ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জোড়াতালির জীবন

প্রকাশিত: ০৪:০১, ২৫ জুলাই ২০১৭

জোড়াতালির জীবন

মাসের শেষ, বন্ধু এসে হাজির। বেশ পুরনো বন্ধু, শৈশবকালের না হলেও মহব্বতের কমতি ছিল না। ওর নাম স্মারক। সেই কবে কলেজ ছেড়েছি, তারপর আর দেখা হয়নি স্মারকের সঙ্গে। জীবন হেঁটেছে জীবনের পথে, একে একে কেটে গেছে বারোটি বছর। আমি এখন মধ্যযমুনায়- সাঁতার জানি না, তাই সমানে হাবুডুবু খাই। ছোটখাটো চাকরি করি, মাস গেলে মাইনে পাই। তাতে সংসার যতটা না চলে, তারচেয়ে বেশি থমকে যায়। মানে জোড়াতালির সংসার। কেমন আছিস বল? বন্ধু স্মারক জানতে চায়। আমি নিরুত্তর থাকতে না পেরে হুঁ-হা টাইপ কিছু বলি। যার আদতে কোন অর্থ হয় না। দাড়ি রেখেছিস যে বড়! ভাবুক হয়ে গেছিস নাকি! ও আবার বলল। ওর কথায় মৃদু খোঁচার আভাস ছিল, কিন্তু আমি তা গায়ে মাখিনি। কারণ ‘হ্যান্ড টু মাউথ’ জীবন যার, তাকে অত স্পর্শকাতর হলে চলে না। বস্তুত, নিতান্ত দায়ে পড়ে দাড়ি রেখেছি। এখানে রবীন্দ্রনাথ হবার কোন কাহিনী নেই। দাড়ি রাখলে দুটো টাকা অন্তত বাঁচে। এভরি অল্টারনেট ডে-তে দাড়ি কামাতে হয় না। সেলুনে গেলে পঞ্চাশ, আর বাসায় কামালে রেজার, সেভিং ফোম ও লোশন মিলিয়ে কুড়ি টাকা বেরিয়ে যায়। এক ডিব্বা সেভিং ফোমের দাম আড়াইশ টাকা। স্মারক আমার অফিসে এসেছে। অফিস মানে পলেস্তারা খসে ইটসুরকি চুরচুর একখানা পুরনো দালান। চেয়ারখানা বহুল ব্যবহারে ভেঙে পড়েছে প্রায়, উঠে এসেছে নারকেল ছোবড়া দিয়ে তৈরি গদিও। স্মারক মনে মনে হয়তো হাসে! এই তাহলে কলেজের সেই কলজে-কাঁপানো মেধাবী ছেলের অবস্থা! আমি কিছু বলি না। চুপচাপ থাকি। কারণ আমি জানি নৈঃশব্দ্য হিরন্ময়। কেরানির আবার অত বায়নাক্কা কিসের! দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয় না, এই ঢের! বন্ধুকে বসতে দেবার উপায় নেই দেখে নিজের ইজ্জত বাঁচাতে বলি, চল বাইরে যাই। চা খাবি তো? আমাদের নগাদা ভাল চা বানায়। খাঁটি গরুর দুধের চা। মানে গরু ও দুধ দুটোই নির্ভেজাল। বুঝিয়ে বলি আমি। গরু খাঁটি না হলে কি দুধ খাঁটি হয়! স্মারক আমাকে চেনে ও বিলক্ষণ জানে। আমি ভাঙবো তাও মচকাবো না। নগাদার দোকানের সামনে যে বাঁশের বেঞ্চি, তাতে বসি। স্মারক বড়লোকের ছেলে। সে চাকরি করে না, কাজও করে না। তবু তার হাতে মেলা টাকা। স্মারক নিজের মতো খরচ করে। টাকা যত লাগে দেবে গৌরি সেন। তাকে সেসব ভাবতে হয় না। স্মারকের বউও সুন্দর দেখতে। দুধে-আলতা গায়ের রং, দিনান্তে ফেইশল করে। ঘরেই নাকি পারলার বসিয়েছে। কষ্ট করে বাইরে যাবে কেন! স্রষ্টা যাকে দেন ছপ্পড় খুলে দেন। কোনকিছুর অভাব রাখেন না। আমার দুটো ছেলে মহা দুষ্টু। কথা শোনে না, পড়ায়ও বিশেষ মনোযোগ নেই। ওদের নাকের নিচে সিকনি লেগেই থাকে। কারণ গরমে ঘামে, ঘরে ঠা-াকল নেই। ফ্যান একটা আছে বটে, তবে বিদ্যুতের যাতায়াত বেশি। ঘুরতে ঘুরতে বেচারা ফ্যানও বড্ড টায়ার্ড। যেন বলতে চায়, ক্লান্তি আমার ক্ষমা করো প্রভু। স্মারকের এই-চা চলবে না। ও পাঁচ তারকায় অভ্যস্ত। হোটেল ছালাদিয়া ওর জায়গা নয়। কিছু একটা খা। কী খাবি বল? আমি সসঙ্কোচে বলি। ও মজা করে বলে, কিছু না। হামি খাবো। দুষ্টুমি করার অভ্যাস ওর কলেজকাল থেকেই। আমি হেসে উড়িয়ে দেই। স্মারক ওর সৌভাগ্যের ঝাঁপি খুলে বসে। ওর বাপের তিনখানা গাড়ি। যখন যেমন চাই, গাড়ি নিয়ে দীর্ঘভ্রমণে যায়। সঙ্গে বউ থাকে, কখনও বান্ধবী। বউ সঙ্গে থাকলে ভাল, জিএফ মানে বান্ধবী হলে আরও ভাল। ওরা খুব কেয়ারিং। কেয়ার না করলে স্মারক যদি তারিয়ে দেয়! তুই বিবাহিত ওরা জানে না? আমি গাড়লের মতো বলি। বেশুমার টাকা থাকলে যে টেকোরও টাক ঢাকে, মনে ছিল না। স্মারক সহাস্যে বলল, আমি ম্যারেড ব্যাচেলর, টাকা ভি আছে, তাই জিএফ-এর অভাব হয় না। আমি নিজেকে ওর সঙ্গে মেলাতে চেষ্টা করি। ওর জীবনে একাধিক নারী আছে, আমার নেই। তারা সুন্দরী ও রুচিশীল। কেউ উর্বশী, আবার কেউ মেনকা বা ক্লিওপেট্রা। যেমন দেখতে, তেমন চাখতে। কী, বাজে লাগছে শুনতে! তাহলে কানে তুলো গুঁজে দিন। সচ্ বাত একটু তেতোই হয় বটে! আমার বউ চলতিমান। কেরানির বউ যেমন হয় আর কি! আটপৌরে দেখতে, চেহারায় চটক খুব একটা নেই। একসময় ছিল হয়তো, সময়ের পলি পড়ে সব ভরাট এখন। বুক-পেট আলাদা করা যায় না। ভাব-ভালবাসা? ছিল একসময়। সংসারের টানাপড়েনে তাও চুকেবুকে গেছে। সামনেই একটা দামী রেস্তোরাঁ আছে। ভয়ে আছি, স্মারক ওখানে ঢুকে না পড়ে। আমাকে দেখতে এসেছে ও বা দেখাতে, তাই আতিথেয়তার ভার আমার। আমি জানি, ওই রেস্তোরাঁর যে কোন একটি আইটেমের দাম চুকানোর মুরোদ আমার নেই। আমি একজন নিরীহ করণিক। মাসমাইনে দিয়ে চলি, উপরি কামাই নেই। মাসের শেষে অসম্ভব টানাটানি থাকে বিধায় আমরা সকলে মিলে ভর্তাভাত খাই। তাতে সর্ষেতেল দিই না, কারণ তেলটুকু অবশিষ্ট থাকে না আর। স্মারকের বাপ তৈরি পোশাকের কারবার করেন। সাদাচামড়ার সায়েবদের লজ্জা নিবারণের জন্য তিনি মা- বোনদের বেআব্রু রাখেন। খেটেখাওয়া বুভুক্ষু মানুষের রক্তেঘামে আখের গোছান। স্মারক তার ছেলে, যে কিনা নানান রঙের তিনখানা শৌখিন মোটরগাড়ি হাঁকে। তিনি ভূরি ভূরি ডলার কামান। আর আমি সপ্তাহান্তে একপো মশুরডাল কিনতে হিমশিম খাই। আক্রার বাজারে চাল-ডাল ভীষণ দামী। সিন্ডিকেটঅলারা এই সুযোগে বেশকিছু মুনাফা করে নেয়। আর আমি দুচোখ ভরে সর্ষেফুল দেখি। অবাক বিস্ময়ে ভাবি, স্রষ্টা এমন একচোখা কেন! কারও টাকা রাখার জায়গা নেই, তাই ভিনদেশে সেকেন্ড হোম কেনে। আবার কারও জামা কেনার পয়সা নেই, তাই একটাই শার্ট পরতে পরতে কলারে কালসিটে ও ফেঁসো উঠে আসে। আমি জানি স্মারক এখানে এমনি আসেনি, সে টাকা দেখাতে এসেছে। টাকার গরম চরমে উঠলে তা অন্যকেও পোড়ায়। স্মারকের প্রতিটি কথায় সূক্ষ্ম খোঁচা থাকে, আমি তা বুঝেও না বোঝার ভান করি, মানে জেগে ঘুমাই। গরিবের অত বুঝতে নেই, বোধবুদ্ধি সব বড়লোকের ব্যাপার। সহসাই ফোন আসে। আমার ছোটছেলে আব্দারের সুরে বলে, বাবা, মাল্টা খাব। আমি তাকে মিথ্যে আশ^াস দিই- ফেরার পথে আনব। কিন্তু আমি কখনও ছেলেকে মাল্টা কিনে দেবার স্বপ্ন দেখি না। মাল্টার কেজি তিনশ’ টাকা। সঙ্গে ফরমালিন ফ্রি। অসুখ হলে তার ওষুধ কে দেবে! ছেলে আমার পথ চেয়ে থাকে। আমি বাসায় ফিরে লাজলজ্জার মাথা খুইয়ে আরও একটা মিথ্যে গল্প বানাই। মিছেকথা বড়লোকেও বলে, সেটা করে আখের গোছাতে, দোষের কিছু নয়। আর আমি বলি স্রেফ ছেলের কাছে মান বাঁচাতে। আমার বউ অঞ্জনা, সেও গঞ্জনা কিছু কম দেয় না। প্রায়শ মনে করিয়ে দেয়, আমি কেরানি, কেরানির অত আবেগ থাকতে নেই। আমি কবিতা লিখি, তা নিয়েও তার মনস্তাপের অন্ত নেই। ওসব ছাইপাশ না লিখে কিছু ওভারটাইম করলে নাকি ছেলেটা মাল্টা খেতে পেত। গরিবকে ভাবালুতা মানায় না। ওটা নাকি বাহুল্য দোষ, গরিবের ঘোড়ারোগ। স্বপ্নদোষের চেয়েও জঘন্য! আমি ব্যস্ততার অজুহাতে বন্ধুকে পত্রপাঠ বিদায় জানাই। একরাশ মনখারাপ নিয়ে আবারও বসে পড়ি গদিছেঁড়া তেঠ্যাঙা চেয়ারে। লেখক : রম্যলেখক
×