ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইয়াবা চোরাচালান রোধে নাফ নদীতে রাতে মাছ ধরা বন্ধ কার্যকর

প্রকাশিত: ০৪:৩৭, ২৪ জুলাই ২০১৭

ইয়াবা চোরাচালান রোধে নাফ নদীতে রাতে মাছ ধরা বন্ধ কার্যকর

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমার থেকে মরণনেশা মাদকের চালান আসা বন্ধে শনিবার রাত থেকে নাফ নদীর বাংলাদেশ অংশে রাতে মাছ ধরা বন্ধ রাখতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ কার্যকর হয়েছে। তবে দিনের বেলা মৎস্য শিকার উন্মুক্ত থাকবে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এবং নির্দেশনা ঘোষিত হওয়ার পর মিয়ানমারের ইয়াবা ব্যবসায়ীরাও এখন বিকল্প পথ খুঁজতে তৎপর হয়েছে। সীমান্তের ওপার থেকে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, শনিবার রাতেই ৩৭ ইয়াবা ফ্যাক্টরি মালিকদের মধ্যে ১৬ এবং দশটি বড় সিন্ডিকেট প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এ বৈঠক হয়েছে মংডুর একটি হোটেলে। ওই বৈঠকে তারা ইয়াবার মূল্যও হ্রাস করেছে। এ খবর নিশ্চিত করে সীমান্তের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, রাতের বেলা মৎস্য শিকারের নৌযানযোগে ইয়াবা পাচার সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় তারা স্থল সীমান্তের পথকে প্রাধান্য দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে অনুযায়ী এখন চিন্তাভাবনা চলছে ইয়াবা এ দেশে প্রেরণের রুট হতে পারে মিয়ানমারের ঢেঁকিবুনিয়া ও তুমব্রু হয়ে। মংডু থেকে সরাসরি সড়কপথে বিভিন্ন যানবাহনযোগে ঢেঁকিবুনিয়া পর্যন্ত চলাচল রুট রয়েছে। এরপর কক্সবাজারের উখিয়া বালুখালী পর্যন্ত সীমান্তের ওপারে ঢেঁকিবুনিয়া এবং নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু বরাবর হচ্ছে মিয়ানমারের স্থল সীমান্ত এলাকা। মূলত এটি নদীপথ। তবে উভয় দেশে এ সীমান্ত পথে হেঁটে নদী পার হওয়া যায়। এখন এ পথটিই ইয়াবা চোরাচালানি সিন্ডিকেটের টার্গেট হয়েছে। সর্বশেষ টেকনাফের হ্নীলা ছুরিখাল পয়েন্ট দিয়ে পাচারকালে বিজিবি সদস্যদের হাতে ধরা পড়েছে ৩০ হাজার ইয়াবা। ছুরিখাল বরাবর নাফ নদীর তীরবর্তী কেওড়া বাগান দিয়ে ইয়াবার এ চালান হয়ে আসার বিষয়টি টের পেয়ে বিজিবি অভিযানে নামে। ফলে চালানটি ফেলে পাচারকারীরা পালিয়ে যায়। এছাড়া রবিবার দুপুরে উখিয়ার মরিচ্যা চেকপোস্টে কক্সবাজারগামী একটি বাসে অভিযান চালিয়ে ইয়াবাসহ এক মহিলাকে আটক করেছে। ইয়াবার আগ্রাসন বেপরোয়া পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার পর সরকার বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে রিপোর্ট নিয়ে পাচারের অন্যতম প্রধান রুট নাফ নদীর বিস্তৃত এলাকাকে চিহ্নিত করেছে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানানোর পর তিনি প্রাথমিকভাবে রাতের বেলায় নাফ নদীতে মাছ শিকার বন্ধের নির্দেশনা প্রদান করেন, যা শনিবার রাত থেকে কার্যকর হয়েছে। এতে করে টেকনাফ এলাকার ৩ হাজার জেলে রাতের বেলায় মাছ ধরা থেকে নিজেরা বিরত থাকতে হবে। অপরদিকে, মৎস্য বিভাগের হিসাব অনুযায়ী টেকনাফ থেকে বালুখালী পর্যন্ত নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা আরও বেশি। টেকনাফের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন সিদ্দিক রবিবার জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, নাফ নদীনির্ভর মৎস্য শিকারে নিয়োজিত জেলেদের তালিকা করা হয়েছে। ইয়াবা পাচার বন্ধে রাতের বেলায় এ নদীতে মৎস্য শিকার বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার পর জেলেদের কিভাবে পুনর্বাসন করা যায় সে বিষয়েও চিন্তাভাবনা চলছে। প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকাজুড়ে যে ৩৭টি কারখানায় ইয়াবা উৎপাদিত হয় এর সবই অবৈধ ও চোরাইপথে চলে আসে বাংলাদেশে। ইয়াবা চালানের প্রধান রুট নাফ নদী এবং সাগর এলাকা। প্রাথমিকভাবে নদীপথ বন্ধ রাখার পর সাগরপথ নিয়েও পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়ার চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। কেননা, বঙ্গোপসাগর দিয়েও মরণনেশা ইয়াবার চালান বাংলাদেশে বিশেষ করে চট্টগ্রামে এসে থাকে। আবার সরাসরি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে যায়। এসব চালান পৌঁছানোর ক্ষেত্রে সাধারণ ইঞ্জিনচালিত মাছ ধরার নৌকাগুলোই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। গত ৬ মে প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারের জনসমাবেশে ইয়াবার আগ্রাসন ঠেকাতে কঠোর হুঁশিয়ারি প্রদান করেন। তিনি স্থানীয় প্রশাসনকে এ বলে নির্দেশ দেন যে, এ ব্যবসায় জড়িতরা যতই শক্তিশালী হোক তাদের আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এর আগে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ইয়াবা পাচার রোধে যে রিপোর্ট পেশ করা হয় তাতে নাফ নদীতে মৎস্য শিকারকালে ছদ্মবেশী ইয়াবা ব্যবসায়ীদের চালান পাচারের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। টেকনাফ উপজেলার চারটি ইউনিয়ন হোয়াইক্যং, হ্নীলা, টেকনাফ সদরের কিছু অংশ, সাবরাং এবং পৌরসভা ও উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন এবং নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের বিপুলসংখ্যক জেলে নাফ নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহের কথা জানানো হয়েছে। মৎস্য অধিদফতরের তথ্য মতে, শুধু টেকনাফেই ৫ হাজার ১১৬ জেলের নিবন্ধ রয়েছে। এদের বড় একটি অংশ মূলত মাছ শিকারের বদলে ইয়াবা পাচার কাজে নিয়োজিত। নাফ নদীতে মৎস্য আহরণ কাজে নিয়োজিত হ্নীলার কালামিয়া, সৈয়দ, মোহাম্মদ আলী ও হোসেন আহমদ রবিবার জানিয়েছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে এসব জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও জরুরী। অন্যথায় জীবিকা নির্বাহের জন্য এরা নানা অপকর্মে জড়িয়ে যেতে পারে। পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ গফুর উদ্দিন চৌধুরীও জানান, এ সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী। এতে করে ইয়াবা চোরাচালান হয়ে আসার বড় রুটটিতে অবাধ তৎপরতা হ্রাস পাবে। ইয়াবা চোরাচালানে জড়িতদের তালিকা কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের কাছে ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িতদের যে তালিকা রয়েছে তাতে দেখা যায়, ৩০ সিন্ডিকেটের তথ্য। এতে ইয়াবা চোরাচালানের গডফাদার, এজেন্ট, বিনিয়োগকারীসহ পাচারকারীদের নাম রয়েছে। প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়েছে, নতুন আরেকটি তালিকা প্রণীত হচ্ছে। তাদের কাছে বর্তমানে যে তালিকাটি রয়েছে সে অনুযায়ী যাদের নাম রয়েছে তারা হচ্ছেÑ উখিয়া টেকনাফের এমপি আবদুর রহমান বদির দুই ভাই আবদুস শুক্কুর ও মুজিবুর রহমান, টেকনাফের লেংগুর বিলের মোস্তাক আহমদ, দিদার হোসেন, ডেইলপাড়ার মৌলভি বোরহান, নুরুল আমিন, জালিয়াপাড়ার সিরাজ মিয়া, শামসুন নাহার জ্যোতি, সৈয়দ আলম, উত্তর লম্বরের কামাল হোসেন, জাদিমুরার আবদুল্লাহ হাসান, একরামুল হক, চৌধুরীপাড়ার জহির, নাজিরপাড়ার জাফর, নুর আলম, আবদুর রহমান, নাইট্যংপাড়ার তৈয়ব মিয়া, পিচ্ছি আনোয়ার, জামাল, আনোয়ার, মৌলভীপাড়ার নুর হোসেন, হানিয়াখালার কবির আহমেদ ওরফে ইয়াবা কবির, শাহপরীর দ্বীপের ইব্রাহিম, হ্নীলার পানখালীর ফয়সাল, লেদার মোহাম্মদ আলম, ইসলামাবাদের হোছন, আবদুর রাজ্জাক, আবদুল্লাহ, মনুপাড়ার জাকির হোসেন, সদর এলাকার রমজান আলী, উখিয়ার মাহমুদুল হক খোলা, গোয়ালিয়ার মোস্তাক, বালুখালীর বক্তার মেম্বার, জাহাঙ্গীর, থাইনখালীর নুরুল আমিন মেম্বার, ফারুক, হৃীলার খারাংখালির মহিউদ্দিন, হেলাল উদ্দিন, নুরুল হুদা, বালুখালীর এনামুল হক, ঘুমধুমের সাহাব উদ্দিন, ইমাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন জলপাইতলী সিন্ডিকেট, মাহমুদুল হকের নেতৃত্বাধীন হাজিরপাড়া সিন্ডিকেট, নুরুল আলম পুতিয়া, আবদুর রহমান, বালুখালীর ঘোনারপাড়ার আবদুর রহিম, উত্তম, ইসলাম, ঘিলাতলীর আতাউল্লাহ, জালার, উখিয়া সদরের দেলোয়ার, হিজলিয়ার আলী আহমদ, জাহাঙ্গীর আলম, নুরুল আলম, বালুকিয়ার আকতআর, সিকদার বিলের আবদুল্লাহ, হারুন, দীঘিলিয়ার রহমান, লালু অন্যতম। এসবের বাইরেও সোনারপাড়া, খাইনখালি, জাদিমুরা, হলদিয়া পাতাবাড়ি, কুতুপালংসহ বিভিন্ন এলাকায় ইয়াবা চোরাচালানের সিন্ডিকেট রয়েছে। এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইয়াবা চোরাচালাীিদের বড় বড় গড়ফাদাররা কক্সবাজার সদরে, চট্টগ্রাম এমনকি ঢাকায়ও অবস্থান করেন। এদের অঙ্গুলি নির্দেশে ইয়াবা চোরাচালান হয়ে থাকে। মূল অর্থ যোগানদাতা এসব গডফাদার।
×