ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের শুনানিতে জঙ্গী সংগঠনের তথ্য উপস্থাপন

সেই মেজর জিয়াউল হক ঢাকাতেই আছে খুঁজছেন গোয়েন্দারা

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ২৫ জুলাই ২০১৭

সেই মেজর জিয়াউল হক ঢাকাতেই আছে খুঁজছেন গোয়েন্দারা

শংকর কুমার দে ॥ আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) ও আনসার আল ইসলাম নামের জঙ্গী সংগঠনদ্বয়ের সামরিক শাখার প্রধান সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক গ্রেফতার না হওয়ায় এখনও জঙ্গী হামলার জন্য হুমকি মনে করছেন গোয়েন্দারা। যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সংক্রান্ত উপকমিটির শুনানিতে উপমহাদেশে চলতি বছর উল্লিখিত জঙ্গী সংগঠনদ্বয় কয়েক শ’ সদস্য নিয়োগ করেছে বলে তথ্য উত্থাপনের পর এখন খোঁজা হচ্ছে সামরিক বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত এই জঙ্গী নেতাকে। পাকিস্তান ও ভারতে আল-কায়েদা অনুসারীদের তৎপরতা বাড়ার পাশাপাশি বাংলাদেশেও তৎপরতা বাড়ছে বলে তথ্য দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সংক্রান্ত উপকমিটির শুনানিতে একটি মার্কিন গবেষণা সংস্থা। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার এ ধরনের তথ্য উত্থাপনের পর মেজর জিয়াকে গ্রেফতারের জন্য খোঁজ করছে দেশীয় একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দাবি এ মেজর জিয়াউল হক ঢাকাতেই আত্মগোপন করে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সংক্রান্ত উপকমিটির শুনানিতে বলা হয়, ইসলামিক স্টেটের (আইএস) কথিত খিলাফত ইরাক ও সিরিয়ায় অব্যাহত চাপের মুখে থাকার কারণে এখন বৈশ্বিকভাবে ‘জিহাদিদের’ নেতা হতে চেষ্টা চালাচ্ছে আল-কায়েদা। আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা (একিউআইএস) চলতি বছর পর্যন্ত কয়েক শ’ সদস্য দলে নিয়েছে। আফগানিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে তাদের অনেক সেল আছে। বিগত ৫ বা ১০ বছরের মধ্যে এখন আফগানিস্তানে তাদের উপস্থিতি বেশি। এই বিশেষজ্ঞের মতে, বাংলাদেশে আল-কায়েদা বিশেষভাবে সক্রিয়। আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা তাদের নিজস্ব প্রচার মাধ্যম আস-সাহাবের মাধ্যমে ক্রমাগত প্রচারণা চালাচ্ছে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আল-কায়েদার নেতা আয়মান আল জাওয়াহিরি সংগঠনটির ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা খোলার ঘোষণা দেন। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশের জঙ্গী সংগঠন আনসার আল ইসলাম নিজেদের আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার (একিউআইএস) বাংলাদেশ শাখা দাবি করে আসছে। সংগঠনটি আনসার আল ইসলাম নাম ধারণের আগ পর্যন্ত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নামে পরিচিয় দিচ্ছিল। আনসার আল ইসলাম মোট ১১টি হত্যার দায় স্বীকার করেছে। এছাড়া আরও কয়েকটি হামলা ও কয়েকজনকে আহত করার ঘটনার জন্যও এই গোষ্ঠীকে দায়ী করা হয়। এরপর একের পর এক ব্লগার ও ভিন্নমতাবলম্বী লেখক ও প্রকাশককে হত্যা করে ব্যাপক আলোচনায় আসে এই জঙ্গী সংগঠনটি। সর্বপ্রথম ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্লগার রাজীব হায়দারকে ঢাকায় নিজ বাসার সামনে কুপিয়ে হত্যা করার পর এই সংগঠনটি আলোচনায় আসে। আর সর্বশেষ গত বছরের ২৫ এপ্রিল রাজধানীর কলাবাগানে বাসায় ঢুকে সমকামীদের অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও নাট্যকর্মী মাহবুব তনয়কে হত্যা করে এ গোষ্ঠী। এরপর থেকে এ পর্যন্ত এ জঙ্গীগোষ্ঠীর আর কোন হত্যাযজ্ঞের খবর পাওয়া যায়নি। এ কারণে জঙ্গী সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান মেজর জিয়ার অবস্থান, গ্রেফতার প্রসঙ্গটিও অনেকটা চাপা পড়ে আছে। বিশেষ করে জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবি দমন করতে গিয়ে মেজর জিয়ার প্রসঙ্গটি আড়ালে চলে গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞ সেথ জি জোনস যুক্তরাষ্ট্রের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সংক্রান্ত উপকমিটির শুনানিতে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা নিজেদের গণমাধ্যম আস-সাহাবের মাধ্যমে ক্রমাগত প্রচারণা চালাচ্ছে বলে যে তথ্য দিয়েছেন তাতে প্রচুর সংখ্যায় বেনামী পেজ খুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কথিত জিহাদি কথাবার্তা ছড়ানো হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার উর্ধতন এক কর্মকর্তা বলেন, গত বছরের ১ জুলাই হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহতসহ যারা এ পর্যন্ত নিহত হয়েছে তারা নব্য জেএমবি বা তাঁদের পরিবারের সদস্য (শিশু ও নারী)। অভিযানে নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে নব্য জেএমবির বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতাও রয়েছেন। তারা আইএস মতাদর্শেও অনুসারী বলে দাবি করা হয়েছে। তবে এখনও আল-কায়েদার আদর্শ অনুসরণকারী আনসার আল ইসলামের অনেক নেতা রয়েছেন যারা ধরা পড়েনি। এর মধ্যে আনসার আল ইসলামের কথিত সামরিক প্রধান সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক অন্যতম। গত কয়েক মাস ধরেই আলোচনায় শুধু নব্য জেএমবির জঙ্গী যারা নতুন করে জঙ্গী হামলা চালাতে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে বলে আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষের দাবি। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রুখে দিচ্ছে তাদের হামলা পরিকল্পনার, ধ্বংস করছে জঙ্গী আস্তানা, নিহত হচ্ছে আত্মঘাতী হামলায় নব্য জেএমবির জঙ্গীরা, গ্রেফতারও হচ্ছে। কিন্তু জঙ্গী সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলাম নামের জঙ্গী সংগঠনটির কোন অপতৎপরতার কোন খবরই নেই। জঙ্গী সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান সেনাবাহিনীর চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হককে নিয়ে কোন আলোচনা শোনা যাচ্ছে না। গত ৪ বছর ধরেই পলাতক থেকে বরখাস্ত হওয়া এ সেনা কর্মকর্তা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদের অন্যতম মাথা হিসেবে কাজ করছেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে উঠে এসেছে। মেজর জিয়াকে ধরতে অনেক অভিযান হয়েছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায়। কিন্তু তার হদিস মেলেনি। এ অবস্থায় তার অবস্থান খুঁজে বের করে গ্রেফতার না করা পর্যন্ত জঙ্গী হামলার হুমকি থেকেই যাচ্ছে। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের একজন কর্মকর্তা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের একটা প্রক্রিয়ায় দেশটির প্রতিনিধি পরিষদের ‘কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স’ বিষয়ক হোমল্যান্ড সিকিউরিটির উপকমিটির সভায় একটি গবেষণাপত্র উপস্থাপন করে র‌্যান্ড কর্পোরেশন। মার্কিন সামরিক বাহিনীকে গবেষণা ও বিশ্লেষণ সেবাদান করে এই সংস্থাটি। এর আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও সামরিক নীতি কেন্দ্রের পরিচালক সেথ জি জোনস ওই শুনানিতে অংশ নেয়ার পর আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য প্রকাশ করার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য কোন হুমকি নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অব্যাহত অভিযানে এরা একেবারেই কোণঠাসা। এখন স্বল্পসংখ্যক সদস্য নিয়োগের কিছু তৎপরতা চালানো হতে পারে যারা এখনও ধরা পড়েননি। অনলাইনভিত্তিক কিছু প্রচারণা তাদের রয়েছে। এগুলো দেশ ও বিদেশ থেকে পরিচালিত হয়। সেগুলোও নিয়মিত নজরদারি করা হচ্ছে। তবে আনসার আল ইসলামের অনেকেই গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের মাধ্যমে ওই চক্রে জড়িত অনেককেই শনাক্ত করা হয়েছে। তবে এখন সংগঠনটির তৎপরতা নেই বললেই চলে। যারা এখনও গ্রেফতার হননি, তাদের ধরতে চেষ্টা চলছে, মেজর জিয়াকে গ্রেফতারের জন্যও খোঁজা হচ্ছে।
×