ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আমিনুল ইসলাম মিলন

অভিমত ॥ জঙ্গীবাদ ও বাংলাদেশের সফলতা

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ২৬ জুলাই ২০১৭

অভিমত ॥ জঙ্গীবাদ ও বাংলাদেশের সফলতা

বাঙালীরা ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। ধর্মভীরুতা ধর্মের প্রতি সম্মান-শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করে। আর ধর্মান্ধতা ধর্ম থেকে মানুষকে বিপথে পরিচালিত করে। তাই বিপথগামী মানুষ ধর্মকে পুঁজি করে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়ায়। একে বলা হয় ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ। এই ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি করে বিশ^ব্যাপী শান্তি-শৃঙ্খলাকে বিনষ্ট করে চলেছে। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত দেশও জঙ্গীবাদের কালো থাবা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। জঙ্গী হামলার ঘটনা কম-বেশি অনেক দেশেই ঘটছে। আমাদের দেশেও একাধিকবার জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটেছে। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। তবে বিশে^র অন্যান্য দেশের চেয়ে বাংলাদেশে জঙ্গী হামলার ভয়াবহতা অনেক কম বলে প্রতীয়মান হয়। আমার মতে, এর কারণ দুটি। প্রথম কারণটি হলো জঙ্গী বা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের জিরো টলারেন্স। অর্থাৎ সরকার সন্ত্রাস তথা জঙ্গীবাদ দমনে কোন ধরনের ছাড় দিতে নারাজ। বলা যায়, এখন পর্যন্ত কোন ছাড় দেয়নি। দ্বিতীয় কারণটি হলো অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও বাঙালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তিমূল রচিত হওয়ায় জঙ্গীবাদ এখানে শিকড় গাড়তে পারেনি। স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠী ধর্মের নামে বারংবার এখানে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনাকে ভূ-লুণ্ঠিত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠীর মদদে কখনও জেএমবি, কখনও হরকত-উল-জিহাদ, কখনও আল কায়দা আবার কখনও আইএস (ইসলামিক এস্টেট)সহ নানাবিধ নামে জঙ্গীরা বাংলাদেশে তাদের শিকড় গাড়তে অপতৎপরতা চালায় এবং এখনও চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই অপশক্তি তাদের আস্তানা এদেশের মাটিতে গাড়তে পারেনি। তবে তারা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন সময় হামলা চালিয়েছে। গত বছর রাজধানীর গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারি নামের রেস্তরাঁয় বড় ধরনের হামলা চালায় জঙ্গীরা। জঙ্গীরা সেখানে ২০ জন নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে- যাদের ৯ জন ইতালি, ৭ জন জাপান, ৩ জন বাংলাদেশী এবং ১ জন ভারতীয় নাগরিক। এছাড়া জঙ্গীদের হামলায় দু’জন পুলিশ কর্মকর্তাও প্রাণ হারান। পরবর্তীতে কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় ওই ৬ জঙ্গী। সরকারের উচ্চমহলের ত্বরিত নির্দেশনায় সেনাবাহিনী কমান্ডোরা মাত্র আধা ঘণ্টার অভিযানে জঙ্গীদের নির্মূল করতে সক্ষম হয়। এরপর শোলাকিয়ায় ঈদের নামাজের জামাতে হামলা চালানো হয়। এখানে দুই পুলিশ সদস্য, এক নিরীহ নারী ও জঙ্গী দলের এক সদস্য নিহত হয়। এ সময় দুই জঙ্গীকে অস্ত্রসহ জীবিত ধরতে সক্ষম হয় পুলিশ। ঘটনার পরপরই এসব হামলার দায় স্বীকার করে আইএস। ইসলামিক স্টেট বা আইএস খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ইসলামের নামে নির্বিচারে এভাবে নারী শিশুসহ মানুষ হত্যা করে খেলাফত কায়েম করতে জিহাদে নেমেছে এই সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসীগোষ্ঠী। নিজের ধর্মের পাশাপাশি অন্যের ধর্মকে সম্মান করা বাঙালীর চিরাচরিত রেওয়াজ। বাংলাদেশের মানুষ কোন সময় ধর্মীয় সন্ত্রাসকে গ্রহণ করেনি। স্বাধীন বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ইসলাম হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে আছে সামাজিক হৃদ্যতাপূর্ণ সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রচিত চারটি মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই অর্থাৎ ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। ভূ-লুণ্ঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। একাত্তরের পরাজিত শক্তি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে পাল্টে দেয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপষোকতায় ধর্মীয় বিভ্রান্তি প্রবেশ করল সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ধর্ম ব্যবসায়ীরা রাষ্ট্রকে ব্যবহার করে গড়ে তোলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানে জন্ম নেয় ধর্মান্ধতার বিষবাষ্প। প্রকৃত অর্থে আজ বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের যে উত্থান তা মূলত ’৭৫-এ পরাজয়ের কারণে ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির এই বিপর্যয় ২০০১ সালের নির্বাচনে জামায়াতী অপশক্তিকে ক্ষমতায় আসতে সহায়তা করে। তাদের মিশন সফল হয়। রাজাকার আলবদরের গাড়িতে ওড়ে রাষ্ট্রীয় পতাকা। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের ৬৩ জেলায় একই সময়ে বোমা ফাটিয়ে শক্তির মহড়া দেয় জেএমবি। মিছিলে সেøাগান ছিল ‘বাংলা হবে আফগান আমরা সবাই তালেবান’। জন্ম নিল নতুন ভাই ‘বাংলা ভাই।’ উত্তরবঙ্গের শাসন ভার ন্যস্ত হলো বাংলা ভাই গংয়ের হাতে। শুরু করল গাছে টানিয়ে মানুষ হত্যাসহ নানান বর্বরতা। বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমান থেকে শুরু করে মুুফতি হান্নানÑসবাই স্বাধীনতাবিরোধী এবং পরবর্তীকালে এই অপশক্তির সমর্থক চক্রের সৃষ্টি। তাদের পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে আজ দেশে জঙ্গীগোষ্ঠী এত বিস্তার ঘটতে পারত না। যতটুকু তারা শিকড় গেড়েছে তা তৎকালীন ৪ দলীয় জোটের কারণে। এটা সত্য যে, জঙ্গীবাদ আজ শুধু বাংলাদেশের সমস্যা নয়, এটা আন্তর্জাতিক সমস্যায় রূপ নিয়েছে। এই সমস্যাটি সব দেশেরই রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশকে বিনষ্ট করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও চরম অবনতি ঘটছে। সারাবিশে^ অশান্তি সৃষ্টি করে চলেছে এই সন্ত্রাসী জঙ্গীগোষ্ঠী। বাংলাদেশেও অশান্তির বিষবাষ্প ছড়াতে চলেছে। জঙ্গীগোষ্ঠীর টার্গেটে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও। জঙ্গীরা কয়েকবার তাকে হত্যার চেষ্টা চালায়। স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত অপশক্তির মদদে জঙ্গীরা তাকে হত্যার চেষ্টা চালিয়েও ব্যর্থ হয়েছে। শুধু শেখ হাসিনা নন, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লেখক, কবি, মুক্তচিন্তার মানুষ ব্লগার, প্রকাশক, শিল্পী, মন্দির-গির্জার পুরোহিত, বিদেশী নাগরিক এমন কি পুলিশও জঙ্গীদের টার্গেট। গত কয়েক বছর ধরে বিচ্ছিন্নভাবে দেশের নানা স্থানে মুুক্তচিন্তার মানুষদের হত্যা করেছে। ২০১৪ সালে নির্বাচনের ট্রেন মিস করে তা-ব চালিয়ে মানুষ পুড়িয়ে ব্যর্থ হয়ে দিশাহারা ধর্মীয় তল্পিবাহকরা গণতন্ত্রের সঙ্কটের দোহাই দিয়ে নতুন জঙ্গীবাদের মাতম শুরু করে। রাষ্ট্রকে ব্যর্থ করার জন্য নতুন চক্রান্ত করে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমদানি করে আইএসের নাম। প্রচুর অর্থের বিনিময়ে হলি আর্টিজানের মতো সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটিয়ে সারাদেশে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। সরকারের দূরদর্শিতা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাহসী অভিযানে এবং জনগণের সমর্থনে জঙ্গীবাদ নির্মূল হতে চলেছে। সারা বিশ্বের নিকট জঙ্গীবাদ দমনে বাংলাদেশের সফলতা এখন রোল মডেল। বাংলাদেশ ভূ-পৃষ্ঠগতভাবেও জঙ্গীবাদের উপযুক্ত স্থান নয়। কেননা বাংলাদেশ সমতল ভূমির দেশ, তিন দিকে ভারত একদিকে বঙ্গোপসাগর। ভারত নিজের স্বার্থেই ধর্মীয় জঙ্গীবাদকে পৃষ্ঠপোষকতা করবে না। আর যেটুকু পাহাড়ী অঞ্চল সেখানে ভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় লোকের সহাবস্থান। সেহেতু মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশ কখনও জঙ্গীবাদের স্থান হবে না বা জঙ্গীবাদ প্রশ্রয় দেবে না। লেখক : সাহিত্যিক
×