ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ উনিশ অক্টোবর থেকে আটাশ জুন

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ২৩ জুলাই ২০১৭

একুশ শতক ॥ উনিশ অক্টোবর থেকে আটাশ জুন

বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে নিজের অবস্থান তিন দশক বা তিরিশ বছরের বেশি সময় পার করছি। সেই ৮৭ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে এখনও বহমান এই যাত্রার বাঁকে বাঁকে যেমনি আছে সুখ-দুঃখ তেমনি আছে জয় পরাজয়। কখনও হেসেছি, আবার কখনও কেঁদেছি। পেছনের এই তিরিশ বছরের দিকে তাকালে যেমনি বলা যাবে অর্জনের কথা, তেমনি বলা যাবে অর্জন করতে না পারার কথা। এসব মিলেই তো জীবন। মানুষ খুব ভাগ্যবান যে সে তার কষ্টের কথা, বেদনার কথা বা পরাজয়ের কথা তেমনভাবে মনে রাখে না। যদি সেটি করত তবে তার সামনে চলা থেমে যেত। বেশিরভাগ সময়েই মানুষ তার আনন্দ ও বিজয়ের কথাই মনে রাখে। আমিও তাই আনন্দের কথা বা সফলতার কথাগুলোই মনে রাখি। এ খাতে আমার নিজের কি অর্জন সেটি আমি গুছিয়ে বলতে পারব না। তবে তিরিশ বছরে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে যার অন্তত দুয়েকটি স্মৃতি এখানে তুলে ধরতে চাই। আমাদের নতুন প্রজন্মের প্রযুক্তিবিদ, রাজনীতিক ও নীতি নির্ধারকগণ এই স্মৃতিচারণ থেকে কিছু না কিছু জানবেন সেই প্রত্যাশা আমার রয়েছে। স্মৃতিচারণ করলে স্মরণে পড়বে কম্পিউটার দিয়ে বাংলা পত্রিকা প্রকাশের কথা, প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস প্রতিষ্ঠার কথা, ডেস্কটপ প্রকাশনার বিপ্লবের কথা, জাতীয় নির্বাচনে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার, কম্পিউটারের ওপর থেকে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার, দেশব্যাপী কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের লড়াই, ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণা, দেশে ডিজিটাল যন্ত্র উৎপাদনের সুযোগ তৈরি, দেশীয় সফটওয়্যার ও সেবা খাতের সুরক্ষা এবং সম্ভবত সর্বশেষটি ডিজিটাল পণ্য রফতানিতে নগদ সহায়তা প্রদানের ব্যবস্থা করা। ৬ আগস্ট ১৫ : খুব পেছনের কথা নাই বা বলি। ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের স্মৃতিটা ছোট করে স্মরণ করি। সেদিন প্রধানমন্ত্রীর দফতরে ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের সভা অনুষ্ঠিত হয়। কোন পদবি ছাড়াই কেবলমাত্র আনন্দ কমপিউটার্সের মালিক হিসেবে সেই সভায় আমি আমন্ত্রণ পাই। সেই হিসেবেই আমি ওই শীর্ষ কমিটির সদস্যও হই। আমি তখন সেই কমিটির সদস্য হিসেবে উপস্থিত ছিলাম। কোন সন্দেহ নেই, সেটি আমার জন্য ছিল একটি বিরাট সম্মান। আলোচ্যসূচী অনুযায়ী সভা পরিচালিত হওয়ার শেষ প্রান্তে আমি প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে প্রসঙ্গ উত্থাপন করি যে, বাংলাদেশের প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী আছে। ওদের প্রত্যেকের হাতে ল্যাপটপ দেয়া হবে এমন ঘোষণা আপনি দিয়েছেন। আমরা এখন সকল ডিজিটাল যন্ত্র আমদানি করি। এর ফলে যে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের ব্যয় করতে হয় নিজের দেশে যদি সংযোজনও করি তবে তাতে অন্তত শতকরা ২৫ ভাগ সাশ্রয় হবে। সভায় এই প্রসঙ্গে অনেক আলোচনা হয়। টেলিফোন শিল্প সংস্থার বিষয় নিয়েও কথা হয়। দোয়েলের ব্যর্থতাও আলোচনায় আসে। এতে উপস্থিত প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ও আলোচনায় অংশ নেন। আলোচনার ফাঁকে অন্যদের বক্তব্যের আলোকে আমি বলি যে, টেলিফোন শিল্প সংস্থাকে মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক হবে না। কারণ সেটি ছিল ব্যবস্থাপনা ত্রুটি। আমরা যদি আমদানির শিকল ছিড়তে না পারি তবে আমাদের সঙ্কট আরও বাড়বে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে টেলিফোন শিল্প সংস্থার দায়িত্ব দেয়ার কথা বলে ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশ ডিজিটাল যন্ত্র কেবল উৎপাদন করবে না, রফতানিও করবে। সভাশেষে অনানুষ্ঠানিকভাবেও তিনি বিষয়টি নিয়ে আমার এবং অর্থমন্ত্রী মহোদয়সহ অন্যদের সঙ্গে আলোচনা করেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুসারে টেলিফোন শিল্প সংস্থার দায়িত্ব আমার নেয়া হয়নি। কারণ সংস্থাটি চায়নি যে আমি সেটি সার্বিকভাবে পরিচালনা করি-তারা বরং নামকা ওয়াস্তে কর্মহীন উপদেষ্টা হয়ে থাকি সেটাই চেয়েছে। আমরা এর পরের বছর ২০১৬-১৭ এর বাজেটে এর প্রতিপালন হবে তেমন আশা করলেও বিষয়টি নিয়ে কোন মহল থেকেই সেইভাবে সরকারকে বোঝানো হয়নি। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোন বাণিজ্য সংগঠন, যেমন বিসিএস, বেসিস বা তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ কিংবা এফবিসিসিআই এই বিষয়ে কোন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। কিন্তু ১৬ সালের ১৫ জুলাই যখন আমি বেসিসের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন আমার মাথায় প্রচ-ভাবে এটি কাজ করে যে শুরুতেই নিজের দেশকে বাঁচাতে হবে। তাই সেই নির্বাচনেই আমরা দেশীয় সফটওয়্যারের সুরক্ষার পাশাপাশি দেশে ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদনের জন্য সরকারকে সক্রিয় করার অঙ্গীকার ঘোষণা করি। বিগত প্রায় এক বছরে সংশ্লিষ্ট সকল মহলেই এটি ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। বিশেষ করে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় বিষয়টিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়। দেশে হার্ডওয়্যার উৎপাদন, দেশীয় সফটওয়্যারের সুরক্ষা এবং তথ্যপ্রযুক্তি রফতানিতে প্রণোদনার বিষয়গুলো এই বিভাগের বাজেট অগ্রাধিকার তালিকায় গুরুত্ব পায়। এই বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলক নিজে এই বিষয়ে দারুণভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং তার বিভাগকে এজন্য সব ধরনের কাজ করতে নির্দেশ দেন। তিনি নিজেও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডসহ, সরকারের সর্বস্তরে এই বিষয়ক সভায় যোগ দেন এবং এ খাতের বক্তব্যগুলো তুলে ধরেন। ১৭-১৮ সালের বাজেট দেখে আমরা অনুভব করলাম যে, অসম সাহসিনী নেত্রীর বিচক্ষণতা, দূরদৃষ্টি ও দেশপ্রেম এবারের বাজেটে প্রতিফলিত হয়েছে এবং এবার দেশীয় সফটওয়্যারের সুরক্ষা ও দেশটি ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদনে মাইলফলক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা এখন দুনিয়াকে এই অর্জন দেখাতে পারব। একদিকে সরকার এবার ডিজিটাল যন্ত্রপাতি উৎপাদনের সব কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশকে মাত্র শতকরা এক ভাগ করের আওতায় রেখে খুচরা স্তরের ভ্যাটও প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির ইতিহাসে ৯৮-৯৯ সালে কর ও শুল্ক প্রত্যাহারের ঘটনাটি যেমন মাইলফলক ছিল, এবার সেটিও তেমনি একটি কাজ হলো। আমি আশা করি একটি অর্থ বছরেই এর প্রভাব আমাদের ডিজিটাল ডিভাইস উৎপাদন ও রফতানিতে দেখতে পাব। অন্যদিকে সরকার বিদেশী সফটওয়্যারের ওপর করারোপ করার ফলে দেশীয় সফটওয়্যারের প্রতিযেগিতার শক্তি বাড়ল। তবে বাজেট পেশ করার পর আমাদের একটি দাবিই অনুপস্থিত দেখতে পেয়েছিলাম। সেটি হলো আমরা তথ্যপ্রযুক্তি রফতানিতে যে নগদ প্রণোদনার দাবি তুলেছিলাম সেটি বাজেটে ছিল না। বাজেট আলোচনায় আমি প্রায়ই বলছিলাম যে, আমাদের এই দাবিটি হয়ত এই বিষয়ক কমিটির সভায় আলোচিত হয়ে ইতিবাচক হবে। এই নিবন্ধে সেই গল্পটিই তুলে ধরতে চাই। এজন্য কিছুটা পেছনে ফিরে তাকাতে হবে। উল্লেখ করা দরকার যে, এই দাবি তোলারও একটি সুন্দর ও চমকপ্রদ ইতিহাস রয়েছে। আসুন এবার একটু পেছনে ফিরে তাকাই। উনিশ অক্টোবর ২০১৬ : সকাল সাড়ে দশটায় বসুন্ধরা সম্মেলন কেন্দ্রে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড ১৬ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। বেসিসের সহ আয়োজক বিধায় অনুষ্ঠানের মঞ্চে আমারও থাকার কথা। উদ্বোধন করবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। আগে থেকেই আমাদের প্রস্তুতি ছিল যে প্রধানমন্ত্রী আসার এক ঘণ্টা আগেই উদ্বোধনী স্থলে পৌঁছে যাব। ঘুমকাতুরে মানুষ হলেও প্রয়োজনে আমি আগেই জেগে ওঠতে পারি। সকাল সাড়ে আটটায় লালমাটিয়ার বাসা থেকে বের হলাম। কিন্তু বিধি বাম। ঘরের দোর সাতাশ নম্বর থেকে জ্যাম শুরু হলো। বনানী সিগন্যালে গিয়ে একদম স্থির হয়ে গেলাম। সাড়ে নটায় গাড়ি চলা বন্ধ করা হলো এবং ছাড়লো সাড়ে দশটায়। সামনের ফাঁকা রাস্তা ধরে আমি যখন বসুন্ধরায় পৌঁছাই তখন সাড়ে দশটা পার হয়ে গেছে। মূল গেট বন্ধ। আমার কপাল ভাল যে এসএসএফের একজন আমাকে চিনতে পেরে ঢুকতে দিলেন। এরপরও কপাল ভাল যে এসএসএফের অন্য একজন চিনতে পেরে আমাকে মূল অনুষ্ঠানস্থলেও ঢুকতে দিলেন। তিনি একদম মঞ্চের পাশে একটি চেয়ার স্থির করে আমাকে যখন বসাতে যাবেন তখন অভাবনীয় ঘটনাটি ঘটল। মঞ্চে ওঠে এলো একটি সোফা এবং মঞ্চ থেকে একজন এসএসএফ কর্মী নেমে এসে আমাকে মঞ্চে ওঠিয়ে দিল। ততক্ষণে প্রধানমন্ত্রী, তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সচিব, কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক মঞ্চে রয়েছেন। অনুষ্ঠানের স্বাগত ভাষণও শেষ হয়ে গেছে। এটুআই-এর কবির বিন আনোয়ার বক্তৃতা দিয়ে ফেলেছেন। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক (সাবেক) সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বক্তব্য পেশ করে ফেলেছিলেন।। আমি প্রবেশ করার সময় বক্তব্য রাখছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি সচিব শ্যাম সুন্দর সিকদার। আমি অতিথিদের পেছন দিয়ে যাবার সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, দেরি কেন? আমি মাথাটা নিচু করে তার কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললাম, আপনি আসবেন তাই বনানী ক্রসিং-এ এক ঘণ্টা গাড়ি আটকে দিয়েছিল। খুবই দুঃখিত এই ত্রুটির জন্য। তিনি মিষ্টি করে হাসলেন। আমি মনে করি সেদিন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে অসাধারণ সম্মানটুকু আমাকে প্রদান করেন তার সঙ্গে জীবনের আর কোন ঘটনাকে তুলনা করতে পারব না। একজন অতি সাধারণ মানুষকে তিনি যে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন সেটি তার বিশালত্বকেই প্রকাশ করে। সারা জীবন তার এই ¯েœহটা পেয়ে আমি ধন্য হয়ে যাই। ৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়ার সময় ছাত্র সংসদের নির্বাচনের সময় এমন একটি মিষ্টি হাসির কথা মনে পড়ল। সেবার আমার ভিপি পদে নির্বাচন করার কথা। সব ঠিক ঠাক। মনোনয়ন পেপারে সই করতে গিয়ে তিনি জানলেন যে আমি বেতন দিইনি। সেজন্য তার কাছ থেকে বকা খেয়েছিলাম। শেখ হাসিনার এই হাসিতে একটু বকা এবং পুরোটা আদর মিশে থাকে। সেই থেকে জীবনে বহুবার তার এই হাসি আমি দেখেছি। তিনি বরাবরই হাসিতে পুরো অনুষ্ঠান শেষ করেন। কখনও আবার একটু গম্ভীরও দেখায় তাকে। কখনও কখনও সেই হাসি প্রাণ খোলা হয়ে ওঠে। সেই হাসি মুখ দেখতে দেখতে সঙ্কোচের সঙ্গেই সোফাসেটে বসে অবিশ্বাস্য ঘটনাটির কথা ভাবছিলাম। আমার জানা নেই কোন প্রধানমন্ত্রীর কোন অনুষ্ঠানে এমন কোন ঘটনা এর আগে ঘটেছে কিনা। আমি নিজে ভেবেচিলাম কোন মতে যদি আমাকে অনুষ্ঠানস্থলে ঢুকতে দেয়া হয় এবং পেছনের সারির কোথাও যদি আমাকে বসতে দেয়া হয় তবেই জীবন ধন্য হবে। সেই ভাবনার বিপরীতে এমনটা সম্মান পাব সেটি কল্পনারও বাইরের। আমার নিজের ধারণা অনুষ্ঠানের উপস্থিত সকলের জন্য এটি তাদের জীবনের ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল। (চলবে) ঢাকা ॥ ১৯ জুলাই, ১৭ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এর জনক [email protected],
×