ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কাজী মদিনা

‘বেগম’-এর সত্তর বছর

প্রকাশিত: ০৪:০২, ২৫ জুলাই ২০১৭

‘বেগম’-এর সত্তর বছর

১৯৪৭ সাল। কলকাতা হয়ে উঠেছে এক অশান্ত শহর। চারদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিধ্বস্ত কলকাতা মহানগর। এ রকম এক দুঃসময় মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন ১৯৪৭ সালে ২০ জুলাই নারী জাগরণ, নতুন লেখিকা সৃষ্টি, সাহিত্য ও সৃজনশীলতায় নারীদের উৎসাহী করার লক্ষ্যে সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা প্রকাশ করলেন। লেখিকাদের সমাজে ও জনসম্মুখে পরিচিত করার জন্য বেগম পত্রিকা প্রকাশ নারী জাগরণের এক যুগান্তকারী বিপ্লব। প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক মুক্তমনা, উদার, সাহিত্যপ্রেমী সাংবাদিক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সাংবাদিকতার মাধ্যমে অবরোধবাসিনী নারীদের অচলায়তন ভেঙ্গে বেরিয়ে আসার জন্য ১৯২৭ সালে মাসিক সওগাত পত্রিকায় ‘জানানা মহল’ নামে নারীদের জন্য একটি বিভাগ চালু করেন। পরবর্তী সময়ে শুধুমাত্র মেয়েদের লেখা নিয়ে বছরে একবার সওগাত পত্রিকা প্রকাশ করতেন। প্রথম সংখ্যাটি ১৯২৯ খিস্টাব্দে (বাংলা ১৩৩৭ সন) প্রকাশিত হয়। এভাবে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর সওগাত মহিলা সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে। মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন উপলব্ধি করলেন মহিলাদের জন্য বছরে একটি সংখ্যাই যথেষ্ট নয়। সাহিত্যক্ষেত্রে মহিলাদের এগিয়ে নিতে হলে তাদের জন্য একটি পৃথক সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। তিনি তাঁর একমাত্র কন্যা নূরজাহান বেগমকে একেবারে ছেলেবেলা থেকে পাশে রেখে সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি দিয়েছেন। মহিলা সংখ্যা সওগাত প্রকাশনার কাজের সঙ্গে যুক্ত করে নুরজাহান বেগমকে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে উৎসাহিত করেছেন। মহিলা সংখ্যা ‘সওগাত’-এর সঙ্গে আরও যুক্ত ছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। একদিন মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সুফিয়া কামালকে ডেকে বললেন বছরে একবার যদি মহিলা সংখ্যা সওগাত বের করা হয় তাহলে মেয়েরা সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গনে খুব বেশি অংশগ্রহণ করতে পারবে না। মেয়েদের নিজস্ব একটি পত্রিকা থাকলে লেখালেখির মধ্য দিয়েই পরস্পরকে জানতে পারবে। মেয়েদের জন্য একটি আলাদা পত্রিকা বের করা প্রয়োজন। সুফিয়া কামাল খুবই উৎসাহিত হলেন এবং সব রকম সহযোগিতা করার আশ্বাস দিলেন। মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন খুশি হলেন এবং বললেন। তাহলে তোমাকে প্রধান সম্পাদিকা করি এবং নূরজাহান বেগম ভারপ্রাপ্ত সম্পাদিকা থাকবে। মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন কবি সুফিয়া কামাল এবং নূরজাহান বেগম এই তিনজনের গভীর আন্তরিকতা অক্লান্ত পরিশ্রম ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ১৯৪৭ সালে ২০ জুলাই রবিবার (৩ শ্রাবণ, ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ) বাংলা ভাষায় পরিচালিত প্রথম সচিত্র সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কুসংস্কার ও গোঁড়ামির যুগে বাংলার মুসলিম মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত সাপ্তাহিক বেগম প্রকাশ নারীদের জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে এলো। প্রতিষ্ঠা দিবসে তৎকালীন নেতৃস্থানীয় মহিলারা শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। অধ্যাপিকা শামসুন নাহার মাহমুদ বলেন- আজ ভারতের মুসলমানের ভাগ্যাকাশে নতুন সূর্যের অভ্যুদয় হচ্ছে। বাংলার মেয়েদের হাতের মশাল যে কোন অংশে হীন তেজ হবে না। এ কথা জোর গলায় বলতে আর দ্বিধাবোধ করার কোন কারণ নেই। মিসেস এইচ এ হাকাম বলেন ‘যুগসন্ধিক্ষণে আপনাদের পরিচালনায় মুসলিম মহিলাদের সচিত্র সাপ্তাহিক বেগম-এর প্রকাশ আমাদের সামাজিক জীবনে নতুন ভাব ও আশার সঞ্চার করবে। বাংলা ভাষায় মুসলিম মহিলাদের এরূপ প্রগতিবাদী প্রচেষ্টা এই প্রথম। বেগম সৈয়দ ফেরদৌস মহল শিরাজী বলেন, ‘বাংলার ঘুমন্ত নারী শক্তিকে জাগিয়ে তুলবার ক্ষেত্রে বেগম এগিয়ে চলুক।’ মিসেস জাহানারা মজিদ বলেন, এই যুগসন্ধিক্ষণে আমাদের আশা-আকাক্সক্ষার দ্যুতি এবং নবজীবনের পথে আলোক সন্ধানী হবে বেগম। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে ছাপা হয় রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ছবি। সেই ধারাবাহিকতা আজও চলছে। কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতি সংখ্যা বেগমের প্রচ্ছদে একজন মহিলার ছবি ছাপা হয়। প্রথম সংখ্যা ছাপা হয়েছিল ৫০০ কপি। মূল্য চার আনা। সম্পাদকীয় লেখেন উভয়েই সুফিয়া কামাল ও নুরজাহান বেগম। সুফিয়া কামাল লেখেন স্তিমিত মুসলিম জীবনে আজ নতুন চেতনা দেখা দিয়েছে। দুই শত বছরের নিপীড়িত চেতনায় আজ দেখা দিয়েছে অপূর্ব নবজাগরণের দ্যোতনা। কৃষ্টির ধারাবাহন ও সমৃদ্ধি সাধনের একমাত্র সহায় সাহিত্যÑ সেই সাহিত্যের ক্ষেত্রে আজও আমরা প্রায় উদাসীন। ‘এই জন্যই বহুবিদ বাধাবিঘœ ও অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও আমরা সাপ্তাহিক বেগম লইয়া মুসলিম নারী সমাজের খেদমতে হাজির হইলাম।’ ‘বেগম-এর একটি উল্লেখযোগ্য সাধনা হইবে নতুন নতুন লেখিকা সৃষ্টি। উৎসাহী তরুণ- লেখিকাদের কাছে আমরা রচনা ও সর্বপ্রকার সহযোগিতার আহ্বান জানাই। সকলের সমবেত চেষ্টায় বেগম মুসলিম নারী সমাজের সত্যিকার খেদমতের যোগ্য হইয়া উঠুক।’ নূরজাহান বেগম লেখেন। মুসলিম সমাজ আজ এক কঠোর দায়িত্ব গ্রহণের সম্মুখীন। অর্জিত স্বাধীনতার সম্মান ও গৌরব অক্ষুণœœ রাখতে হলে কেবল পুরুষদেরই নয়, মুসলিম নারীকেও এগিয়ে আসতে হবে নতুন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের কাজে। এর জন্য চাই আমাদের মানসিক প্রসার, আশা-আকাক্সক্ষার ব্যাপ্তি আর জীবন সম্পর্কে এক স্থির ধারণা। জীবনের প্রতি পরিপূর্ণ দৃষ্টিপাত সম্ভব কেবল সাহিত্য ও শিল্পের মধ্যস্থতায়।... আল্লাহর রহমতে, বেগম সাপ্তাহিক পত্রিকারূপে প্রকাশিত হলো। নবজাগ্রত মুসলিম নারী সমাজের আন্তরিক সহযোগিতা পেয়ে বেগম-এর দ্রুত উন্নতি সম্পর্কে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। মুসলিম নারী সমাজের বাণীবাহক হিসেবে প্রত্যেকেই বেগমের সমান দাবিদার। প্রথম চার মাস ‘বেগম’ সম্পাদিকা হিসেবে সুফিয়া কামালের নাম থাকলেও পত্রিকা প্রকাশের জন্য উদয়াস্ত পরিশ্রম করেন নুরজাহান বেগম। কলকাতা তখন ছিল অশান্ত নগরী। লেখা সংগ্রহ করা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। ঘরে বসে ফোনের মাধ্যমে লেখা সংগ্রহ করা হতো। একটি পত্রিকা প্রকাশের জন্য একাধিক নিবন্ধ প্রবন্ধ প্রতিবেদন লিখতে হয় বিভিন্ন বিভাগ অনুযায়ী। লেখিকার অভাবের জন্য নূরজাহান বেগম বাবার পরামর্শ অনুযায়ী অনুবাদের কাজ শুরু করলেন। বিভিন্ন ইংরেজীর পত্রপত্রিকা থেকে নিজেদের প্রয়োজনমতো অনুবাদ করে প্রতিবেদন ছাপানো হতো। প্রখ্যাত লেখিকা মোতাহেরা বানুর দুই কন্যা লাসিমা বানু ও তাহমিনা বানু নুরজাহান বেগমের সঙ্গে একত্রে বেগমের কাজে সহায়তা করেন। মায়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া লেখাতে হাত দুই-বোনের ভালই ছিল। মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন নিজ তত্ত্বাবধানে বেগমের সব কিছু দেখাশোনা করেন। কোন্ লেখার সঙ্গে কোন্ ছবি যাবে, কিভাবে লেখা সাজানো হবে সে সম্বন্ধে চূড়ান্ত মতামত দিতেন মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন। নিজে একবার না দেখে কোন লেখাই তিনি প্রেসে দেয়ার অনুমতি দিতেন না। তবে সব কাজই নূরজাহান বেগমের হাত দিয়েই করা হতো। প্রথমে বর্ষ ৪২ সংখ্যা পর্যন্ত বেগম কলকাতার ১২ নম্বর ওয়েলেসলী স্ট্রিট থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর নিজস্ব ভবন ২০৩ নম্বর পার্কস্ট্রিটে বেগম কার্যালয় স্থানান্তরিত করা হয়। বেগম-এর নতুন কার্যালয় উদ্বোধন উপলক্ষে মহিলাদের প্রীতি সম্মিলনের আয়োজন করা হয়। তখনকার দিনের প্রায় সব মহিলা সাহিত্যিক, সমাজকর্মী লেখিকা ও পাঠিকা অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অধ্যাপিকা কল্যাণী সেন প্রধান অতিথির আসন অলঙ্কৃত করেন। বেগম সম্পাদিকা নূরজাহান বেগম জ্ঞানগর্ভ বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেনÑ মেয়েদের পরিচালিত এই পত্রিকার উন্নতির জন্য সর্বস্তরের মহিলাদের সাহায্য কামনা করি। মেয়েরা সাহিত্য চর্চা করুক। পড়ুক, লিখুক এবং জীবন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে সমাধানের চেষ্টা করুক এই উদ্দেশ্য নিয়েই ‘বেগম’-এর প্রকাশ। বেগম চায় দেশের মেয়েদের মধ্য থেকে কুসংস্কার দূর করে, অশিক্ষার অন্ধকার দূর করে জীবনের সমস্ত ভার স্বেচ্ছায় ও সাহসের সঙ্গে, সার্থকতার সঙ্গে বহন করার বাণী শোনাতে। মোহাম্মদ নাসির উদ্দিনের উদ্দেশ্য ছিল গ্রামবাংলার বিশাল জনপদের নারীদের লেখালেখির চর্চায় উৎসাহিত করা। আর তাই বেগম পত্রিকায় গল্প-প্রবন্ধ ছাপানোর পাশাপাশি নারীদের চিন্তা, চেতনা, মনন বিকাশের জন্য বিভিন্ন বিভাগ রাখা হয়। প্রথম বর্ষ প্রথম সংখ্যার সূচীপত্রে ছিল গল্প, প্রবন্ধ সূচিশিল্প, চিত্রশালা, স্বাস্থ্য, সৌন্দর্য। ভারতের খ্যাতিনামা নারীদের ছবি মুসলিম মহিলা ন্যাশনাল গার্ড নামে প্রবন্ধ ঘরকন্যা, বর্ষার দিনে, ছায়াছবির কথা, ইরানে নারী আন্দোলন, বয়স্ক মহিলাদের শিক্ষা, বিজ্ঞানের কথা, এবং দেশ বিদেশের খবর। প্রথম সংখ্যার কোন কবিতা ছাপা হয়নি। চিঠিপত্র বিভাগ খোলার পর প্রত্যন্ত এলাকার নারীরা চিঠি লিখে বেগমের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেল। আর যখন ঈদ সংখ্যা ‘বেগম’-এ লেখিকাদের ছবিসহ লেখা প্রকাশ শুরু হয় তখন এর পাঠক সংখ্যা সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৮ সালে কলকাতা থেকে প্রথম ঈদ সংখ্যা ‘বেগম’ প্রকাশিত হয়। ৬২টি রচনা ছিল। এক রঙা, তিন রঙা বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আর্ট পেপারে ছাপা রঙিন ছবি ছিল। অঙ্গসজ্জা ছিল হোয়াইট প্রিন্টিংয়ে। মূল্য ছিল ২ টাকা। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মহিলাদের ছবি সংবলিত ঈদ সংখ্যা কলকাতায় দারুণ আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৪৯ সালে বিশ্বনবী সংখ্যা সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ‘বেগম’ কলকাতা থেকে তিন বছর প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৫০ সালে মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সপরিবারে ঢাকায় চলে আসেন। প্রথম দিকে ৬৬ নম্বর লয়্যাল স্ট্রীটে সত্তগাত প্রেস, আর ‘বেগমে’র কার্যক্রম পরিচালিত হতো ৩৮ নম্বর শরৎগুপ্ত রোডের বাড়ি থেকে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শরৎগুপ্ত বাড়িতেই অনুষ্ঠিত হয়। লায়লা সামাদ লয়্যাল স্ট্রীটে আর নূরজাহান বেগম শরৎগুপ্ত রোডের বাড়িতে বসতেন। কিছুদিন পর লয়্যাল স্ট্রীট থেকেই বেগম পত্রিকার কার্যক্রম পরিচালিত হয়। যা আজও বিদ্যমান। বেগম পত্রিকাকে কেন্দ্র করেই ঢাকায় গড়ে ওঠে মহিলা কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীর মহামিলন। গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত এলাকার শুধু নারীদের জন্য নয় সমগ্র পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য বেগম পত্রিকা স্থাপন করল এক অনন্য দৃষ্টান্ত। বেগম তো শুধু পত্রিকা নয়, সমাজ রূপান্তরের কাজটিও অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে করে গেছে। অচিরেই নারী-পুরুষ সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে পত্রিকাটি ঘরে ঘরে পৌঁছে যায়। মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলতেন এ ব্যবসা নয়। শুধু ভালবাসার অর্জন। নিজস্ব প্রেস থাকার কারণে নামমাত্র মূল্যে পত্রিকাটি বিক্রি করেছেন। বেগম যেমন ঘরে ঘরে পৌঁছে গেল একই সঙ্গে ব্যক্তিসত্তায় নূরজাহান আপা সর্বজনীন আপা হয়ে গেলেন। তিনি আমাদের মায়েদের আপা, আমাদের আপা, আমাদের কন্যাদেরও আপা। দেশ বিভাগের পর সংস্কৃতানুরাগী মুসলিম মহিলাদের বেশিরভাগ সবাই কলকাতা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। সওগাতের নারীমুক্তি আন্দোলনের ফলে মুসলিম বাংলার মহিলা সমাজে যে সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা গড়ে উঠেছিল তার কেন্দ্রস্থল ছিল কলকাতা। মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সাহিত্যিক সংস্কৃতানুরাগী মহিলাদের মিলনের জন্য ১৯৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর বেগম ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। প্রেসিডেন্ট পদে শামসুন নাহার মাহমুদ এবং সেক্রেটারি হলেন নূরজাহান বেগম। বেগম সুফিয়া কামাল হলেন এক নম্বর সদস্যা। মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান করে ক্লাব উদ্বোধন করা হয়। বিপুল সংখ্যক মহিলা কবি-সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবী অনুষ্ঠানে সমবেত হয়েছিলেন। নূরজাহান বেগম- ‘বেগম ক্লাবের উদ্দেশ্য বর্ণনা করে সারগর্ভ বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন- ‘বাংলার মহিলা সমাজের উন্নয়নের জন্য এ পর্যন্ত বেগম যা কিছু করেছে তা সুদূরপ্রসারী কার জন্য সাপ্তাহিক বেগম এর লেখিকা পৃষ্ঠপোষক ও অন্যান্য সাহিত্যিকের সমন্বয়ে গঠিত এই সমিতি। মহিলাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মান উন্নয়নের জন্য বেগম ক্লাব প্রতিষ্ঠা করা হলো। গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান ও উৎসব উদযাপন করা হবে। ভবিষ্যত উন্নয়নের জন্য সংঘবদ্ধভাবে চিন্তা করা। সম্মিলিত চেষ্টায় ও পারস্পরিক ভাবের আদান প্রদানের মাধ্যমে শক্তিশালী সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব হবে।’ বেগম ক্লাবের মাধ্যমে ৫০ দশকে নারীরা একসঙ্গে বসার সুযোগ পেয়েছিলেন। বিভিন্ন স্থান থেকে নারীরা বেগম ক্লাবে এসেছেন। মন খুলে কথা বলেছেন। নিজেদের মত বিনিময় করার মতো একটি প্লাটফর্ম তৈরি করেছে বেগম ক্লাব সেই পঞ্চাশের দশকে। যেখানে নারীরা স্বাধীন মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠত করার প্রেরণা পেয়েছে। নিজ চিন্তা, চেতনা, মননকে সমসাময়িক রেখেছেন। বেগম ক্লাবের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান পল্লী উন্নয়ন বিভাগ ও মুসলিম বিবাহ এবং পারিবারিক সংশোধনী আইন নিয়ে কাজ করা। বেগম ক্লাবের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে এসেছেন সঙ্গীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, রাজনীতিবিদ, নারীনেত্রী আশালতা সেন, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, রাজিয়া বানু, দৌলতুন নেসা, দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকার সম্পাদক আবদুস সালাম, ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন, অর্ধ সাপ্তাহিক ‘পাকিস্তান’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ মোদাব্বের, কেন্দ্রীয় সরকারের রিজিওন্যাল পাবলিসিটি ডিরেক্টর শরিফুল হাসান প্রমুখ। বিদেশ থেকে এসেছেন শান্তি নিকেতনের শিল্পী ইলা ঘোষ। সুপর্ণা ঠাকুর। কণিকা বন্দোপাধ্যায়। উমা গান্ধী। ইলা চট্টোপাধ্যায়। শিবানী গুহ, মিত্রা দত্ত, রীতা গাঙ্গুলী, বেলা মিত্র। চীন থেকে লেখিকা মিস মারিয়া ইয়েন। ব্যাঙ্ককের সান্ত্রীসারণ’ পত্রিকার সম্পাদিকা মিস নীলওয়ান পিনতং, আন্তর্জাতিক লেখক সংঘের করাচী শাখার প্রতিনিধি ঔপন্যাসিক কোবরাতুল আয়েন হায়দার, ইংরেজ সাংবাদিক রাশব্রুক উইলিয়ামস ও মিসেস উইলিয়ামস। গণচীনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মাদাম লিকে চোয়ান, ইন্দোনেশিয়ার তরুণ নেত্রী মিসেস তিতি মেমেত তানু মিজাজা। দুঃখের বিষয় এ রকম আলোকিত ক্লাবটি কালের বিবর্তনে ধীরে ধীরে এর সমস্ত কর্মকা- শ্লথ হয়ে গেল। নির্জীব হতে হতে একদিন স্থবির হয়ে গেল। নূরহাজান বেগম ২০০৫ সালে বেগম ক্লাব পনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস নেন। এখন যারা প্রতিষ্ঠিত নারী তারা পুরান ঢাকায় যেতে আগ্রহী নন। ব্যর্থ হলো নূরজাহান বেগমের প্রচেষ্টা। তিনি বড় দুঃখ পেয়েছিলেন। নূরজাহান বেগম কখনও সরাসরি রাজনীতি করেননি, পথে নামেননি। তবে নারী জাগরণ, নারীর ক্ষমতায়নে যে সব আন্দোলন হয়েছে সেখানে ‘বেগম’ পত্রিকা ছিল প্রধান মাধ্যম। ধর্মীয় গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িকতা ছাপিয়ে নারীদের আলোকিত পথে হাঁটতে ব্রতী করেছে ‘বেগম’ পত্রিকা। নূরজাহান বেগম একেবারে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বেগম পত্রিকার সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বড় মেয়ে ফ্লোরা নাসরিন খানের হাতে সম্পন্ন করলেও মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত পত্রিকায় কার লেখা যাবে, কোন্ কোন্ বিষয় থাকবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছেন নূরজাহান বেগম। সেই যে ৪৭ সালে ২০ জুলাই একটি পত্রিকা প্রকাশিত হলো তা আজও সত্তর বছর ধরে প্রকাশিত হয়ে আসছে। কাল পরিক্রমায় সাপ্তাহিক থেকে মাসিক হয়েছে। নূরজাহান বেগম বিশ্বাস করতেন জীবন নির্মাণে চাই শক্ত ভিত। এই ভিত গড়ার কাজটি তিনি সাংবাদিকতার মাধ্যমে করেছেন। বেগম পত্রিকার বেশিষ্ট্য হলো লেখিকা সৃষ্টি। আর তাই অখ্যাত অজ্ঞাত মেয়েদের উৎসাহ দেয়ার জন্য তাদের লেখা পরিমার্জন করে ‘বেগম’ পত্রিকায় ছাপা হয়। গ্রামবাংলার বিশাল জনপদের সাধারণ মানুষের উপযোগী করে বেগম পত্রিকা প্রকাশ করা হয়। আর তাই প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত। শহরে নয় তবে গ্রামে আজও ঘরে ঘরে বেগম পত্রিকার পাঠক রয়েছে। সুদীর্ঘ সত্তর বছর কালব্যাপী বেগম পত্রিকার মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে কয়েক শত মহিলা কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপনাসিক ছোট গল্প লেখিকা, আলোক চিত্রশিল্পী, সাংবাদিক, কলামিস্ট, সমাজ সংস্কারক। নারী সমাজের মুদ্রিত রূপরেখা বেগম পত্রিকা যেমন চিহ্নিত করেছে তেমনি আবার সমাজ বদলের কাজটি সচেতনভাবে করেছে। পিছিয়ে পড়া নারীদের এগিয়ে চলার পথটি প্রশস্ত থেকে প্রশস্ততর করার দিকনির্দেশনা দিয়েছে বেগম পত্রিকা। উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদি রথে চড়ে দীর্ঘ সত্তর বছরব্যাপী বেগম পত্রিকা নারী সমাজের চেতনার বিকাশ ও সমাজ প্রগতির কাজ নিরন্তর করে চলেছে। সত্তর বছরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সমগ্র নারী সমাজের পক্ষ থেকে ‘বেগম’ পত্রিকাকে জানাই সশ্রদ্ধ অভিবাদন। লেখক : অধ্যাপক
×