ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সিদ্দিকুরের চিকিৎসার ব্যয়ভার নেবে সরকার

প্রকাশিত: ০৬:০০, ২৫ জুলাই ২০১৭

সিদ্দিকুরের চিকিৎসার ব্যয়ভার নেবে সরকার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর শাহবাগে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় আহত সরকারী তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী সিদ্দিকুর রহমানের বাম চোখের আলো ফিরে পাওয়ায় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন চিকিৎসকরা। এদিকে সিদ্দিকুরের উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে সিদ্দিকুরের চিকিৎসার ব্যয়ভার সরকার নেবে বলে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেয়ার পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের নির্দেশে দ্রুততার সঙ্গে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ গোলাম মোস্তফা জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বৈঠকে আহত সিদ্দিকুরের চিকিৎসাসেবার ব্যয়ভার সরকার বহন করবে বলে সিদ্ধান্ত দেন। সে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ে সিদ্দিকুরকে পাঠানো হচ্ছে। এটি উপমহাদেশের মধ্যে চোখের জন্য সবচেয়ে ভাল হাসপাতাল। সিদ্দিকুরের পাসপোর্ট-ভিসার কাগজপত্র তৈরি হলেই তাকে পাঠানো হবে। তিনি জানান, সিদ্দিকুরের ডান চোখে দৃষ্টি ফিরে না পাওয়ার কথা বলা হলেও বাম চোখের বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন চিকিৎসকরা। অধ্যাপক ডাঃ গোলাম মোস্তফা আরও জানান, সিদ্দিকুর রহমানের চোখের উন্নতি হয়েছে। তার বাম চোখের ফোলা কমেছে, কর্নিয়া ঘোলা ছিল তাও পরিষ্কার হচ্ছে। কর্নিয়ার ঘোলা ভাবটা ঠিক হওয়ার পর অপারেশন করা হবে। এর আগে সোমবার সকালে সিদ্দিকের চোখের সুচিকিৎসার জন্য সংশ্লিষ্টদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ গোলাম মোস্তফার সঙ্গে ফোনে কথা বলে তিনি এ নির্দেশ দেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা পরীক্ষিৎ চৌধুরী এ তথ্য জানান। তিনি জানান, এ সময় স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম গুরুতর আহত সিদ্দিকের চোখ ভাল করতে যা যা করণীয় সেসব পদক্ষেপ নিতে অধ্যাপক ডাঃ গোলাম মোস্তফাকে নির্দেশ দেন। এ সময় তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের চেন্নাই নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে আলোচনা হয়। পরীক্ষিৎ চৌধুরী জানান, চেন্নাইয়ের একাধিক হাসপাতালের সঙ্গে সিদ্দিকের অবস্থা জানিয়ে যোগাযোগ শুরু করে চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট। পরে এ যোগাযোগ প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। সেখানকার যে হাসপাতাল আগে যোগাযোগ করবে সেখানেই সিদ্দিকুরকে পাঠানো হবে। তিনি জানান, স্বাস্থ্যমন্ত্রী সিদ্দিকের চিকিৎসার খোঁজ নিতে প্রথমদিন থেকেই ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন। অন্যদিকে সোমবার দুপুরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সিদ্দিকুরকে দেখতে চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে আসেন। এ সময় তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশেই সিদ্দিকুরকে তিনি দেখতে এসেছেন। তাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ের চিকিৎসা দেয়া হবে। প্রয়োজনে তাকে চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে পাঠানো হবে। এদিকে সিদ্দিকুরকে দেশের বাইরে পাঠানোর কথা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে তার পাসপোর্ট ও ভিসার ব্যাপারে ছুটোছুটি শুরু করেছে তার বন্ধুরা। সিদ্দিকুরের বন্ধু শাহ আলী জানান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সিদ্দিককে দেখে তাকে চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনে বিদেশ পাঠানো হবে বলার পরপরই আমরা ওর পাসপোর্টের কাগজপত্র তৈরির বিষয়ে প্রস্তুতি শুরু করেছি। ডিএমপি কমিশনারের বক্তব্য সিদ্দিকুর রহমানের চোখে কিভাবে আঘাত লেগেছে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। সোমবার বেলা ২টার দিকে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সিদ্দিকুর রহমানকে দেখতে গিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। হাসপাতালে আধাঘণ্টা সিদ্দিকুর রহমানের পাশে ছিলেন ডিএমপি কমিশনার। এ সময় তিনি সিদ্দিকুর রহমানের চিকিৎসার খোঁজখবর নেন। ডিএমপি কমিশনার জানান, সিদ্দিকুর রহমান একটি আঘাত পেয়েছেন। তারপর সংজ্ঞা হারিয়েছেন। কিভাবে আঘাত লাগল? এটা একটি বড় প্রশ্ন। অনুসন্ধান করে তদন্ত করে কারণ বের করা হবে। এখানে অন্য কোন পক্ষ থেকে স্যাবোটাজ করা হয়েছে কিনা। তা খতিয়ে দেখব। এ ঘটনায় আমরা মর্মাহত হয়েছি। আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, আমি সিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছি। তার আহত চোখ দেখেছি। একটি টিয়ারশেল বা একটি ঢিলের আঘাতে একইসঙ্গে দুই চোখে আঘাত লাগতে পারে না। যদি একটি আঘাত লেগে থাকে। তাহলে নাক বা কপাল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু তার নাক বা কপালে কোন আঘাত নেই। সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে ডিএমপি কমিশনার জানান, ঘটনা যাই হোক, সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক, দুর্ভাগ্যজনক ও অনভিপ্রেত। বিষয়টি নিয়ে আমরা মর্মাহত। ঘটনা তদন্তে ইতোমধ্যে আমরা একটি কমিটি গঠন করেছি। অনলাইন, সোশ্যাল মিডিয়া-সংশ্লিষ্ট তথ্য জোগাড় করা হয়েছে। সিসিটিভির ফুটেজ, ভিডিও ফুটেজগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। তদন্তে পুলিশের যদি কোন গাফিলতি থাকে, অতিরিক্ত বল প্রয়োগ বা অপেশাদার আচরণ করে থাকে, অবশ্যই তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। সিদ্দিকুরের অবস্থা জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ৬২৪ নম্বর কেবিনে ভর্তি রয়েছেন সিদ্দিকুর। কেবিনে দু’চোখ ঢাকা কালো চশমায় সিদ্দিকুর শুয়ে ছিলেন। শিয়রে তার মা সুলেমা খাতুন। বারবার ছেলের এ অবস্থা দেখে চোখের পানি ফেলছেন। তাকে ঘিরে আছেন ছেলের সহপাঠী-বন্ধুরা। বন্ধুরা সিদ্দিকুরের মাকে সান্ত¡না দিচ্ছেন। সব ঠিক হয়ে যাবে। একমনে ষাটোর্ধ সুলেমা খাতুন বলেই চলেছেন, ‘আমার পুতরে থুইয়া বাড়িত যাইতাম না।’ জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ছয়তলার কেবিন ব্লকে দেখা গেল এমন দৃশ্য। সিদ্দিকুর নিজেও কষ্ট করে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। খিলক্ষেতের একটি মেসে তার সঙ্গে থাকা ফরিদউদ্দীন জানান, বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার জন্য তারা প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কারণ বিসিএস দিয়ে মায়ের অভাবকে দূর করাই ছিল সিদ্দিকুরের জীবনের লক্ষ্য। আর বিসিএস পরীক্ষায় পাস করার জন্য ইংরেজীতে দক্ষতা বাড়াতে একটি কোচিং সেন্টারেও ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। রবিবার থেকেই তাদের সেখানে ক্লাস করার কথা ছিল। কিন্তু সিদ্দিকুর এখন হাসপাতালের বিছানায়। আর কখনও চোখে দেখবেন কিনা তা নিয়েও আছে সংশয়। হাসপাতালে সিদ্দিকুরের মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে তিতুমীর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক কাজী মোঃ আল নূও জানান, আমরা সবসময় চাই শিক্ষার্থীরা থাকবে ক্লাসের বেঞ্চে। তাদের কাউকে হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকতে দেখা আমাদের জন্য কষ্টের। আবার সেটা যদি হয় চোখের আলো হারানোর মতো বিষয়। তাহলে তা হয়ে ওঠে খুবই দুঃখজনক। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, সিদ্দিকুরের ডান চোখ পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি আর ওই চোখে দেখতে পাবেন না। তবে বাঁ-চোখে দৃষ্টি ফিরে আসতে পারে বলে ক্ষীণ আশা রয়েছে। আগের দিনের চেয়ে তার দুই চোখের অবস্থা নাজুক। জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ গোলাম ফারুক আশার কথা শুনিয়েছেন। শুরুতে তিনি জানিয়েছেন, সিদ্দিকুরের ডান চোখের অবস্থা পুরোপুরি খারাপ। শনিবার ওই চোখে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। আর বাঁ-চোখের কর্নিয়ায় ইনজুরি আছে। ওই চোখটি ওয়াশ করা হয়েছে। তবে আরও পরিষ্কারের পর অস্ত্রোপচার করতে হবে। অধ্যাপক ডাঃ গোলাম ফারুক জানান, রবিবার সকালের এমআরআই রিপোর্ট দেখে আমরা আশাবাদী হয়েছি। সিদ্দিকুরের বাঁ-চোখ নিয়ে পুরোপুরি না হলেও ক্ষীণ আশা আমরা দেখতে পাচ্ছি। সিদ্দিকুরের চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে। তার এমআরআই ও চোখের আল্ট্রাসনোগ্রাম করানো হয়েছে। এসব পরীক্ষা-নিরীক্ষার আগে ও পরে দুবার বৈঠক করেছেন তারা। পরীক্ষার রিপোর্টকে তাদের কাছে ইতিবাচক মনে হয়েছে। তিনি জানান, সিদ্দিকুরের চিকিৎসায় তারা কোন ত্রুটি রাখবেন না। তাকে হাসপাতালের সর্বোচ্চ সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। উল্লেখ্য, পরীক্ষার রুটিন ও তারিখ ঘোষণাসহ কয়েকটি দাবিতে গত ২০ জুলাই সকাল ১০টার দিকে শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনের সড়কে অবস্থান নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাতটি সরকারী কলেজের শিক্ষার্থীরা। পুলিশ তাদের ওই জায়গা ছেড়ে যেতে বললে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফুট ওভারব্রিজের পাশের অংশে অবস্থান নেন তারা। তখন তাদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠিচার্জসহ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হন তিতুমীর কলেজের ছাত্র সিদ্দিকুর রহমান। এরপর থেকে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন তিনি। এর আগে রবিবার শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তাকে দেখতে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ছুটে আসেন।
×