ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০১৫ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ২৫ জুলাই ২০১৭

আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাঙালীর ইতিহাস, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্বমানের চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য নির্মাতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প যেন এক্ষেত্রে পিছিয়ে না থাকে। বাঙালীর নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও কৃষ্টি রয়েছে। আর আমরা বিজয়ী জাতি। তাই বাঙালীর এই বিজয় সর্বক্ষেত্রে বজায় রাখতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে টিকে থাকতে আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। সোমবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ২০১৫ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী চলচ্চিত্রের উন্নয়নে সরকার থেকে যা যা দরকার তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, দেশের মানুষের বিনোদনের খুব একটা জায়গা নেই। আগে বিনোদনের একমাত্র জায়গায় ছিল আমাদের চলচ্চিত্র, অর্থাৎ সিনেমা হল। আর একমাত্র চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই দেশের মানুষের খুব কাছে যাওয়া যায়। সমাজ পরিবর্তনেও চলচ্চিত্রের ভূমিকা অনেক। তাই দর্শকদের মন ছুঁয়ে যায়, হৃদয়ে গ্রথিত হয় এমন চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে আমাদের দক্ষ স্ক্রিপ্ট রাইটার তৈরি করতে হবে। যা আমাদের দেশে খুবই অভাব। এজন্য তিনি দেশের বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক ও গুণীজনদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। চলচ্চিত্র শিল্পী, কলা-কুশলীদের এই মিলনমেলায় প্রধানমন্ত্রী চলচ্চিত্রে গৌরবোজ্জ্বল ও গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২৫ ক্ষেত্রে ৩২ বিশিষ্ট শিল্পী ও কলা-কুশলীদের মাঝে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-২০১৫ পদক তুলে দেন। আজীবন সম্মাননা পান এককালের তুখোড় ও জনপ্রিয় চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শাবানা এবং বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী ফেরদৌসী রহমান। ফেরদৌসী রহমানের অনুপস্থিতিতে তাঁর কন্যা পদক নেন। তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন তথ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থানীয় কমিটির সভাপতি এ কে এম রহমত উল্লাহ এমপি। স্বাগত বক্তব্য রাখেন তথ্য সচিব মরতুজা আহমেদ। পুরস্কারপ্রাপ্তদের মধ্যে আজীবন সম্মাননা পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র অভিনেত্রী শাবানা বক্তব্য রাখেন। পরে পুরস্কারপ্রাপ্তদের সঙ্গে ফটোসেশনে অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠান শেষে দর্শকসারিতে বসে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর এদেশে শুরু হয়েছিল অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল ও হত্যা-ক্যু ও ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। এই দীর্ঘসময়ে আমাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও কৃষ্টিকে একেবারে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। একের পর এক সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। পরিকল্পিতভাবেই অপসংস্কৃতি ঢোকানো হয়েছিল। কিন্তু ওই সময় কিছু তরুণ নির্মাতা সাহসের সঙ্গে বেশকিছু ভাল চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। আমাদের দেশের মানুষের অনেক ট্যালেন্ট আছে, সুযোগ পেলেই তারা অনেক কিছু করতে পারে। তিনি বলেন, ‘৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসেই এদেশে সুস্থধারার চলচ্চিত্র নির্মাণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নত চলচ্চিত্র নির্মাণের লক্ষ্যে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। দুস্থ-অসহায় শিল্পী ও কলা-কুশলীদের সহযোগিতায় ট্রাস্ট ফান্ড গঠনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বাঙালী অনেক কিছুই ভুলে যাই। অনেকের কথাই আমরা মনে রাখতে পারি না। অনেক জ্ঞানী-গুণী শিল্পী ও কলা-কুশলীরা জীবন সায়াহ্নে এসে খুব কষ্ট ভোগ করতে হয়। এ কারণে তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য আমরা যে ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছি, এটা আরও বড় করা প্রয়োজন। এজন্য একটা বড় ও ভাল ফান্ড গঠনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে সত্যিকারের শিল্পী ও কলা-কুশলীরা যাতে মূল্যায়ন পায় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখার জন্য জুরি বোর্ডের সদস্যদের অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কার দেয়া হয় শিল্পী ও কলা-কুশলীদের উৎসাহিত করার জন্য। যেন পুরস্কার পেয়ে আরও ভাল কিছু করতে অনুপ্রেরণা পায়। তাই পুরস্কারের জন্য বাছাই করার ক্ষেত্রে সবাইকে নজর দিতে হবে যাতে সত্যিকারের শিল্পী ও কলা-কুশলীদের যেন মূল্যায়ন হয়। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অন্য কাউকে দিতে কেউ যেন চাপ সৃষ্টি না করে। চলচ্চিত্রের উন্নয়নে তাঁর সরকারের গৃহীত নানা পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, এ শিল্পের উন্নয়নে আমরা জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা করেছি। বিএফডিসিকে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এছাড়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু চলচ্চিত্রের উন্নয়নে সাভারে যে জায়গা বরাদ্দ দিয়েছিলেন, সেখানে আন্তর্জাতিক মানের ফিল্ম সিটি গড়ে তোলা হচ্ছে। সেখানে বিশ্বমানের শূটিং স্পট করা হচ্ছে। এই ফিল্ম সিটিতে আমরা বিশ্বমানের ফিল্ম আর্কাইভও গড়ে তুলব। তিনি বলেন, চলচ্চিত্র নির্মাণের পর তা ছাড় করতে সেন্সর বোর্ডের পরিবর্তে সার্টিফিকেট প্রদানে নতুন একটি আইনের খসড়াও করা হচ্ছে। চলচ্চিত্রের মানোন্নয়নে শিল্পী ও কলা-কুশলীদের উন্নত প্রশিক্ষণ এবং গবেষণার ওপর জোর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এবং চলচ্চিত্রের মানোন্নয়নে উন্নত প্রশিক্ষণ ও গবেষণা খুবই প্রয়োজন। আর তথ্য-প্রযুক্তির যুগে টিকে থাকতে হলে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পকেও আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। প্রযুক্তির মধ্যে দিয়ে সবাইকে এগিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, তথ্য-প্রযুক্তির যুগে সারাবিশ্বই এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। তাই সারাবিশ্বে কোথায়, কীভাবে এবং কেমন চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে, সেখানে কেমন প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হচ্ছে তা এখন ঘরে বসেই নির্মাতারা জানতে পারবেন। দেশে মানসম্মত স্ক্রিপ্ট রাইটারের অভাবের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে দর্শকদের হৃদয়কে স্পর্শ ও মন ছুঁয়ে যায় সেভাবে স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে হবে। হলবিমুখ দর্শকরা যাতে আবার সিনেমা হলে ফিরে আসে এমন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে। কিন্তু আমাদের দেশে ভাল স্ক্রিপ্ট রাইটারের অনেকটা অভাব রয়েছে। এই অভাব পূরণে তিনি দেশের শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যেই চলচ্চিত্রের উন্নয়নে গৃহীত প্রকল্পগুলোর কাজ সম্পন্ন করার জন্য তথ্যমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ৫ বছরের মেয়াদে ক্ষমতায় আসি। ৫ বছর পূর্ণ হলেই নির্বাচনের জন্য আমাদের জনগণের কাছে যেতে হয়। জনগণ ভোট দিলে ক্ষমতায় আসি, নইলে নয়। কিন্তু সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকলে সব ভাল কাজগুলোও যে বন্ধ করে দেয়া হয়, সেই তিক্ত অভিজ্ঞতাও আমাদের রয়েছে। তাই বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যেই চলচ্চিত্রের মানোন্নয়নে আমরা যেসব প্রকল্পগুলো গ্রহণ করেছি তা শেষ করতে তথ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করব। প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে তাঁর সরকারের প্রতিশ্রুতির কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে। সারাবিশ্বের কাছে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। আমি আশা করব, এক্ষেত্রে আমাদের চলচ্চিত্র যেন পিছিয়ে না থাকে। বাঙালীরা যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করেছে। আমরা বিজয়ী জাতি। তাই বিজয়ের এই ধারা সর্বক্ষেত্রে বজায় রাখতে হবে- এটাই আমি চাই। আর চলচ্চিত্র শিল্পকে আন্তর্জাতিক মানের করে গড়ে তুলতে সরকার থেকে যা যা প্রয়োজন তা সবাই করা হবে।
×