ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাহাড় কাটার নেপথ্যে ॥ রাজনৈতিক ব্যানার

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৩ জুলাই ২০১৭

পাহাড় কাটার নেপথ্যে ॥ রাজনৈতিক ব্যানার

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ ধসছে আর ধসছে। একের পর এক পাহাড় ধসে যাচ্ছে। প্রাণ হারাচ্ছে অগণন সহায়-সম্পদহীন নারী-পুরুষ ও শিশু। অবৈধ হলেও বাড়িঘর সহায়-সম্পদ ও স্বজন হারানোর বেদনায় কেবলই আহাজারি দৃশ্যমান। আরও যে ধসবেÑএ ক্ষেত্রও প্রস্তুত করা আছে। প্রকৃতিকে ধ্বংস করে আর কত ধস ও প্রাণহানি ঘটলে এ অবৈধ কর্মকা-ের অবসান আদৌ হবে কিনা, তাই এখন প্রধান জিজ্ঞাস্য হয়ে আছে। চট্টগ্রামে পাহাড়ের পর পাহাড় মনুষ্য কালো হাতের হিংস্র ছোবলে বিলীন হয়ে গেছে, অবশিষ্টটুকুও যাচ্ছে। বর্তমানেও অর্ধকাটা বা কাটা অবস্থায় পাহাড়ের বড় বড় অংশ ধসে পড়ছে। সবুজের সমারোহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি আর প্রকৃতির রূপে থাকছে না। এখন প্রকৃতিও যেন প্রতিশোধের নেশায় মেতে উঠেছে। রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক প্রভাবশালী চক্রের সঙ্গে পাহাড়খেকো গোষ্ঠীর যোগসাজশে সর্বনাশা এ খেলা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার বোধহয় যেন কোন উপায় নেই। কারা পাহাড় কাটছে, ধ্বংস করছে, বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলছে সবই ওপেন সিক্রেট। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন যেন অসহায়ত্ব বরণ করে আছে। আবার প্রশাসনের অসাধু চক্র নেপথ্যের যোগসাজশের বিনিময়ে পাহাড় ধসে সহযোগিতা দিয়ে বিত্তের পাহাড় গড়ে তুলছে। প্রতিটি সরকার আমলে এ বিষয়টি দৃশ্যমান। কিন্তু কারও যেন মাথাব্যথা নেই। একের পর এক নির্বিচারে পাহাড় কেটে ছিন্নমূলদের বসতি স্থাপনের সুযোগ দিয়ে কাড়ি কাড়ি অর্থ একটি চক্র হাতিয়ে নিচ্ছে সত্য, কিন্তু প্রকৃতিও যে নির্মম হতে পারে তা বর্তমান সময়ে সকলের কাছে একেবারে খোলাসা হয়ে গেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকাজুড়ে পাহাড় ধসের ঘটনা সবচেয়ে বেশি। প্রাণহানিও অগণন। অবৈধ এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকায় আগামীতে পাহাড় ধসের পরিণাম আরও যে ভয়াল রূপ নেবে বর্তমানে তার সঙ্কেত মিলে গেছে। সঙ্গত কারণে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠিত মহলের পক্ষ থেকে আবারও দাবি উঠেছে, যেটুকু এখনও আছে তা রক্ষা করার জন্য। বর্ষণ মানেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং আতঙ্কের। নদনদী ও সবুজে ঘেরা বাংলাদেশে ঋতু বৈচিত্র্যের সঙ্গে রয়েছে বর্ষার চিত্র। আবহমান কাল থেকেই ছয় ঋতু নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশে এ দেশের মানুষের জীবনযাত্রা। কিন্তু বর্ষা মানেই এখন বন্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলজট, পাহাড়ধস, সঙ্গে প্রাণহানির ঘটনা। এ নিয়ে বর্তমান সময়ে বড় ধরনের দুশ্চিন্তা প্রোথিত হয়েছে জনমনে। বৃহত্তর চট্টগ্রামের পুরো জনপদটিই পাহাড়ঘেরা। বন্যা, জলজটের চেয়ে পাহাড় ধসের ঘটনা সর্বমহলে বড় ধরনের আতঙ্কজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বৃহত্তর চট্টগ্রামে প্রতি বর্ষা মৌসুমে একের পর এক পাহাড় ধস। সঙ্গে প্রাণহানি। আরও রয়েছে সহায়-সম্পদ বিলীন হওয়ার ঘটনা। বিগত ২০০০ সাল থেকে পাহাড় ধসের ঘটনাটি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। এরপরে চলতি মৌসুম পর্যন্ত কখনও বড় কখনও ছোট কখনও মাঝারি আকারে পাহাড় ধসের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। পাহাড় ধসে যারা প্রাণ হারাচ্ছে অধিকাংশই ছিন্নমূল, বাস্তুহারা অর্থাৎ দরিদ্র অসহায় জনগোষ্ঠীর সদস্য। গত বিশ বছরে পাহাড় ধসে প্রাণহানির সংখ্যা প্রায় ৭০০। কেন এই পাহাড় ধস? কেন এই প্রাণহানি? এ নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলসহ বিভিন্ন সূত্রে রয়েছে অভিন্ন বক্তব্য। ধসের ঘটনা রোধে নানা সময়ে সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে নানা কমিটি হয়েছে। রিপোর্ট পেশ করা হয়েছে। কিন্তু সবই ফাইলবন্দী। কার্যকারিতা বলতে কিছুই নেই। ফলে বছর বছর ধসের ঘটনা লক্ষণীয়। সঙ্গে প্রাণহানির ঘটনা তো বটে। এবারের বর্ষা মৌসুমে এ যাবতকালের বৃহত্তম পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে পাহাড়ে। অর্থাৎ পার্বত্যাঞ্চলের তিন জেলায়। যার ক্ষত শুকাতে সময় লাগে দীর্ঘ। বিশেষ করে রাঙ্গামাটি জেলা শহরজুড়ে সর্বত্র ধ্বংসস্তূপ পরিস্থিতি। অপর দুই জেলা অর্থাৎ খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পরিস্থিতি অপেক্ষাকৃত ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানির দিক থেকে কম। কিন্তু জনজীবনে দুর্ভোগের কমতি ঘটেনি। সর্বত্র সৃষ্টি হয়ে আছে হাহাকার পরিস্থিতি। ইতোপূর্বে পাহাড়ে এ ধরনের একযোগে পাহাড় ধসের ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টির কোন ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু এবার ঘটেছে। এ ঘটনা কিসের পূর্বাভাস তা এখনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে ঘোষণা আসেনি। কিন্তু তটস্থ হয়ে আছে পাহাড়ের মানুষ। কেননা, এবার একযোগে পাহাড়ের সর্বত্র যে ধসে বিপর্যয় নেমে এসেছে তা অকল্পনীয়। পাহাড়ী এলাকা ছাড়াও মহানগরী চট্টগ্রাম থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি পর্যন্ত এ পরিস্থিতি এখন লক্ষণীয়। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ২০০০ সাল থেকে পাহাড় ধসের চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম সেনানিবাসসংলগ্ন এলাকায় পাহাড় ধসে সর্বোচ্চ প্রাণহানির ঘটনা ঘটে, যার সংখ্যা ছিল ১২৬। পরবর্তীতে এর সঙ্গে আরও ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। মীরসরাই থেকে সীতাকু- হয়ে চট্টগ্রাম মহানগরী এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত পাহাড়ের কোথাও না কোথাও প্রতি বর্ষা মৌসুমে পাহাড় ধসে যাচ্ছে। প্রাণহানিসহ অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা বৃদ্ধিই হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে অভিযোগ করা হচ্ছে, পাহাড় ধসের নেপথ্যে রয়েছে মনুষ্যসৃষ্ট নানা ঘটনা। মানুষ বাড়ছে, নতুন নতুন বসতিও গড়ে উঠছে। বিত্তবানরা নগর এলাকায় ইট-পাথরে গড়া দালানে বসতি গড়ছে। আর অসহায় ছিন্নমূল দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষ বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে একাধারে কখনও এককভাবে কখনও দলবদ্ধ হয়ে বসতি গড়ে তুলছে। আর এ জন্য পাহাড়ের পাদদেশ কাটা হচ্ছে নির্বিচারে। ফলে বিভিন্ন পাহাড়ের ভিত নড়বড়ে হয়ে আছে। দীর্ঘ সময়ের এ ধরনের পরিস্থিতি অব্যাহত থাকার কারণে এখন একে একে ধসে পড়ছে পাহাড়। বিষয়টিকে অনেকে প্রকৃতির নির্মম প্রতিশোধ হিসেবেই দেখছেন। পাহাড়ের দেড় ফুট নিচেই বালু চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও ভূমিকম্প নিয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ ড. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন, এ অঞ্চলের পাহাড়গুলো মাটি ভূপ্রকৃতিগত গঠনের দিক থেকে নরম। তার মতে, পাহাড়ের চূড়া থেকে এক থেকে দেড় ফুট শক্ত থাকলেও অবশিষ্ট পুরো অংশই বালি দিয়ে গড়া এবং নরমও। এ অবস্থায় পাহাড়ের পাদদেশ যখন মনুষ্য আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় তখন উপরিভাগ স্বাভাবিকভাবে নড়বড়ে হয়ে পড়ে। বর্ষা মৌসুম এলে বর্ষণ শুরু হয়। এতে ধসের ঘটনা পরিলক্ষিত হয় না। কিন্তু বর্ষণ অব্যাহত থাকলে কোথাও না কোথাও পাহাড়ের কোন না কোন অংশ ধসে পড়ে। কখনও কখনও এটি মাঝারি, ছোট বা বড় আকৃতির হয়ে থাকে। ফলে পাদদেশে গড়ে ওঠা অবৈধ বসতিগুলো মাটির নিচে চলে যায়। আর এতে করে প্রাণহানি ও সহায় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে। মহানগরীতে চট্টগ্রাম সেনানিবাসসংলগ্ন এলাকায় পাহাড় ধসে বিপুল প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে দেশজুড়ে হৈচৈ পড়ে যায়। সরকারী পর্যায়ে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। এ কমিটি সরেজমিনে তদন্ত চালিয়ে ৩৬ দফা সুপারিশ সংবলিত যে রিপোর্ট পেশ করে তা অদ্যাবধি কার্যকর হয়নি। বিষয়টি অন্তত দুঃখজনক বলে নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছে। এসব সুপারিশের ধারে কাছেও বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো যায়নি। উল্টো ঘটেই চলেছে নির্বিচারে পাহাড় কর্তন। বৃহত্তর চট্টগ্রাম এলাকা যেহেতু পাহাড়ী পরিবেশে গড়ে উঠেছে সে ক্ষেত্রে পাহাড় কাটা ছাড়া উন্নয়নও একটি অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু কাটার বিষয়টি সম্পূর্ণ অপরিকল্পিত এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সদস্যরা তা কাটছে সম্পূর্ণ অবৈধ অর্থাৎ কোন ধরনের অনুমোদন ছাড়াই। বছরের পর বছর এ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকার প্রেক্ষাপটে পাহাড় নিজের অস্তিত্ব আর ধরে রাখতে পারছে না। একে একে ধসে পড়ছে। সরানো সম্ভব হয় না অবৈধ বসতি পাহাড় ধসের ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সভা-সমাবেশ সেমিনার সিম্পোজিয়াম কম হয়নি। বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে রিপোর্টার পর রিপোর্ট প্রদান করা হয়েছে। কিন্তু সবই থাকে ফাইলবন্দী। উল্টো এসব পাহাড়ে অবৈধভাবে বসতি যারা গড়েছে তারা রহস্যজনক হলেও সত্য যে, সরকারী সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে অবাধে বিদ্যুত, পানি, গ্যাস ইত্যাদি সংযোগ যায়। ফলে এদের অবস্থান অবৈধ হলেও সুসংহত। বর্ষা মৌসুম এলেই সরকারের পক্ষ থেকে জেলাসহ বিভিন্ন প্রশাসন অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থতা ছাড়া কোন ধরনের সফলতা আনতে পারছে না। এ বিষয়টি অবৈধ বসবাসকারীদের ভিত প্রকারান্তরে মজবুত করে দিচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে মাইকিং করে অবৈধ বসবাসকারীদের সরে যাওয়ার নির্দেশনা প্রদান করা হয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে সরানোও হয়। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, একই অবস্থা। অর্থাৎ পূর্বের রুট। পরিস্থিতি এমন যে দিনে সরানো হয়েছে, রাতে পুনরায় নিজ নিজ স্থানে ফিরে এসেছে। আবার রাতভর অভিযান চালিয়ে এসব অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের সরানো হয়েছে, বাড়িঘর উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা যায়, আবারও নতুন নতুন বসতি গড়ে উঠার দৃশ্য। এ যেন গা সওয়া পরিস্থিতি। ছিন্নমূলরাও জানেন, এসব বিষয় সাময়িক। আর প্রশাসনও জানে স্থায়ীভাবে এদের সরানো কঠিন। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন ও রাজনীতির ব্যাপারে নিজেদের অস্তিত্ব প্রকাশ করার বিষয়টি তো রয়েছেই। ছিন্নমূলদের ব্যানারে রয়েছে একাধিক সংগঠন। এতের নেতৃত্ব দিয়ে থাকে রাজনৈতিক দলীয় ব্যানারের কিছু নেতা। উচ্ছেদ অভিযান চালালেই শুরু হয় প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল। স্মারকলিপি পেশ। অর্থাৎ এরা অবৈধ প্রক্রিয়াকে জোর করে বৈধতা নিতে চায়। এভাবে নিয়ে আসছে পাহাড়ের পর পাহাড়ের পাদদেশে অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সদস্যদের আগ্রাসন। ফলে পাহাড় আর পাহাড়ের রূপে থাকছে না। এছাড়া অবৈধভাবে পাহাড় কেটে মাটি সরবরাহের ব্যবসা তো রয়েছেই। চট্টগ্রামে পাহাড়ের পর পাহাড় কেটে সমতল ভূমি বানিয়ে আবাসিক এলাকাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এসব আবাসিক এলাকা ও প্রতিষ্ঠানে বসতি বা কলকানা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সেবামূলক সরকারী সংস্থাগুলো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থায়ও অনুমোদন দিচ্ছে। ফলে পাহাড় কাটার বিষয়টি স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। নেপথ্য রাজনৈতিক ব্যানারে প্রভাবশালীরা চট্টগ্রামে পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তোলার সঙ্গে নেপথ্য সংশ্লিষ্টতা রয়েছে রাজনৈতিক দলীয় ব্যানারের প্রভাবশালীদের। প্রতিটি এলাকায় মাস মাস চাঁদা দিয়ে এসব অবৈধ বসবাসকারীরা নির্বিঘেœ জীবনযাপন করে যাচ্ছে। পক্ষান্তরে, অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের একটিই দাবিÑ তারা সহায়-সম্বলহীন, বাস্তুহারা, নদীভাঙ্গা এলাকার। জীবিকার সন্ধানে তারা শহর এলাকায় ছুটে আসে। শহর এলাকায় বাড়ি ভাড়ার উচ্চমূল্যের কারণে তারা বেছে নেয় পাহাড়ী পাদদেশ বা সরকারী খাসজমি। এসব পাহাড়ী পাদদেশ ও খাসজমি নিয়ে এলাকাভিত্তিক থাকে প্রভাবশালীদের আধিপত্য। এদের কাছে চাঁদা না দিয়ে সহায়-সম্পদহীন এসব ছিন্নমূলদের বসতি গড়ে তোলা অসম্ভব। ফলে বাধ্য হয়ে তারা চাঁদা দেয়। বিপরীতে সুযোগ পেয়ে যায় বসতি গড়ে তোলার। অভিযোগ রয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও প্রভাবশালীদের কাছ থেকে চাঁদার ভাগ পেয়ে থাকে। সবই যেন এক চেইনে নিয়ন্ত্রিত। সঙ্গত কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রামে অবাধে যেমন পাহাড় কাটা হয়, তেমনি বসতিও গড়ে উঠছে যত্রতত্র। এভাবে পাহাড় অত্যাচারিত হয়ে আসছে দীর্ঘকাল থেকে। এখন যেন পাহাড় নিজ নিয়মে প্রতিশোধে মেতে উঠেছে। পাহাড় নিজের অবস্থানকে ধরে রাখতে না পেরে ধসে যাচ্ছে। আর পাদদেশে গড়ে ওঠা বসতিগুলো মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। পাশাপাশি অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছে। এসব ঘটনা নিযে জেলা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তাদের বক্তব্যে রয়েছে অসহায়ত্ব। আকারে ইঙ্গিতে তাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া না হলে কোন প্রশাসনের পক্ষে অবৈধ বসতি গড়ে তোলা, এর পাশাপাশি পাহাড় কাটা কোনভাবেই বন্ধ করা যাবে না। সরকারের পক্ষে যত উদ্যোগই নেয়া হোক না কেন সবই ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষজ্ঞ পর্যায় থেকে সুপারিশকৃত রিপোর্ট বাস্তবায়ন করতে গেলেই নানা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। যা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের পদ নিয়ে টানাটানি ঘটনা পর্যন্ত গড়িয়ে যায়। এদিকে, নির্বিচারে পাহাড় কাটার কারণে নগরীর সবকটি খালই এখন পাহাড়ী মাটিতে ভরে একাকার হয়ে আছে। এর সঙ্গে যুক্ত হযেছে নগরবাসীর নিক্ষিপ্ত বর্জ্য। যা ৪২টি খালের মধ্যে ৩৬টির অস্তিত্বকে বিলীনই করে দিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বৃহত্তর চাক্তাই খাল। আর চাক্তাই খালে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এসব পাহাড়ী মাটি ও বর্জ্য গ্রাস করেছে কর্ণফুলী নদীকেও। কর্ণফুলী নদীজুড়ে ইতোমধ্যেই প্রতিনিয়ত জেগে উঠছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চর, যা নৌযান চলাচলকে ব্যাহত করে আসছে। যদিও ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বাকলিয়া থেকে কর্ণফুলী ব্রিজ পর্যন্ত ড্রেজিংয়ের প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তা আদৌ বাস্তবায়ন হবে কিনা সংশয়ের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেননা, কর্ণফুলী নদীর ড্রেজিংয়ের সার্বিক দায়িত্ব চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের। আর নগর এলাকা অভ্যন্তরে খাল সংস্কারের দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। এ দুটি সংস্থাকে বাদ দিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে এ কাজের অনুমোদন এবং বাস্তবায়ন বৈধতা পাবে কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এবারই বেশি নিহত এদিকে, ২০০৭ সাল থেকে পাহাড় ধসে প্রাণহানির একটি পরিসংখ্যান দেখা যায়, ওই বছর পাহাড় ধসে ১৩২, ২০০৮ সালে ১১, ২০১১ সালে ১৭, ২০১২ সালে ২৪, ২০১৩ সালে ২, ২০১৫ সালে ৮ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ২০১৬ সালে প্রাণহানির কোন রেকর্ড নেই। চলতি ২০১৭ সালে পার্বত্যাঞ্চলের তিন জেলায় প্রাণহানির সংখ্যা এককভাবে দেড় শতাধিক। অপরদিকে, চট্টগ্রাম মহানগরীতে গত শুক্রবার সীতাকু-ে এক পরিবারেরই ৫ সদস্য প্রাণ হারিয়েছে পাহাড় ধসে। এছাড়া রেকর্ড হয়নি এমন প্রাণহানির সংখ্যাও কম নয়। কেননা, নিহতদের একটি অংশ মাটির সঙ্গে মিশে তলিয়ে গেছে অতল গহ্বরে। এদের কোন খোঁজও মেলেনি। প্রশাসন এদের নিখোঁজ বলেছে সত্য, কিন্তু কোন তালিকা নেই। কিন্তু স্বজনদের দাবি রয়েছে। তবে কার দাবি কে শোনেÑপরিস্থিতিটা এমনই। নগর পরিকল্পনাবিদদের পক্ষ থেকে দফায় দফায় যেসব প্রস্তাব করা হয়েছে এর কোনটিই সরকারী সংস্থার পক্ষ থেকে কর্ণপাত করা হয়নি, এখনও করা হচ্ছে না। রাজনৈতিক পক্ষাবলম্বন করে বা না করে যে বক্তব্যই আসুক না কেন, প্রশাসন তা সাধারণত আমলে নেয় না। ফলে প্রশাসনের কর্মকা-ের সঙ্গে বড় ধরনের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়ে আছে। বর্তমানে চট্টগ্রামে যে ফ্লাইওভার নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে, পাশাপাশি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রতিষ্ঠার যে অনুমোদন দেয়া হয়েছে তা নিয়েও নগর পরিকল্পনাবিদদের আপত্তি রয়েছে। কিন্তু এসব আপত্তি নিয়ে সরকারী সংস্থাগুলোর কর্ণধাররা কোন পাত্তাই দিচ্ছেন না। সরকারী সংস্থাগুলো চলছে নিজ গতিতে। আর নগর পরিকল্পনাবিদসহ বিশেষজ্ঞ মহলগুলো চিল্লাহুল্লা করে ক্ষ্যান্ত থাকছেন। এমন পরিস্থিতি যদিও কখনও কাম্য হতে পারে না চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা, খাল সংস্কার, অন্যান্য উন্নয়ন নিয়ে চলমান রয়েছে বিপরীতমুখী তৎপরতা। ফলে দুর্ভোগের ওপর দুর্ভোগে নাভিশ্বাস চলছে নগরবাসীর মাঝে। ৫ লাখ পাহাড়ের পাদদেশে বেসরকারী এক পরিসংখ্যানে চট্টগ্রামে বিভিন্ন পাহাড়ের পাদদেশে প্রায় ৫ লাখ পরিবারের বসতি রয়েছে। ওইসব পরিবারের লোকসংখ্যা গুনতে গেলে তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তার কোন যথাযথ পরিসংখ্যান পাওয়া মুশকিল। অথচ, এটাই সত্য। সঙ্গত কারণে, সহায়-সম্বলহীন এসব জনগোষ্ঠীর সদস্যদের পরিকল্পিতভাবে পুনর্বাসন যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন পাহাড়কে অক্ষত রেখে এর অবস্থান ধরে রাখার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। নচেৎ প্রতি বর্ষা মৌসুমে এ ধরনের পরিস্থিতি হতেই থাকবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ জাতীয় দুর্যোগের চিত্র হবে আরও ভয়াল।
×