ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচিত হলেও কোণঠাসা থাকতে হচ্ছে নারী জনপ্রতিনিধিদের

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২৪ জুলাই ২০১৭

নির্বাচিত হলেও কোণঠাসা থাকতে হচ্ছে নারী জনপ্রতিনিধিদের

স্টাফ রিপোর্টার ॥ নারীর ক্ষমতায়ন সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু এখনও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী কোণ্ঠাসা হচ্ছে। এ জন্যই নারীর ক্ষমতায়নও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। স্থানীয় সরকারের কয়েক নারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপচারিতার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে বছরের পর বছর জনগণের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় তারা ভোটে নির্বাচিত হলেও পুরুষতন্ত্র তাদের দমিয়ে রেখেছে। বলতে গেলে, তাদের চেয়ার আছে ক্ষমতা নেই, পদ আছে কিন্তু দায়-দায়িত্ব নেই। স্থানীয় পর্যায়ে নারী আসনের প্রতিনিধিদের বাস্তব চিত্র এটি। স্থানীয় সরকারের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত সব নারী প্রতিনিধিদের একই অবস্থা। তারা অনেকেই জানেন না তাদের করণীয় কি। ঝালকাঠি সদর উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ইসরাত জাহান সোনালী পর পর দুইবার নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, ‘নারীরা যখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তখন তাদের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চাইতে হয়। আর পুরুষরা মিছিল কিংবা সভা সমাবেশ করেই ক্ষান্ত হন। কারণ যে ব্যক্তি নির্বাচনে দাঁড়ায় সমাজে সে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু এজন নারী যখন নির্বাচনে দাঁড়ায় তখন সমাজের মানুষও তাদের হেয় প্রতিপন্ন করে। সব বাধা পেরিয়ে যখন আমি ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হলাম তখন ভেবেছিলাম জনগণকে দেয়া কথা পূরণ করার সুযোগ পেলাম। কিন্তু এরপর উপজেলার চেয়ারম্যান দ্বারা কোণ্ঠাসা হতে শুরু হলাম। বিভিন্ন সভার নোটিস আমি পাই না, সভার সিদ্ধান্তসমূহ জানানো হয় না। কোন কাগজপত্রে স্বাক্ষর গ্রহণ করা হয় না। এলাকার স্থাানীয় এমপি, ইউএনওসহ চেয়ারম্যানের কাছ থেকে যথার্থ মূল্যায়ন কখনও পায়নি। বিভিন্ন প্রকল্প কর্মসূচী গ্রহণের সময়ও আমার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। কাজের প্রয়োজনে বিভিন্ন এলাকায় যেতে পরিবহন সুবিধা না থাকায় নিরাপত্তাসহ নানান ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়।’ সুনামগঞ্জ উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নিগার সুলতানা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমি যে কয়টি আসনে নির্বাচিত হয়েছি সে সব ওয়ার্ডের জনগোষ্ঠীর কাছে যেতে হয়, কিন্তু প্রয়োজনীয় ক্ষমতা ও অর্থ আমাকে প্রদান করা হয় না। ফলে জনগণের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হই। অনেকেই মনে করেন নারী ভাইস চেয়ারম্যানরা কোন কাজ করেন না। আর এ কারণে পরবর্তীতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ এবং জয়লাভ করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় হতে নারী জনপ্রতিনিধিদের বাজেট বরাদ্দ বিষয়ে সুস্পষ্ট নীতিমালা নাই। অনেক ক্ষেত্রে কাজ করতে গিয়ে চেয়ারম্যানের সহযোগিতা পাই না এবং পুরুষ সদস্যরা সবাই জোট বেঁধে কাজ করে। কখনও কখনও আমাকে দিয়ে শুধু কাগজে স্বাক্ষর করানো হয়। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় দলীয় নেতাদের প্রভাব নারী জনপ্রতিনিধিদের জন্য এখন একটি বড় চ্যালেঞ্জ।’ ২৩ জুলাই সকাল সাড়ে ১০টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে ‘নারীর ক্ষমতায়নের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ বিষয়ে স্থানীয় সরকারের নারী পৌর মেয়র এবং উপজেলা নারী ভাইস চেয়ারম্যানদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ২১ জেলা থেকে আগত ৬০ নারী ভাইসচেয়ারম্যান তাদের বক্তব্যে বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। সভায় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দৈনিক সমকালের উপ-সম্পাদক অজয় দাশগুপ্ত। সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম। সভাপতির বক্তব্যে সংগঠনের সভাপতি আয়শা খানম বলেন, স্থানীয় সরকার এ্যাক্ট এ স্থানীয় এমপির এবং প্রশাসনের খবরদারির বিষয়ে মহিলা পরিষদ সংশোধনের সুপারিশ দেয়। তিনি আরও বলেন তৃণমূলে নারীরা এলে স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হয়, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী হলে গণতন্ত্র ভিত্তি পায়। সব পুরুষরাই নারীর শত্রু নয়। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতেও থাকার কারণে নারী ভাইস চেয়ারম্যানরা নানান প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। পুরুষতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের জন্য আমাদের কাজ করতে হবে। নিজ নিজ রাজনৈতিক দলেন মধ্যেও পিতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে সকলকে লড়াই করার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নে কেউ পেছনে থাকবে না, সরকারের এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে নারী ভাইসচেয়ারম্যানরাও এগিয়ে আসবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। এই সভা থেকে প্রাপ্ত সুপারিশসমূহ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে বলে আয়শা খানম উল্লেখ করেন। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে দৈনিক সমকালের উপ-সম্পাদক অজয় দাশগুপ্ত বলেন, ‘জনপ্রতিনিধি যারা হন তাদের অনেক শ্রম দিতে হয়। সব দলেরই নারীদের মনোনয়ন দেয়া উচিত বলে তিনি উল্লেখ করেন। আমাদের দেশে রাজনীতিতে ৩৩% নারী কোটার কথা আছে কিন্তু তার বাস্তবায়ন নেই। উপজেলা ৫০০ এর মতো নারী ভাইস চেয়ারম্যান রয়েছে। একাধিক জরিপে দেখা গেছে, স্থানীয় সরকারে নারী জনপ্রতিনিধিদের প্রভাব বা প্রতিপত্তি খাটানোর জায়গা আছে সেখানে দুর্নীতি কম হয়।’ সভায় মুক্ত আলোচনায় ২২ ভাইসচেয়ারম্যান অংশগ্রহণ করেন। সকলের বক্তব্যেই উঠে আসে দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তাদের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কথা। তারা জানান, ভিজিটি কার্ডগুলো চেয়ারম্যানের মাধ্যমে বরাদ্দ হচ্ছে যা তারা জানেন না। তারা আরও বলেন, সম্মানী ভাতা দ্বিগুণ করা হয়েছে কিন্তু তার বাস্তবায়ন এখনও হয়নি। নির্বাচনী এলাকার তুলনায় নারী জনপ্রতিনিধিদের সম্মানী অনেক কম বলে তারা জানান। তাদের আলোচনায় একটি বড় বিষয় উঠে আসে তা হলো যাতায়াতের ব্যবস্থার সমস্যা। তবে কোন কোন উপজেলায় বাল্যবিবাহ অনেকাংশে রোধ করতে পেরেছে বলে তারা উল্লেখ করেন। বরাদ্দের মোট কত অংশ নারীকে দেয়া হবে তা যদি উল্লেখ করে দেয়া হয় তাহলে তারা ভালভাবে কাজ করতে পারবেন বলে উল্লেখ করেন ভাইসচেয়ারম্যানরা। নিজেদের একান্ত সমস্যার কথাগুলো বলার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার আশা প্রকাশ করেন তারা। সভায় সরকার ও রাজনৈতিক দলকে উদ্দেশ্য করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পক্ষ থেকে সুপারিশ রাখা হয়। সুপারিশগুলো হলো- প্রশাসনিক কাঠামোর সকল পর্যায়ে, বাংলাদেশের বিদেশী দূতাবাসগুলোতে রাষ্ট্রদূত, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পরিকল্পনা কমিশন, ভূমি বণ্টন কমিটিসহ সব পর্যায়েই নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধিসহ সরকারের বিধি-বিধান অনুযায়ী সকল কোটা পূরণের বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে; স্থানীয় সরকারের প্রতিটি স্তরের নির্বাচিত নারী জনপ্রতিনিধিদের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি করে সরকার ব্যবস্থায় নারীর সমঅংশীদারিত্ব প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে জাতীয় বাজেটে তাদের কাজের জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখতে হবে; জনপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশ (আরপিও) ২০০৮ এবং ৩য় সংশোধনী ২০১৩ অনুযায়ী সকল রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সকল স্তরের কমিটিতে ৩৩% নারী আছে কিনা মনিটরিং করতে হবে এবং এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সেইসঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সুপারিশ রাখা হয়-কালো টাকা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, পেশিশক্তি মুক্ত স্থিতিশীল রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্য বাতিল করতে হবে; রাজনৈতিক দলগুলোর সকল স্তরের কমিটিগুলোতে অবাধ ও নিরাপদে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জেন্ডার সংবেদনশীল ইশতেহার, গঠনতন্ত্র, সমন্বিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতি, মুক্ত সংস্কৃতি চর্চার নীতিমালা প্রণয়ন ও তা যথাযথ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা থাকতে হবে; প্রতিটি দলের কার্যালয়ে নারীর কর্মপরিবেশ সুস্থ ও নারীবান্ধব হতে হবে।
×