ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

‘আমার রাজনৈতিক জীবনে একটিই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি’-তাজউদ্দীন আহমদ -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:০০, ২৩ জুলাই ২০১৭

‘আমার রাজনৈতিক জীবনে একটিই ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি’-তাজউদ্দীন আহমদ -স্বদেশ রায়

তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে জেলখানায় তাঁর স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন দেখা করতে গেলে, তাজউদ্দীন আহমদ তাঁকে বলেছিলেন, আমি আমার রাজনৈতিক জীবনে একমাত্র ভুল করেছি, ১৫ আগস্ট সকালে আত্মগোপনে না গিয়ে। বাস্তবে তাজউদ্দীন আহমদের রাজনৈতিক জীবনে ভুল সিদ্ধান্ত খুবই কম। ১৯৪৭-এর পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমদ রাজনীতি করতেন বা যারা তাঁর সব সময়ের সঙ্গী ছিলেন তাঁদের পথে গেলে তাজউদ্দীন আহমদ বড় জোর কমরেড তোহাদের মতো একজন ব্যর্থ বামপন্থী রাজনীতিক হতেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না, হতে পারতেন না ১৯৭১ সালের নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধকালীন ‘দুর্দিনের প্রধানমন্ত্রী’। বরং দেখা যায় তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কলকাতা থেকে ঢাকা এলে ক্রমেই তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর সঙ্গী হয়ে ওঠেন। ১৫৩ মোগলটুলীতে কমরুদ্দিন আহমদসহ অনেকেই যখন একটি নতুন সমাজের আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজছেন, সে সময়ে মুসলিম লীগের একজন সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদ তাদের সঙ্গে নিজেকে বিকশিত করছেন একজন প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে, একজন ভবিষ্যতমুখী সমাজদ্রষ্টা হিসেবে, কোন মতেই অন্য দশ জনের মতো পাকিস্তানকে মেনে নিয়ে নয়। বরং আমরা তার ওই সময়ের বা একটু পরের ডায়েরির পাতাগুলো পড়লে দেখতে পাচ্ছি, ধর্মীয় রাজনীতিতে তিনি কোন মতেই নিজেকে আটকে রাখতে পারছেন না। তিনি মুক্তি খুঁজছেন। অথচ তিনি তাঁর অন্যান্য ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মতো কমিউনিস্ট আন্দোলনের পথেও যাচ্ছে না। ভাষার দাবি ও মুসলিম লীগের অনাচারের হাত থেকে মুক্তি খুঁজছেন। ওই সময়ের পাকিস্তানে অর্থাৎ ’৪৭ বা ’৪৮-এ বসে এর থেকে বেশি ভাবলে বা সে পথে গেলে তা হতো হঠকারিতা যা যে কোন রাজনৈতিক কর্মীকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে মানুষ ও সমাজ থেকে। তাই দেখা যাচ্ছে ১৯৪৯-এ আওয়ামী লীগ সৃষ্টির পরে জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা হিসেবে নিজেকে বিকশিত করে দ্রুতই নিজেকে কেন্দ্রে এনেছেন। ১৯৫৪-এ এমাদুল্লাহসহ অন্যান্য যুব নেতার সঙ্গে থেকে কর্ম শিবিরে যুক্তফ্রন্ট গড়ার পক্ষে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। এমনকি শেরে বাংলার দোদুল্যমানতাকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য নিবিড়ভাবে কাজ যারা করেছিলেন, সেই যুব নেতাদের একজন তাজউদ্দীন আহমদ। তাঁর সেদিনের কাজ এখনও কোথাও সেভাবে লেখা হয়নি। কেবলমাত্র ওরাল হিস্ট্রির পার্ট হিসেবে এখনও মুখে মুখে আছে। এ বিষয়ে তাজউদ্দীন আহমদের অবশ্য নিজের একটা দর্শন ছিল। তাঁর দর্শন ছিল- ‘তুমি এমনভাবে ইতিহাস সৃষ্টি করো বা ইতিহাস তৈরির জন্যে কাজ করো- যাতে ইতিহাসে কোথাও তোমাকে খুঁজে পাওয়া না যায়।’ এই দর্শন আর্য ও দ্রাবিড়ের মিলিত দর্শন। যে দর্শনে সৃষ্টির পথ হলো নিজেকে সর্বোচ্চ ত্যাগ করা, আর সে ত্যাগ হবে নিভৃতে। অর্থাৎ এখান থেকে বোঝা যায়, তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর সমাজ, শিকড় যে মাটিতে প্রোথিত, সেখানেই নিজেকে প্রোথিত করেছেন। সিন্ধু ও গঙ্গার জলধারায় একটি জনপদে বহুমানুষের মিলন ঘটেছে, সেই মিলনের ভিতর দিয়ে, পারস্পরিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞা বিনিময়ের ভিতর দিয়ে যে দর্শন সৃষ্টি হয়েছেÑ ওই দর্শনের ওপর নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর নিজস্ব সভ্যতার বাইরে থেকে আসা দর্শন তাঁর জ্ঞানের অঙ্গ হিসেবে আত্মস্থ হয়েছে। তবে সে রসে তিনি ডুবিয়ে ফেলেননি নিজেকে। আর নিজস্ব ঐতিহ্য ও মাটির রসে পুষ্ট প্রজ্ঞাকে আপন বলেই জীবনে মেনে ছিলেন। বাস্তবে নিজস্ব মাটির রসে পুষ্ট হয়ে নিজস্ব শিকড়ে ভর দিয়ে না দাঁড়ালে আর যাই হোক কেউ তাজউদ্দীন আহমদ হতে পারেন না। ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পরে তাজউদ্দীন আহমদ পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খানের প্রাইভেট সেক্রেটারি ছিলেন। আতাউর রহমান খান তাঁর কাজের নিষ্ঠায় এতই মুগ্ধ ছিলেন যে, তাঁর শেষ বয়সেও তিনি তাজউদ্দীন আহমদের কথা উঠলে ওই সময়ের কথা বলতেন। বলতেন কত রাত জেগে তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর কাজ করে দিতেন। আতাউর রহমান খানের সঙ্গে এ সম্পর্ক হবার পরেও ৬৪ সালে যখন শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করেন ওই সময়েও তাজউদ্দীন আহমদ ভুল করেননি। তিনি আতাউর রহমান খানদের মতো প্রবীণ নেতাদের সঙ্গে না থেকে তরুণ নেতা তাঁর প্রিয় মুজিব ভাইয়ের সঙ্গেই থাকেন এবং আওয়ামী লীগের সম্পাদকম-লীতে স্থান পান। এর পর থেকে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের পূর্ব পর্যন্ত তাজউদ্দীন আহমদের রাজনীতিতে কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়নি। যেমন অনেকেই মনে করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কেবিনেট থেকে বাদ পড়ার পরে তাজউদ্দীন আহমদ হয়ত নতুন কোন রাজনৈতিক দল করবেন। না, সে কাজ তিনি করেননি। বরং যতদূর জানা যায় ১৯৭৫-এর জুলাই বা আগস্ট মাসের দিকে তিনি রাতে বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়ে দেশে যে একটা ষড়যন্ত্র চলছে তা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে আসেন। বঙ্গবন্ধুও তাঁকে বলেন, তিনি সব কিছু জানেন। তবে ষড়যন্ত্রকারীরা কিছু করতে পারবে না। ষড়যন্ত্রকারীরা কিছু করতে পারবে না এ বিশ্বাস বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদ উভয়ের মধ্যে কেন দৃঢ়ভাবে ছিল তা সত্যিই বলা দুষ্কর। তবে একটা কথা বলা যায়, আসলে যারা জন্মগতভাবে নেতা তারা জন্মগতভাবে আশাবাদী হন। এই জন্মগত আশাবাদই তাদের অবিশ্বাস্য রকম দীর্ঘদেহী নেতাতে পরিণত করে। যে কারণে তাঁরা বার বার মৃত্যুর মুখোমুখি হন অথচ কখনই মৃত্যুকে ভয় পান না। তাঁরা তাঁদের জীবনকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যান যে, মৃত্যুও তাঁদের সরাতে পারে না মানুষের কাছ থেকে। মৃত মানুষটিও আরও বেশি জীবন্ত হয়, আরও বেশি শক্তিশালী হয়। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের দুর্ভাগ্য হলো এখনও অবধি সঠিকভাবে বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদ চর্চা এদেশে হয়নি। বরং ১৯৭২ সাল থেকে এদেশে এক শ্রেণীর তথাকথিত বামপন্থী ও এক শ্রেণীর ছদ্মবেশী মুসলিম লীগার এলিট তাজউদ্দীন আহমদকে নিয়ে একটি জঘন্য চর্চা করছেন। তাঁরা তাজউদ্দীন আহমদকে বেশ কৌশলে বঙ্গবন্ধুর সমান্তরালে নিয়ে আসতে চান। তাঁরা স্বীকার করতে চান না বঙ্গবন্ধু একটি সামষ্টিক নেতৃত্বের শীর্ষবিন্দু। তাজউদ্দীন আহমদ এই শীর্ষ বিন্দুকে চিনতেন। যে কারণে ১৬ ডিসেম্বরের বিকেল ৪.৩১ মিনিটে পাকিস্তানীরা আত্মসমর্পণের পরে সকলে যখন রাজপথে নেমে গেছেন, সে সময়ে নীরবে বসে কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রোডে চোখের পানি ফেলছেন তাজউদ্দীন আহমদ। ওই সময়ে দৌড়ে তাঁর রুমে ঢুকে তাঁর চোখের পানি দেখে গাজীউল হক জিজ্ঞেস করেন, তোমার চোখে পানি কেন তাজউদ্দীন? তাজউদ্দীনের ধরা গলার উত্তর, মুজিব ভাই এখনও মুক্তি পাননি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এ দৃশ্যের বর্ণনা করতে গিয়ে প্রায় কেঁদে দিতেন গাজীউল হক। এই ছিলেন বাস্তবে তাজউদ্দীন আহমদ। তিনি কেন ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ভুল করলেন! কেন সেদিন শুধু তিনি নন ব্যর্থ হলো সিদ্ধান্ত নিতে সমগ্র আওয়ামী লীগ? ইতিহাসের এ অধ্যায় খুঁড়ে দেখা প্রয়োজন। তাজউদ্দীন আহমদ বলে গেছেন তিনি ভুল করেছিলেন। কেন এই ভুলের পরিবেশ এ দেশে সৃষ্টি হলো, কেন অন্যরা সেটুকুও বুঝলেন না যে তাঁরা সিদ্ধান্ত না নিয়ে ভুল করছেন? ইতিহাসের এ অধ্যায়ের অনেক মাটি খোঁড়া প্রয়োজন। [email protected]
×