ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:৩১, ২৩ জুলাই ২০১৭

মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক বাংলাদেশ

অর্থনৈতিক উন্নয়নে মৎস্য সেক্টরের অবদান অসামান্য। আমাদের দেশজ উৎপাদনের ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ, মোট কৃষিজ আয়ের ২২ দশমিক ৬ শতাংশ এবং রফতানি আয়ের ৪ শতাংশের অধিক আসে মৎস্য উপখাত থেকে। দৈনন্দিন খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ জোগান দেয় মৎস্যখাত। আমাদের দেশে মোট বদ্ধ জলাশয়ের পরিমাণ ৪ লাখ ১২ হাজার ৩৪১ হেক্টর। তার মধ্যে ২৬ হাজার হেক্টর পুকুর, ৫ হাজার ৪৮৮ হেক্টর হাওড় এবং ১ লাখ ৪১ হাজার ৩৫৩ হেক্টর চিংড়ি খামার। বিভিন্ন উপাত্ত থেকে জানা যায়, দেশের প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ বা ১১ শতাংশ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্যখাতে জীবিকা নির্বাহ করে। বছরে প্রায় ৬ লাখ নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে এই মৎস্য সেক্টরে। নদ-নদী, খাল-বিল, পুকুরসহ জলাধারের সংখ্যা হ্রাস পেলেও আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের জন্য উৎপাদন বিস্ময়করভাবে বাড়ানো সম্ভব হয়েছে। রূপকল্প-২০২১ অনুযায়ী মাছের উৎপাদন ৪২ লাখ টনে উন্নীত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং মৎস্য অধিদফতর যৌথভাবে কাজ করছে। উৎপাদন বৃদ্ধিতে নতুন আশা মাছের উৎপাদন-সাফল্য উৎসাহজনক হলেও উৎপাদন সম্ভাবনা রয়েছে এর চেয়ে বহুগুণ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত এক দশকে মাছের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ। মৎস্য উৎপাদন বাড়ায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয় থেকে মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশ্বে চতুর্থ এবং অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয়ে পঞ্চম স্থান লাভ করেছে। বিবিএসের সর্বশেষ অর্থনৈতিক শুমারি অনুযায়ী দেশে গড়ে মাছের বার্ষিক উৎপাদন সাড়ে ৩৫ লাখ টন। যার বাজারমূল্য প্রায় ৫৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে চাষ করা মাছের পরিমাণই প্রায় ২০ লাখ টন। জাটকা সংরক্ষণের ফলে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে এখন সাড়ে ৩ লাখ টন। দেশের প্রায় ১ লাখ হেক্টর জমিতে সামাজিকভাবে প্রচলিত পদ্ধতিতে ৩৫ হাজার টনের চিংড়ি উৎপাদিত হয়। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, সঠিকভাবে চিংড়ি চাষ করা সম্ভব হলে- দেশের প্রায় ২ লাখ ৩০ হেক্টর জমিতে থাইল্যান্ডের মতো অর্থনৈতিক ও পরিবেশবান্ধব উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে আড়াই লাখ টন চিংড়ি উৎপাদন করা সম্ভব। শুধুমাত্র ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রতি বছর ৫ হাজার কোটি টাকার চিংড়ি উৎপাদন করা সম্ভব। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট মৎস্যসম্পদের উৎপাদন ও প্রজনন বৃদ্ধির লক্ষ্যে গবেষণায় ১৬ শতাংশ অধিক উৎপাদনশীল রুইজাতীয় মাছের নতুন জাত এবং দেশীয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে চাষ ব্যবস্থাপনা ও প্রজননবিষয়ক ৪৯টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। ফিরে আসবে দেশীয় মাছ আশির দশকে বাংলাদেশের মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত উন্নত জাতের পাঙাশ, রুই, কাতল, তেলাপিয়া চাষ তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উন্নত জাতের কই, শিং, মাগুর, শোল মাছের চাষ ব্যাপক হারে বেড়েছে। কয়েক বছর ধরে দেশীয় প্রজাতির মাছ শোল, মাগুর, শিং, কৈ, পুঁটি, সরপুঁটি, বাইন, টাকি, পাবদা, ফলি, মলা, গোলসা, টেংরা, ভেদা, বোয়াল, কালো বাউশ চাষ করা হচ্ছে। সারাবছরই এসব মাছ বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। মৎস্য অধিদফতরও ৫৪ প্রজাতির মাছকে ঝুঁকিপূর্ণ, ২৮ প্রজাতির মাছ বিপন্ন ও ১২ প্রজাতির মাছকে মহাবিপন্ন হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তবে ভাল খবর হলো-সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ফিরে আসছে শিং, বাটা, সরপুঁটি, ভাঙগনা, কালিবাউশ, গনিয়া, মহাশোল, পাবদা, মাগুর, চিতল ও ফলি বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় মাছ। মৎস্য অধিদফতরের পরিচালনায় বিলুপ্তপ্রায় এসব মাছ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বাড়াতে জলাশয় ভরাট ও দূষণ রোধের পাশাপাশি মাছের অতি আহরণ ও প্রাকৃতিক উৎস থেকে পোনা সংগ্রহ বন্ধ করা, উন্মুক্ত জলাশয়ে পোনা অবমুক্তি ও বিল নার্সারি কার্যক্রমও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জানা গেছে, দেশী ছোট মাছের প্রজাতি সংরক্ষণ, প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির জন্য ৩৮টি জেলার ৭৫টি উপজেলার ১৩৬টি প্রাকৃতিক জলাশয় পুনঃখনন করা হয়েছে। এসব জলাশয়ে পোনা অবমুক্ত করা হয়েছে। ৫৭টি সরকারী মৎস্যবীজ উৎপাদন খামারে দেশী প্রজাতির ছোট মাছের কৃত্রিম প্রজননের ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেশী প্রজাতির মাছ চাষ ও ব্যবস্থাপনায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে ৬ হাজার ৪৬৬ জন চাষীকে। মাছে স্বয়ংসম্পূর্ণ হোক বাংলাদেশ ২০২২ সাল নাগাদ বিশ্বে যে চারটি দেশ মাছ চাষে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করবে, তার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। বাংলাদেশের পরিবেশ ব্যবস্থা মিঠাপানির মাছ চাষের জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান। জাতিসংেঘর খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। বাংলাদেশ সরকার ভিশন ২০২১-এ দেশের মাছের উৎপাদন ৪৫.০ লাখ টন নির্ধারণ করেছে যা বর্তমান উৎপাদনের চেয়ে ১০ লাখ টন বেশি। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনার পাশাপাশি সামুদ্রিক মাছ আহরণের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। সমুদ্রে মাছ আহরণের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন ২৫তম। বঙ্গোপসাগরে ৩৬ প্রজাতির চিংড়ি ছাড়াও প্রায় ৫০০ প্রজাতির অর্থকরী মাছ রয়েছে। এই মাছের অতি সামান্যই মাত্র আহরিত হয়। ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রজয়ে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকায় মাছ ধরার আইনগত অধিকার পেয়েছে বাংলাদেশ। ফলে বঙ্গোপসাগর থেকে মৎস্য আহরণ পর্যায়ক্রমে বাড়বে। এক হিসাবে দেখা গেছে, প্রতিবছর অব্যবস্থাপনা ও অবহেলায় উৎপাদিত মাছের একটা বড় অংশ, প্রায় ১০ লাখ টন নষ্ট বা অপচয় হয়ে যায়। এটা রোধ করতে পারলে মাছ উৎপাদনে দেশে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হবে।
×