ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রুটিন ওয়ার্ক নয়, উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগান

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ২৪ জুলাই ২০১৭

রুটিন ওয়ার্ক নয়, উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগান

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সরকারী চাকরিজীবীদের শুধু রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে দায়িত্ব পালন না করে উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে জনকল্যাণে নিবেদিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, শুধু রুটিন দায়িত্ব পালনে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে আরও কি কাজ করলে মানুষের কল্যাণ হয় সেটা চিন্তা করে সেভাবেই পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলেই দেশ এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী রবিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জাতীয় পাবলিক সার্ভিস দিবস উদযাপন ও জনপ্রশাসন পদক ২০১৭ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারী চাকরি যে একটা রুটিন চাকরি, আসলাম, বেতন নিলাম, চলে গেলাম সেটা নয়, নিজের ভেতরে উদ্ভাবনী শক্তি কি আছে সেটাও কাজে লাগাতে হবে। নিজেই নিজেকে আবিষ্কার করতে হবে। তিনি বলেন, যেখানে যে দায়িত্বপ্রাপ্ত তাকে সেখানে ভাবতে হবে এটা আমার নিজের দায়িত্ব, কারণ এই দেশটা আমার। দেশের মানুষগুলো আমার। কাজেই দেশের মানুষের কল্যাণে আমাদের কাজ করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আরেকটি বিষয় বলি-যেমন আপনারা একটি ভাল উদ্যোগ নিয়েছেন। খুলনার জেলা প্রশানক একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেখানে সকল সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আমাদের পুলিশ প্রশাসন এক দিনের বেতন দিয়ে একটি ফান্ড তৈরি করেছেন ভিক্ষুকমুক্ত করার জন্য। এই ভিক্ষুকদের হিসাব নিয়ে তাদের কর্ম সংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন। এই বিষয়টি আমার খুবই ভাল লেগেছে। আমি বলব-একটা উদ্ভাবনী কাজ তারা করেছেন। আমি জানতে চাইলাম এটা তারা করলেন কেন? উত্তর পেয়েছি আপনারা আমাদের এত বেতন বাড়িয়ে দিয়েছেন, সেক্ষেত্রে আমাদেরও জনগণের প্রতি যে দায়বদ্ধতা রয়েছে। যা থেকে ভাবলাম একটু সেবা করি। তিনি বলেন, কাজেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি যারাই এ ধরনের ফান্ড তৈরি করবেন সেখানে আমিও প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে কিছু অনুদান দেব। যাতে করে তারা এই কর্মসূচী সফলভাবে করতে পারেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাজেই এ ভাবে আমাদের চিন্তা করতে হবে, কোথায় কি সমস্যা আছে। বা প্রতিটি ক্ষেত্রেই কোন কাজটা করলে আমার দেশের মানুষের কাজে লাগবে, এভাবেই কাজ করতে পারলে দেশটা এগিয়ে যাবে। জনপ্রশাসন মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরা সাদেক বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোজাম্মেল হক খান ও অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। দুটি ক্যাটাগরিতে ১৪ জনকে পদক প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী। সরকারের সাফল্যে সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারিদের অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা পরিকল্পনা দিয়েছি। আপনারা মাঠ পর্যায়ে যারা এটি বাস্তবায়ন করেছেন তাদের সকলকে আমি আন্তরিক অভিনন্দন জানাই আর এটা অব্যাহত থাকুক সেটাই আমরা চাই। শেখ হাসিনা এ সময় জাতির পিতার ভাষণের উদ্বৃতি দিয়ে বলেন, সকল সরকারী কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন। যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি তাদের যেন কষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন। যারা অন্যায় করবে তাদের কঠোর হস্তে দমন করুন। কিন্তু সাবধান একটা নিরপরাধ লোকের ওপর যেন অত্যাচার না হয়। অর্থাৎ যে মানুষগুলোর অর্থদিয়েই সবকিছু চলছে তাদের কল্যাণ করে যেতে হবে। এদিকে কিন্তু জাতির পিতা নির্দেশ দিয়ে গেছেন এবং তার প্রতিটি কথাই দেশের কল্যাণের জন্য একান্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ২০১২ সাল থেকে গবর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট নামে একটি আলাদা শাখা খোলা হয়েছে। এই ইউনিটের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবন করে সরকারী সেবা প্রদান পদ্ধতি সহজ করা। পাশাপাশি সরকারী কাজের জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা। আপনাদের মনে রাখতে হবে বিশ্বায়ন এবং প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ফলে একদিকে মানুষের আচরণ এবং রুচিতে যেমন পরিবর্তন এসেছে, তেমনি মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক চিন্তাভাবনাসহ সবকিছু বদলে গেছে। তিনি বলেন, গবর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট এ পর্যন্ত ১৩১টি বিভিন্ন ধরনের উদ্ভাবন প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিভাগে পাঠিয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৬৮টি প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হয়েছে এবং ৬৩টি প্রস্তাব বাস্তবায়নাধীন আছে। এগুলো কিন্তু আপনাদেরই উদ্ভাবিত ধারণা। তিনি বলেন, ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার, কমিউনিটি ক্লিনিক, মোবাইল ব্যাংকিং ইত্যাদি সেবা চালু করা হয়েছে। সারাদেশে ৫ হাজার ২৭৫টি ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন করা হয়েছে। এ সকল সেন্টারে ১১৬ ধরনের সরকারী- বেসরকারী সেবা প্রদান করা হয়ে থাকে। কৃষি কার্ড ও ফেয়ার প্রাইস কার্ডের মাধ্যমে কৃষিপণ্য এবং খাদ্যপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা হয়েছে। মোবাইলের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা ও ডাক্তারি পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। এসএমএসের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি থেকে শুরু করে সকল পাবলিক পরীক্ষার ফল প্রকাশ, কৃষি তথ্য প্রেরণ, ব্যাংক এ্যাকাউন্ট খোলা, বিদেশ থেকে প্রবাসীদের অর্থ প্রেরণসহ অসংখ্য সুযোগ-সুবিধা দ্রুততম সময়ে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, সকল মন্ত্রণালয়ে ডিজিটাল নথি নম্বর ও ই-ফাইলিং চালু করা হয়েছে। জনগণের অধিকার রক্ষার্থে সকল দফতরে দ্বিতীয় প্রজন্মের সিটিজেন চার্টার প্রবর্তন করা হয়েছে। এর আওতায় মাঠ পর্যায়ের অফিসসমূহে হেল্প ডেস্ক স্থাপন করা হয়েছে। প্রত্যেক মন্ত্রণালয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সঙ্গে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি স্বাক্ষর করছে। সে চুক্তিতে কোন কোন বিষয়ে আগামী বছর ঐ মন্ত্রণালয় কাজ করবে তার বিবরণ থাকে এবং কার্যক্রমগুলো বছর শেষে মূল্যায়ন হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ২৩ বছরের নিরন্তর আন্দোলন-সংগ্রাম আর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। জাতির পিতা স্বাধীনতার ডাক না দিলে আজও হয়ত আমাদের পরাধীনতার গ্লানি বহন করতে হতো। স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশকে নানামুখী সঙ্কট মোকাবিলা করতে হয়েছে। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্র, অপশাসন ও দুঃশাসন, দীর্ঘ সময় ধরে গণতন্ত্রহীনতা, দারিদ্র্য, নিরক্ষরতা, সন্ত্রাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করেছে। এ সকল প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে বাংলাদেশ আজ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। গত এক দশকে দারিদ্র্য হ্রাস এবং সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচকে বাংলাদেশের সাফল্য অভাবনীয়। মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬০২ মার্কিন ডলার। ২০০৫-০৬ অর্থবছর যা ছিল ৫৪৩ মার্কিন ডলার। দারিদ্র্যের হার ২০০৫-০৬ সালের ৪১.৫ শতাংশ থেকে কমে ২২ শতাংশ হয়েছে। গড় আয়ু বর্তমানে ৭২ বছরে উন্নীত হয়েছে। পাশাপাশি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার হার বৃদ্ধি, নারীর ক্ষমতায়ন, স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার হ্রাসসহ অন্যান্য আর্থ-সামাজিক সূচকে আমাদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে নিয়মিতভাবে মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করে সরকারী কর্মচারীদের পদোন্নতি প্রদান করছি। এ ছাড়া সরকারী কর্মচারীদের বেতনভাতা ২০১৫ সালের পে-স্কেলে ১২২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমরা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় বাস্তবায়নে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছি। আমাদের সামনে এখন ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের চ্যালেঞ্জ। ইতোমধ্যে ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় এসডিজি’র লক্ষ্যমাত্রার ভিত্তিতে মন্ত্রণালয়/বিভাগভিত্তিক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে।
×