেই প্রশ্ন তুলেছিলাম, আওয়ামী লীগের কাছে জনগণ কী চায়? যেহেতু দলটি এখন সরকার পরিচালনা করছে সেহেতু আওয়ামী লীগকে সরকারী দল বলা হয়, তাই জনগণের সব চাওয়া মূলত আওয়ামী লীগের কাছেই। জনগণ উন্নয়ন চায়, জনগণ নিরাপত্তা চায়, জনগণ স্থিতিশীলতা চায়Ñ বলা বাহুল্য, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার এই চাওয়া পূরণে এখনও পর্যন্ত পথচ্যুত হয়েছে প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই এগিয়ে আসছে ততই লক্ষ্য করা যাচ্ছে এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বিশেষ করে সরকারী দল তথা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে, যে অস্থিরতা ক্রমাগত নেতিবাচক সংবাদ শিরোনামের জন্ম দিচ্ছে। আগেই বলেছি, এটি সুবিধাজনক লক্ষণ নয়, কারণ বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে রাজনৈতিক দুর্ঘটনা হঠাৎ করেই তুচ্ছ ঘটনা থেকেই ঘটে থাকে। উদাহরণ দিয়ে লেখাটি দীর্ঘ করতে চাইনে। তবে এ কথা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই যে, নির্বাচনকে সামনে রেখে যখন আওয়ামী লীগের ‘সরকারী দল’-এর তকমা খসিয়ে সম্পূর্ণভাবে ‘জনগণের দল’ হওয়ার কথা তখন কোন এক অদৃশ্য শক্তি মাঠে নেমেছে দলটিকে জনবিচ্ছিন্ন করার কাজে আর এর মূল লক্ষ্য যে শেখ হাসিনাকে জনগণের সামনে বিতর্কিত করা সেটাও এখন আর গোপন নেই। আমার মনে হয় অবিলম্বে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের এই জায়গাটিতে নজর দেয়া উচিত, কারণ প্রতিটি জরিপই বলছে, জনগণ এখনও আওয়ামী লীগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়নি, আর এই ভরসার জায়গাটিকে কোনভাবেই নষ্ট হতে দেয়া ঠিক হবে না। ঢাকা ॥ ২৩ জুলাই, রবিবার ২০১৭ [email protected]
×