ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিলু শামস

পুলিশ জনগণের বন্ধু?

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২৬ জুলাই ২০১৭

পুলিশ জনগণের বন্ধু?

শাহবাগে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা এবং এক শিক্ষার্থীকে গুরুতর আহত করার মধ্য দিয়ে পুলিশ তার ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতারর স্বরূপটি আবার প্রকাশ করল। যদিও এ ধরনের ঘটনা নিয়মিতই ঘটছে। এর আগে সাংবাদিক, ছাত্র, শ্রমিক পেটানোসহ আদালত প্রাঙ্গণে তরুণীর শ্লীলতাহানি, আদালতের মূল ফটকে বিচারকের গায়ে হাত তুললে মানুষের মনে বিস্মিত প্রশ্ন জেগেছিল আজকের পুলিশ কি ঔপনিবেশিক পুলিশের উত্তরসূরি? শাসক ইংরেজ যাদের তৈরি করেছিল সে সময়ে তাদের আরেক উপনিবেশ আয়ারল্যান্ডের পুলিশের আদলে। নিজ দেশের পুলিশ আইন ও ব্যবস্থা থেকে ঔপনিবেশিক পুলিশ ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ আলাদা রেখেছিল। ব্রিটিশ ভারত ছেড়েছে। যুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু উপনিবেশের ভূত পুলিশের ঘাড় থেকে নামেনি। মাঝে মাঝে ঘটনার ঘনঘটায় সে কথা বিশেষভাবে মনে পড়লেও সাধারণভাবে পুলিশ তার অতীত ধারাবাহিকতা মেনেই চলছে। সমাজের দুর্বল অংশের ওপর ক্ষমতার দাপট আগেও দেখিয়েছে, দেশভাগের পরও দেখিয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশেও দেখাচ্ছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পুলিশকে জনগণের ‘সেবক’ বললেও আসলে জনগণের সেবক বা বন্ধুর ইমেজে পুলিশের ভূমিকা সব সময়ই সীমিত ছিল। ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি জনগণের সঙ্গে পুলিশের দূরত্বের সম্পর্ক প্রথম থেকেই তৈরি করেছিল। দেশ বিভাগের পর অমীমাংসিত সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য পাকিস্তানের সে সময়ের ক্ষমতাসীন দলের একক নির্ভরতা ছিল পুলিশ বাহিনীর ওপর। তারা দাপটের সঙ্গে জনগণের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে। আজও সুযোগ পেলেই পুলিশের গায়ে অতীত রক্ত টগবগিয়ে ওঠে। পাকিস্তান আমলে পুলিশ বিভাগে কর্মরত অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা একটি সাপ্তাহিকে সে সময়ে পুলিশের কর্মকা- নিয়ে লিখতে গিয়ে এক জায়গায় উল্লেখ করেছেনÑ ‘সাধারণ জনগণের প্রতি আচরণের ক্ষেত্রে পুলিশ ছিল উদ্ধত, অভদ্র ও প্রায়ই নির্যাতক। অনেকে এই বলে অভিযোগ করেন যে, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের আচরণে প্রমাণ হয় যে তাদের উর্ধতন কোন কর্তৃপক্ষ নেই, তারাই স্বাধীন নিয়ন্ত্রক এবং তারা অঞ্চলের সর্বশক্তিমান প্রভু। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় নিয়োজিত পুলিশ কর্তৃপক্ষ তাদের ক্ষমতা এমনভাবে অপব্যবহার করত যেন কারও প্রতি তাদের কোন দায়বদ্ধতা নেই। এখনকার পুলিশের ভাবমূর্তির সঙ্গে প্রায় হুবহু মিল। আজকের পুলিশের আচরণ দেখলেও এমনটাই মনে হয়। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপে ঘটনার ইতিবাচক সমাপ্তি হয়। যেমন সিদ্দিকুর রহমানের বেলায় হচ্ছে। কিন্তু এটা তার ব্যক্তিগত মহানুভবতার প্রকাশ। তথ্য মতে, দেশে এখন এক লাখ চল্লিশ হাজার পুলিশ সদস্য রয়েছে। উদ্ধৃতিতে যে সময়ের কথা বলা হয়েছে সে সময় পুলিশের সংখ্যা ছিল চৌদ্দ হাজারের কিছু বেশি। তখন জনসংখ্যার চাপও অনেক কম ছিল। এখন ষোলো কোটির বাংলাদেশ অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে টলমল। তার চেয়ে বড় কথা পুলিশ বিষয়ে রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে মৌলিক পরিবর্তন আসেনি। শাসকগোষ্ঠী সব সময় নিজেদের পেটোয়া বাহিনী হিসেবেই পুলিশকে ব্যবহার করেছে। এই ধারাবাহিক রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে সুযোগ পেলেই পুলিশ বেপরোয়া হয়। প্রচলিত শাসন পদ্ধতির প্রত্যক্ষ ফসল পুলিশ বাহিনীর কর্মকা-। ঔপনিবেশিক হ্যাংওভারে আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনীতিও কি আক্রান্ত নয়? মূল জায়গায় সমস্যা জিইয়ে রেখে অংশ বিশেষের কাছে সদাচরণ আশা করা দুরাশাই আসলে। একটি দৈনিক সম্পাদকীয়তে প্রশ্ন তুলেছেÑ তাহলে কি পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে? তাদের কাজের কি কোন জবাবদিহি করতে হয় না? ইচ্ছেমতো যাকে তাকে আসামি বানিয়ে চালান দিতে পারে? খেয়ালখুশিমতো যার-তার ওপর নির্যাতন চালাতে পারে? প্রশ্নগুলো আগে উল্লেখ করা উদ্ধৃতিরই পুনরাবৃত্তি যেন। মানে আগের ধারাবাহিকতাই চলছে। এরা একটি ছাঁচে তৈরি প্রোডাক্ট। ফ্যাক্টরিতে ছাঁচ আছে তাতে ঢুকিয়ে দিলে ওই আকারেই বেরিয়ে আসে। ভাবমূর্তি বদলাতে হলে ওই ফ্যাক্টরি এবং ছাঁচ ভাঙতে হবে। নইলে ছাঁচে যাকেই ঢুকানো হোক, সে ওই নির্দিষ্ট আকার নিয়েই বেরোবে। তবে ব্যক্তির চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যের ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করে নিশ্চয়ই। পদ্ধতির জটিলতার মধ্যে থেকেও দুয়েকজন ব্যক্তিগত সততা দিয়ে অনেক উচ্চতায় পৌঁছে যান। জনগণের ভালবাসায় সিক্ত হন। আধুনিক মনস্তাত্ত্বিক গবেষণাও একে সাপোর্ট করে। পুলিশের উচ্চ মহলের সৎ শিক্ষিত ও আধুনিক অংশ তাই প্রয়োজন অনুভব করেছে কাউন্সেলিংয়ের। কারণে অকারণে কারও সঙ্গে খারাপ আচরণ না করা, অযথা কারও গায়ে হাত না তোলা, কেউ আইন না মানলে তার বিরুদ্ধে আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া, দায়িত্ব পালনের সময় সর্বোচ্চ সংযম রাখা ইত্যাদি বিষয়ে কাউন্সেলিং চলছে পুলিশের বিভিন্ন শাখায়। এটা ভাল উদ্যোগ। পাশাপাশি খেয়াল রাখা দরকার পুলিশ যেন পার্টিজান হয়ে না যায়। প্রকাশিত এক সংবাদে জানা যায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দেশের আশি ভাগ থানায়ই পুলিশ কর্মকর্তাদের বদলি হয় তদ্বিরের মাধ্যমে। এসব কর্মকর্তার বদলি বাণিজ্য শুধু এখন হচ্ছে তা নয়, আগেও একইভাবে হয়েছে। সেজন্য থানা পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তারা জনগণের বদলে তদ্বিরকারীদের প্রতি অনুগত থাকে বেশি। নিয়োগের বেলাও এমন হয় বলে শোনা যায়। এ অবস্থা চলতে থাকলে কাউন্সেলিং করা অর্থহীন। আবারও সেই কথাই বলতে হয়, গোড়ার গলদ ঠিক করতে হবে, নইলে বিচ্ছিন্ন উদ্যোগে সামগ্রিক সুফল আসবে না।
×