ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অচলাবস্থার কবলে চট্টগ্রাম কক্সবাজার রাঙ্গামাটি খাগড়াছড়ি বান্দরবান;###;খাতুনগঞ্জেই ক্ষতি ৩শ’ কোটি টাকা

বর্ষণ ঢল জোয়ার

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ২৫ জুলাই ২০১৭

বর্ষণ ঢল জোয়ার

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির ॥ বর্ষা মৌসুম। তাই বর্ষণ হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এবারের মৌসুমে অবিরাম ভারিবর্ষণে পুরো বৃহত্তর চট্টগ্রামের ৫ জেলা তথা- চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের সার্বিক অবস্থা যেন অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কবলে পড়ে ল-ভ- হয়ে আছে। চট্টগ্রাম মহানগরীর নিম্নাঞ্চল ছাড়িয়ে নতুন নতুন এলাকা জলজটে একাকার হয়ে গেছে। বাণিজ্য কেন্দ্র খাতুনগঞ্জের সর্বত্র পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় বিপুল অঙ্কের অর্থের পণ্য সামগ্রী বিনষ্ট হয়ে গেছে। প্রায় তিন হাজার পণ্য সংরক্ষণের গুদামে বৃষ্টি ও জোয়ারের পানি ঢুকেছে। এছাড়া রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কক্সবাজার সদরসহ ৮ উপজেলা বৃষ্টির পানি ও ভর জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে। গত তিনদিন ধরে টানা অতি ভারিবর্ষণ এই অচলাবস্থার কবলে পড়েছে বৃহত্তর চট্টগ্রাম। লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়েছে। সঙ্গে সহায় সম্পদের ক্ষতিও ব্যাপক। সোমবারের বর্ষণে সর্বোচ্চ ভোগান্তি ও ক্ষয়ক্ষতির রেকর্ড হয়েছে। সর্বত্র অস্বাভাবিক ও অসহনীয় পরিস্থিতি। কেননা অবস্থা কেবলই অবনতিশীল। বর্ষণ ও জোয়ার যেন একযোগে প্রতিযোগিতা দিয়ে লোকালয়ে আঘাত হেনেছে। পরিস্থিতি এমন যে বৃহত্তর চট্টগ্রামজুড়েই যেন নেমে এসেছে অচিন্তনীয় দুর্যোগ। দুর্যোগে সৃষ্ট দুর্ভোগে জনজীবন। পার্বত্যাঞ্চলে তিন জেলা রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়িতে নতুন করে আরও পাহাড়ধসের উৎকণ্ঠা বেড়েছে। চট্টগ্রাম পরিস্থিতি শ্রাবণের অঝোর ধারার বর্ষণে অনেকটাই ল-ভ- বৃহত্তর চট্টগ্রামের জীবনযাত্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সার্বিক কর্মকা-। অব্যাহত ভারিবর্ষণে নাকাল বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। যন্ত্রচালিত যানবাহন বন্ধ, সড়কে চলছে নৌকা। শুধু নিচু এলাকায় নয়, ডুবছে নতুন নতুন এলাকা। ব্যাপক ক্ষতির শিকার দেশের ভোগ্যপণ্যের বৃহত্তম পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ ও চাক্তাই। বাঁশখালীতে সোমবার আকস্মিক টর্নেডোতে উড়ে গেছে অর্ধশতাধিক ঘর-বাড়ি। এছাড়া ভেসে গেছে চিংড়িঘের ও মৎস্য খামার। এত বেশি বৃষ্টিপাত অনেক দিন হয়নি। আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, মৌসুমি বায়ু এখনও বেশ সক্রিয়। বায়ুচাপে তারতম্যের আধিক্য থাকায় সমুদ্র বন্দরসমূহের জন্য বহাল রাখা হয়েছে ৩ নম্বর সতর্কতা সংকেত। আরও অন্তত দু’দিন এ অবস্থা বিরাজ করতে পারে। সোমবার দিনভর ছিল একটানা বৃষ্টি। হালকা ও মাঝারি মাত্রার ফাঁকে ফাঁকে হয়েছে ভারিবর্ষণ। এতে করে নগরীর একটি বড় এলাকা প্লাবিত হয়। জনজীবন থমকে যায়। সড়কগুলো যানবাহন চলাচলে অযোগ্য হয়ে পড়ে। নিচু এলাকাগুলোতে পানি হয় বুক পর্যন্ত। ফলে নৌকা এবং রিক্সা ভ্যানই ভরসা। তবে যাত্রীদের ভাড়া গুনতে হয় দ্বিগুণ থেকে পাঁচগুণ পর্যন্ত। পারতপক্ষে ঘর ছেড়ে বের হয়নি সাধারণ মানুষ। অনেক স্কুলে পানি ঢুকে পড়েছে। সড়কগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাওয়ায় ক্লাস সাসপেন্ড করতে হয়। প্রবল বর্ষণে চট্টগ্রাম বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। জেটিতে কন্টেনার উঠানামা স্বাভাবিক থাকলেও বহির্নোঙরে মাদার ভেসেল থেকে পণ্য লাইটারিং কার্যত বন্ধ থাকে। বিগত কয়েকদিন বৃষ্টির ফাঁকে ফাঁকে কাজ চললেও সোমবার সে সুযোগ হয়নি। বড় জাহাজের হ্যাচ খুললে পানি ঢুকে পড়ার ঝুঁকি। তাছাড়া লাইটার জাহাজগুলোর পক্ষেও সমুদ্রে যাওয়া কষ্টসাধ্য। প্রচ- বাতাসের কারণে সাগর উত্তাল রয়েছে। শুধু বহির্নোঙরে পণ্য লাইটারিংই নয়, অভ্যন্তরীণ জলপথে মালবাহী জাহাজ চলাচলও বিঘিœত হচ্ছে। এবারের বর্ষণে আর্থিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে খাতুনগঞ্জের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো। বন্দর নগরী খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, চাক্তাই এবং কোরবানিগঞ্জ বাংলাদেশের বৃহত্তম পাইকারি বাজার হিসেবে পরিচিত। এখানে রয়েছে ৬ সহ¯্রাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। অধিকাংশ ব্যবসাই ভোগ্যপণ্যের। এসকল প্রতিষ্ঠানের রয়েছে গুদাম। পানি ঢুকে পড়ায় অনেক খাদ্য পণ্য বিনষ্ট হয়েছে। গত রবিবারের চেয়েও বেশি বৃষ্টিপাত হয় সোমবার। জোয়ারের সময় বৃষ্টিপাত হওয়ায় পানি নামতে পারেনি। রাঙ্গামাটি পরিস্থিতি রাঙ্গামাটি থেকে থেকে নিজস্ব প্রতিনিধি মোহাম্মদ আলী জানান, অব্যাহত ভারিবর্ষণে নতুন করে পাহাড়ধস এবং ঢলের পানিতে আবারও ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কায় ১০ উপজেলায় সতর্কতা জারি করে রেখেছে। গত ১৩ জুন তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে রাঙ্গামাটিতে ভয়াবহ পাহাড়ধস ও পাহাড়ী ঢলে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানির ঘটনার পর নতুন করে দুর্যোগ নেমে এসেছে। বান্দরবান পরিস্থিতি বান্দরবান থেকে জনকণ্ঠের নিজস্ব প্রতিনিধি এস বাসু দাশ জানান, ভারিবর্ষণ অব্যাহত থাকায় বান্দরবান পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। রবিবার রুমা উপজেলার সড়কের দলিয়ান পাড়া এলাকায় পাহাড়ধসে নিখোঁজ ৪ জনের খোঁজ এখনও মিলেনি। উল্লেখ্য, নিখোঁজদের মধ্যে রয়েছে সিংমেচিং (১৭), মুন্নি বড়ুয়া (৩৫), গৌতম কুমার নন্দী (৫৫) ও রবিউল (৪০)। খাগড়াছড়ি পরিস্থিতি খাগড়াছড়ি থেকে জনকণ্ঠের পার্বত্যাঞ্চল প্রতিনিধি জীতেন বড়ুয়া জানান, খাগড়াছড়িতে টানা বর্ষণে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। গত ৩ দিনের টানা বর্ষণে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের মুসলিমপাড়া, গঞ্জপাড়া, মেহেদীবাগ, মিলনপুর, সাতভাইয়া পাড়া মুখ, খবংপুড়িয়া, শান্তিনগর, অর্পণা চৌধুরী পাড়া, কল্যাণপুরসহ বেশ কিছু এলাকার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে করে সহস্রাধিক পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। শতাধিক পানিবন্দী পরিবার শহরের আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। বন্যার পাশাপাশি টানা বর্ষণের ফলে খাগড়াছড়ি জেলা সদরসহ বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ধস দেখা দিয়েছে। বর্ষণ অব্যাহত থাকায় বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে। কক্সবাজার পরিস্থিতি কক্সবাজার থেকে স্টাফ রিপোর্টার এইচ এম এরশাদ জানান, টানা ভারি বৃষ্টিপাতে চকরিয়া, রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও জেলা সদরের বেশির ভাগ নিচু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। মাতামুহুরী নদীতে ফের পাহাড়ী ঢলের পানি বেড়ে গিয়ে লোকালয়ে প্লাবিত হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিরা আবারও বন্যার আশঙ্কা করছেন। চকরিয়া সুরাজপুর-মানিকপুর, কৈয়ারবিল, কোনাখালী, ও বিএমচর এলাকা ভারিবর্ষণ অব্যাহত থাকার কারণে মাতামুহুরী নদীতে উজান থেকে আবারও পাহাড়ী ঢলের পানি নামতে শুরু করেছে। বর্ষণ অব্যাহত থাকলে উপজেলায় ফের ভয়াবহ বন্যা সৃষ্টি হবে। বাঁশখালীতে টর্নেডো ও পাহাড়ী ঢল বাঁশখালী থেকে আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা জোবাইর চৌধুরী জানান, টানা বর্ষণ ও টর্নেডোর আঘাতে চট্টগ্রামের বাঁশখালী ল-ভ- হয়ে গেছে। ফসলি জমি, ক্ষেতের ও চিংড়ি ঘেরের ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হয়েছে। বাঁশখালীর উপকূলীয় এলাকায় স্বাভাবিক জোয়ারের চাইতে ২/৩ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসও আঘাত হেনেছে। তাছাড়া ঐ এলাকায় টর্নোডোর ছোবলে অন্তত অর্ধশতাধিক বাড়িঘর ও দোকান বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। টর্নেডোর ছোবলে আহত হয়েছে অন্তত ১২ ব্যক্তি। সোমবার উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা আবুল কালাম মিয়াজী জনকণ্ঠকে জানান, কয়েকদিনের টানা বর্ষণে পাহাড়ী অঞ্চলসহ সমতল এলাকায় পাহাড়ী ঢলে প্লাবিত হয়েছে। তাছাড়া বেসরকারী হিসেব মতে পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ। এদিকে সোমবার সকালে গ-ামারা ইউনিয়নে টর্নেডো আঘাত হেনেছে। টর্নেডোর আঘাতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলেও তিনি জানান। সরেজমিন এলাকা পরিদর্শনে দেখা যায়, বঙ্গোপসাগরের সংযোগ নদী জলকদর খালের গ-ামারা ইউপির উত্তর বড়ঘোনা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে গ-ামারা ব্রিজ পর্যন্ত প্রায় ২ কিমি. বেড়িবাঁধ বিলীন হয়ে গেছে। বেড়িবাঁধ বিলীনের ফলে ঐ এলাকার মানুষ পানিতে আটকা পড়েছে। তাছাড়া ঐ এলাকায় এস. আলমের কয়লা বিদ্যুত প্রকল্পের ড্রেজার ও স্কেভেটর যানগুলো পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
×