ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

৫৮তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড ॥ তরুণদের সাফল্য

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২৫ জুলাই ২০১৭

৫৮তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড ॥ তরুণদের সাফল্য

ব্রাজিলের সমুদ্র উপকূলের শহর রিওতে ছোট ছোট অনেক পাহাড়-পর্বতের ছড়াছড়ি। উত্তর-দক্ষিণের শহরকে পূর্ব-পশ্চিমের ক্যারাকাও পর্বত দুই ভাগে ভাগ করেছে। ক্যারাকাওয়ের পর্বত আর জঙ্গলের কারণে রিওর তাপমাত্রা সব সময় কম থাকে। এই তীব্র ঠাণ্ডা সবাইকে কাবু করে ফেললেও আমাদের ক্ষুদে ছয় গণিত বিদকে কাবু করতে পারেনি। ৫৮তম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে আমাদের ক্ষুদে বন্ধুরা দুটি রৌপ্য ও দুটি ব্রোঞ্জ পদক নিয়ে ১১১টি দেশের মধ্যে ২৬তম স্থান লাভ করেছে। আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড হচ্ছে মাধ্যমিক স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয় এমন একটি গণিত অলিম্পিয়াড। এটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পুরনো প্রতিযোগিতা। প্রথম আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৯ সালে রোমানিয়ায়। তখন থেকে এটি প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হচ্ছে, শুধু ১৯৮০ সাল এর ব্যতিক্রম। প্রায় ৯০টি দেশ থেকে সর্বোচ্চ ছয় সদস্যের একটি করে দল আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে। যদিও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী দলকে নয়, প্রতিযোগীদের নাম্বার প্রদান করা হয়। প্রতিযোগীদের বয়স অনধিক ২০ বছর হতে হবে এবং অংশগ্রহণকারী অবশ্যই মাধ্যমিক শ্রেণীর হতে হবে। এই সকল নিয়মের মধ্যে পড়লে একজন প্রতিযোগী একাধিকবার আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করতে পারে। প্রথম আইএমও অনুষ্ঠিত হয় রোমানিয়ায় ১৯৫৯ সালে। তারপর থেকে প্রতি বছর এটি অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে, কেবল মাঝে ১৯৮০ সাল ছাড়া। ওই বছর মঙ্গোলিয়ায় অভ্যন্তরীণ গণ্ডগোলের কারণে প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি। এই প্রতিযোগিতাটি প্রথম দিকে সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের অন্তর্গত ওয়ারশ চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী পূর্ব ইউরোপের দেশসমূহ নিয়ে চালু হয়, তবে পরবর্তীতে অন্যান্য দেশও এতে অংশগ্রহণ করে থাকে। পূর্ব ইউরোপে শুরু“হওয়ার কারণে প্রারম্ভিক পর্যায়ে আইএমও ওই অঞ্চলের দেশগুলোতেই অনুষ্ঠিত হতো। ধীরে ধীরে অন্যান্য দেশ এটি আয়োজন করতে শুরু“করে। আন্তর্জাতিক অলিম্পিয়াডে ছয়টি অঙ্ক করতে হবে। এখানে প্রশ্ন ‘কমন’ পাওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। কোন ফর্মুলা দিয়ে তা করা যাবে না। বুদ্ধি দিয়েই তা সমাধান করতে হবে। প্রতি সমস্যায় ৭ পয়েন্ট থাকে। ক্যালকুলেটরের ব্যবহার নিষিদ্ধ। পরীক্ষা দু’দিন ধরে চলে। প্রথম দিনে তিনটি এবং দ্বিতীয় দিনে ৩টি করে মোট ৬টি সমস্যার সমাধান করতে হয়; প্রতিদিন সাড়ে চার ঘণ্টা করে মোট নয় ঘণ্টা সময় পাওয়া যায়। সমস্যাগুলো মাধ্যমিক স্কুল গণিতের নানা বিভাগ থেকে করা হয় যাদের মোটা দাগে জ্যামিতি, বীজগণিত, সংখ্যাতত্ত্ব এবং কম্বিনেটরিক্স ইত্যাদি বিভাগে ভাগ করা যায়। এই সমস্যাগুলো সমাধান প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের জ্ঞান দিয়ে করা গেলেও প্রচুর অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতার প্রয়োজন হয়। প্রতিযোগীদের ব্যক্তিগত নম্বরের ওপর ভিত্তি করে র‌্যাংকিং করা হয়। পদকপ্রাপ্তির জন্যে ন্যূনতম নম্বর এমনভাবে নির্ধারণ করা হয় যেন সোনা, রূপা ও ব্রোঞ্জপ্রাপ্ত ছাত্রছাত্রীর অনুপাত প্রায় ১:২:৩ হয়। যেসব প্রতিযোগী কোন পদক জয় করতে পারে না, কিন্তু কোন সমস্যায় সাত নম্বর পায় তাদের সম্মানজনক উদ্ধৃতি প্রদান করা হয়। অসাধারণ নৈপুণ্য বা চমৎকার সাধারণীকরণের জন্যে বিশেষ পুরস্কার দেওয়া হয়। এই পুরস্কার ২০০৫, ১৯৯৫ এবং ১৯৮৮ তে দেওয়া হয়েছিল, তবে ১৯৮০ পর্যন্ত এই পদকপ্রাপ্তির সংখ্যা আরও বেশি ছিল। সর্বোচ্চ পদকের সংখ্যা মোট প্রতিযোগীর অর্ধেক হবে- এই নিয়মটি মাঝে মাঝে রক্ষা করা হয় না যখন এর ফলে পদকপ্রাপ্তের সংখ্যা অর্ধেকসংখ্যক প্রতিযোগী হতে খুব বেশি এদিক-সেদিক হয়। এমন ঘটনা সর্বশেষ ঘটেছিল ২০০৬ সালে যখন ৪৯৮ জন প্রতিযোগীর মধ্যে ১৮৮ জন নইলে ২৫৩ জনকে পুরস্কৃত করতে হতো। আমাদের দেশের ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে ২০০৫ সাল থেকে অংশ নিচ্ছে আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে। ত্রয়োদশবারের মতো এবারো বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা আন্তর্জাতিক এ অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা চারটি রৌপ্য ও ১৭টি ব্রোঞ্জ পদক এবং ২৩টি সম্মানজনক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। ছয়জনের বাংলাদেশ গণিত দল নির্বাচন ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক আয়োজনে দায়িত্ব পালন করে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি। এবারের আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াড ২০১৭ এর ৫৮তম আয়োজনে আমাদের ক্ষুদে তারকারা দুটি রৌপ্যপদক, দুটি ব্রোঞ্জপদক ও দুটি সম্মানজনক স্বীকৃতি এবং ১১১ নম্বর নিয়ে ১১১টি দেশের মধ্যে ২৬তম হয়েছে বাংলাদেশ। ১ নম্বরের জন্য স্বর্ণপদক থেকে বঞ্চিত হয়েছে বাংলাদেশের আসিফ-এ-ইলাহী। ফলাফলে দেখা গেছে, বাংলাদেশের আসিফ-ই-এলাহী (এমসি কলেজ, সিলেট) ২৪ ও আহমেদ জাওয়াদ চৌধুরী (ক্যান্টনমেন্ট ইংলিশ স্কুল এ্যান্ড কলেজ, চট্টগ্রাম) ২৩ নম্বর পেয়ে রৌপ্যপদক পেয়েছে। রাহুল সাহা (ঢাকা কলেজ) ১৮ ও তামজিদ মোর্শেদ রুবাব (নটর ডেম কলেজ) ১৭ নম্বর পেয়ে পেয়েছে ব্রোঞ্জপদক। দেশের অন্য দুজন সাব্বির রহমান (নটর ডেম কলেজ) ১৫ ও এস এম নাঈমুল ইসলাম (অমৃত লাল দে মহাবিদ্যালয়, বরিশাল) ১৪ নম্বর পেয়েছে। তবে দক্ষিণ কোরিয়া ১৭০ নম্বর পেয়ে শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে। চীন ও ভিয়েতনাম রয়েছে এর পরের দুটি স্থানে। গত দুইবারের চ্যাম্পিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান চতুর্থ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ৯০ নম্বর পেয়ে ৫২ তম, শ্রীলঙ্কা ৮০ নম্বর নিয়ে ৬২তম, পাকিস্তান ৫৮ নম্বর নিয়ে ৮১তম এবং প্রথমবারের মতো অংশ নেওয়া নেপাল ১১০তম স্থান পেয়েছে। থাইল্যান্ডে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব প্রাপ্তির পর গতবার ভারতের চেয়ে ১ নম্বর কম পেয়েছিল বাংলাদেশ। এবার ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের নম্বর ২০ বেশি। তা ছাড়া মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সৌদি আরবের ওপরে বাংলাদেশের অবস্থান বজায় রয়েছে।
×