ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অবশেষে সেই ইউএনওর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা খারিজ

প্রকাশিত: ০৪:৩৪, ২৪ জুলাই ২০১৭

অবশেষে সেই ইউএনওর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা খারিজ

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ অবশেষে জেলার আগৈলঝাড়া উপজেলার সাবেক নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) গাজী তারিক সালমানের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলাটি খারিজ করে দিয়েছে আদালত। রবিবার বেলা সাড়ে ১১টায় বরিশালের অতিরিক্ত চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট অমিত কুমার দে মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন। গাজী তারিক সালমান বর্তমানে বরগুনা সদর উপজেলার ইউএনও হিসেবে কর্মরত। আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামলার বাদী বরিশাল আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও আওয়ামী লীগ থেকে সদ্য বহিষ্কৃত ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট সৈয়দ ওবায়েদ উল্লাহ সাজু মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করলে বিচারক তা মঞ্জুর করে মামলাটি খারিজ করে দিয়েছেন। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোঃ নুরুল আমিন বলেন, রবিবার মামলার নির্ধারিত তারিখ থাকায় ইউএনও গাজী তারিক সালমানের পক্ষ থেকে মামলা খারিজের আবেদন করা হয়েছিল। অপরদিকে মামলার বাদী তিনিও মামলা প্রত্যাহারের জন্য আবেদন করায় বিচারক মামলাটি খারিজ করে দেন। মামলাটি অন্যায়ভাবে করা হয়েছিল বলেও তিনি উল্লেখ করেন। মামলার নির্ধারিত তারিখে উর্ধতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে ইউএনও গাজী তারিক সালমান আদালতে উপস্থিত ছিলেন না। মামলার বাদী জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সদ্য বহিষ্কৃত ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক এ্যাডভোকেট সৈয়দ ওবায়েদ উল্লাহ সাজু বলেন, তিনি স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলাটি করেছিলেন এবং তেমনিভাবেই প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন। তিনি আরও বলেন, জাতির জনকের ছবি শিশুর আঁকা এটা তার জানা ছিল না। এ নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি থেকে এই ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে। পরবর্তীতে ভুলের অবসান হওয়ায় তিনি মামলা প্রত্যাহারের আবেদন করেছেন। আদালতের ছয় পুলিশ সদস্য ক্লোজ অপরদিকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার গাজী তারিক সালমানকে নাজেহাল করায় কোর্ট পুলিশের ছয় সদস্যকে ক্লোজ করা হয়েছে। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ের এক আদেশে তাদের কোর্ট থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ লাইনে সংযুক্ত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। এরা হলেন- মেট্রোপলিটন কোর্ট পুলিশের এসআই নৃপেন দাশ, এটিএসআই মোঃ মাহবুব, এটিএসআই শচীন, কনস্টেবল সাইফুল ইসলাম, হানিফ ও জাহাঙ্গীর হোসেন। শনিবার রাতে মহানগর পুলিশের মুখমাত্র ও গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার মোঃ শাখাওয়াত হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, প্রশাসনিক কারণে তাদের বদলি করা হয়েছে। সূত্রমতে, গত বুধবার জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বিকৃতির অভিযোগে দায়ের করা মামলায় বরিশাল চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির হয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনের আবেদন করেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার গাজী তারিক সালমান। ওইদিন বেলা সাড়ে ১১টায় প্রকাশ্য আদালতে বিচারক মোঃ আলী হোসাইন ইউএনও সালমানের জামিন আবেদন না মঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এরপর পরই আদালত ও হাজতখানায় দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা ইউএনও তারিক সালমানকে হাত ধরে আদালতের হাজতখানায় নিয়ে যায়। ওই সময়ের তোলা ছবিতে দেখা গেছে, এটিএসআই শচিন তার দুই হাত দিয়ে ইউএনও সালমানের ডান হাত ধরে আদালতের গারদখানায় নিয়ে যাচ্ছেন। ছবিতে এটিএসআই শচিনের ডান হাতে হাতকড়ার একাংশ এবং বাকি অংশ তার বাম হাত দিয়ে ইউএনও সালমানের ডান হাতে চেপে ধরতে দেখা যায়। তার পেছনে চার পাশে পুলিশ বেষ্টনী দিয়ে ইউএনওকে গারদে নিয়ে যাওয়া হয়। ইউএনও গাজী তারিক সালমান বলেন, তাকে সরাসরি হাতকড়া পড়ানো হয়নি। ওইদিন আদালতে প্রত্যক্ষদর্শী একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিচারক মোঃ আলী হোসাইন জামিন আবেদন নামঞ্জুর করার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে (আদালতে) উপস্থিত বাদী পক্ষের আইনজীবীরা হাতকড়া পরিয়ে ইউএনওকে হাজতে নেয়ার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেন। সে সময় আদালতে দায়িত্বে থাকা এটিএসআই শচিন আইনজীবীদের তোপের মুখে পড়েন। উপায়ান্তুর না পেয়ে ইউএনও’র প্রতি সম্মান দেখিয়ে হাতকড়া না পরিয়েই শচিন একটি হাতকড়া ইউএনওর হাতের ওপর রেখে নিজের বাম হাতের আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরায় অপর হ্যান্ডকাপটি ঝুলতে থাকে। যা দেখে মনে হয় ইউএনও গাজী তারিক সালমানের হাতে হ্যান্ডকাপ পরানো হয়েছে। এরপর ইউএনওকে হাটিয়ে আদালতের হাজত খানায় নিয়ে যান শচিন। কিন্তু কেউ বুঝতে পারেনি ইউএনওর হাতে হাতকড়া পরানো হয়নি। এটিএসআই শচিন বলেন, ইউএনও স্যারকে আমি কীভাবে হাতকড়া পরাব। আইনজীবীদের কঠোরতার কারণে এমনভাবে হাতকড়া হাতে নিয়েছি যাতে সকলের মনে হয়েছে ইউএনও স্যার হ্যান্ডকাপ পরিহিত। তাকে হাজতে নিয়ে যাওয়ার সময় ইউএনও স্যার একটি কথাও বলেননি, ছিলেন নিশ্চুপ। বলতে গেলে বিচারকের আদেশের পরে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। অপরদিকে মহানগর পুলিশ কমিশনার এসএম রুহুল আমিন বলেন, ইউএনও গাজী তারিক সালমানের বিষয়ে পুলিশ কোন বাড়াবাড়ি করেছেন কিনা এ বিষয়ে তদন্ত করার জন্য পুলিশ হেডকোয়াটার্স থেকে দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি রবিবার বরিশালে এনেছেন। ইউএনও’র বিরুদ্ধে মামলাকারী কে এই সাজু নাম তার সৈয়দ ওবায়েদ উল্লাহ সাজু। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবেই অনেকের কাছে বিবেচিত। অবশ্য তিনি সকলের কাছে বলেও বেড়ান সারাটা জীবন আওয়ামী লীগের সঙ্গে কাটিয়েছেন। যে কারণে স্বীকৃতিস্বরূপ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের কমিটিতে স্থান পেয়েছিলেন। কিন্তু সর্বশেষ আগৈলঝাড়া উপজেলার ইউএনওর বিরুদ্ধে মামলা করায় খোদ প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাই তার পদটি কেড়ে নিয়েছেন। এমতাবস্থায় বহিষ্কৃত ওই নেতাকে নিয়ে অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য। বিশেষ করে এসব কারণেই স্বদলীয় নেতারাও এখন সোজাসাফটা বলে ফেলেছেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ওবায়েদ উল্লাহ সাজু আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কখনই জড়িত ছিলেন না। তিনি এক সময় বিএনপির রাজনীতি করতেন। ভোলা জেলা বিএনপির সাবেক নেতা ও ধর্মবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মোশারেফ হোসেন শাজাহানের খুবই ঘনিষ্টজন ছিলেন ওবায়েদ উল্লাহ সাজু। ওই নেতার মৃত্যুর পর সাজুর প্রতাপ ক্ষীণ হয়ে আসে। যে কারণে তিনি পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন। অবশ্য ঘটনাচক্রে তাদের ওপর ভর করে আওয়ামী লীগেও ঢুকে যান। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তার কপাল খুলে যায়। বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আফজালুল করিম সাংবাদিকদের জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সবচেয়ে সুবিধাভোগী নেতা হলেন এ্যাডভোকেট সাজু। দলের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তিনি সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। সাবেক চীফ হুইপ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর পরিবারের হাত ধরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশ করেন এই সাজু। তারপরই বেপরোয়া হয়ে উঠেন তিনি। আর যে কোন অপরাধ করলে তার পক্ষে দাঁড়ান হাসানাত পরিবার। ফলে সাজুর রক্তচক্ষুর সামনে কেউই দাঁড়াতে পারে না। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বরিশাল কোর্টের এপিপি হন তিনি। পরে আওয়ামী লীগ আমলে আরও দুইবার তিনি এপিপি হন। সূত্রে আরও জানা গেছে, আইনজীবী পেশার আড়ালে সাজুর মূল ব্যবসা হচ্ছে কোর্টের দালালি। তিনি বিভিন্ন মামলার রায় ও জামিনের ব্যাপারে চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। বিরোধপূর্ণ জমিজমা নিয়ে মামলার বিষয়ে তার কাছে গেলে একপর্যায়ে নামমাত্র মূল্যে সেগুলো নিজেই ক্রয় করে নেন সাজু। পরে তা চড়ামূল্যে বিক্রি করেন। এভাবে এলাকায় কোটিপতি বনে গেছেন এ্যাডভোকেট সৈয়দ ওবায়েদুল্লাহ সাজু। সাজুর বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থার প্রস্তুতি ইউএনও গাজী তারিক সালমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদী সৈয়দ ওবায়েদ উল্লাহ সাজুর বিরুদ্ধে আইনী প্রক্রিয়া শুরুর প্রস্তুতি চলছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশন থেকে এই আইনী প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছেন। বরিশালের জেলা প্রশাসক ড. গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান সাংবাদিকদের জানান, রবিবার আদালতের কাছে আবেদনের প্রেক্ষিতে তারিক সালমানের বিরুদ্ধে মামলা সংক্রান্ত সব নকল সংগ্রহ করে বাংলাদেশ এডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এ্যাসোসিয়েশনে পাঠানো হবে। এর মধ্য দিয়েই আইনানুগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ব্যাপারে গাজী তারিক সালমান মোবাইল ফোনে জানান, আইনী প্রক্রিয়ার ওপর আমার ইচ্ছা বা অনিচ্ছার কোন বিষয় নেই, আমাদের এ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে যে সিদ্ধান্ত আসবে সেটাই গ্রহণ করব। ইউএনও’র জামিন না-মঞ্জুর করা বিচারকের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির মামলার দায়িত্বপ্রাপ্ত চীফ মেট্রোপলিটন আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আলী হোসাইন সার্কিট হাউসে সাত মাস থাকার পরও ভাড়া পরিশোধ করেননি বলে অভিযোগ উঠেছে। টাকা পরিশোধের জন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ওই বিচারককে চিঠি পাঠানো হলেও তিনি ইতিবাচক সাড়া দেননি। জেলা প্রশাসক ড. গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান জানান, চীফ মেট্রোপলিটন আদালতের বিচারক আলী হোসাইন সাত মাস সার্কিট হাউসে বাস করেছেন। এর মধ্যে ভাড়া দিয়েছেন কেবল চার দিনের। সার্কিট হাউসের দায়িত্বে থাকা এনডিসি মোহাম্মদ নাহিদুল করিম বলেন, দীর্ঘদিন ওই বিচারক এখানে বাস করায় তার কাছে ৯৩ হাজার ৯৫০ টাকা ভাড়া বকেয়া পড়েছে। বিষয়টি প্রথমে তাকে জানানো হলেও তিনি কোন সদুত্তর দেননি। পরে চিঠিও দেয়া হয়েছিল। তাতেও কোন কাজ হয়নি। সূত্রমতে, বকেয়া ভাড়া পরিশোধে ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট বিচারক আলী হোসাইনকে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নেজারত শাখার ডেপুটি কালেক্টর কল্যাণ চৌধুরী একটি চিঠি প্রেরণ করেন। এতে বলা হয়, ওই বিচারক বরিশাল সার্কিট হাউসের পুরাতন ভবনের সাত নং কক্ষটি ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে ২০১৬ সালের ২৮ জুন পর্যন্ত ব্যবহার করেছেন। কিন্তু ২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর থেকে ১ নবেম্বর পর্যন্ত চার দিনের মোট ৩৯০ টাকা ভাড়া পরিশোধ করেন। বাকি দিনগুলোর জন্য কোন ভাড়া দেননি। ওই চিঠি দেয়ার পরও অদ্যবধি বকেয়া ভাড়া পরিশোধ করা হয়নি।
×