ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বাসুদেব খাস্তগীর

দোলনা

প্রকাশিত: ০৬:২২, ২২ জুলাই ২০১৭

দোলনা

অর্থি খুব চঞ্চল। ঘর মাতিয়ে রাখে সারাক্ষণ। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধুলায়ও মেতে থাকে। বাড়ির পাশেই স্কুল। প্রতিদিন স্কুলে যায়। পাড়ার আরও অনেক মেয়ে তার সঙ্গে পড়ে। অনেকে একসঙ্গে স্কুলে যায়। বাবা মায়ের খুব আদূরে মেয়ে অর্থি। ক্লাস ফোরে পড়ে। সেদিন অর্থি স্কুল থেকে বাড়ি এসে বাবার কাছে একটা আবদার করে বসল। অর্থি বলে, ‘বাবা আমাকে একটা দোলনা টানিয়ে দাও’। বাবা বলে, ‘আবার দোলনার কেন সখ হলো রে মা’? -‘বাবা আমার স্কুলের বন্ধু জয়ার না একটা দোলনা আছে, আমরা স্কুলে দুপুর ছুটির পর ওর বাড়িতে গিয়ে দোল খেয়ে আসি, খুব ভাল লাগে বাবা।’ -ঠিক আছে মা ‘বলতেই অর্থির খুশি আর ধরে না। কখন বাবা দোলনা টানিয়ে দেবে প্রতিক্ষায় থাকে অর্থি। সেদিন বাবা বাজার থেকে শক্ত দেখে রশি কিনে আনলেন। বাড়ির দক্ষিণে পাশাপাশি দুটো আম গাছ। দুটো আম গাছে উপরে একটা শক্ত ছোট বাঁশ বেঁধে তাতে রশি ঝুলিয়ে নিচে বসার পিড়ি দিয়ে চমৎকার এক দোলনা বানালেন অর্থির বাবা। অর্থির খুশির যেন শেষ নেই। প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে দোলনায় দোল খায়। এ যেন পরম শান্তি। সঙ্গে এসে অন্য বন্ধুরাও যোগ দেয়। পালাক্রমে চলে দোল খাওয়া। একজন একবার দশবার করে দোল খায়, আর সমস্বরে সবাই গুণে। সেদিন সকালে পড়তে বসে অর্থি। পড়ালেখায় খুব ভাল। বাবা দেখেন অর্থি পড়ার টেবিলে নেই। বাবা ডেকে ডেকে ঘর থেকে বের হন, ‘অর্থি অর্থি’। বাবা দেখে অর্থি দোলনাতে দোল খাচ্ছে আপনমনে। দখিন হাওয়া অর্থির চুলগুলোকেও দোলাচ্ছে কী দারুণভাবে। উড়ছে অর্থির জামা। বাবা পেছন থেকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে চেয়ে দেখেন। বাবা ধীরে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে দোলনা ধরেন। অর্থি অবাক হয়। কিছুটা ভয়ও পেয়ে যায়। বাবা বলে, ‘মা পড়ার সময়তো খেলতে নেই’। অর্থি সোজা দৌড়ে পড়ার টেবিলে। অর্থিকে সরকারী স্কুলে ইন্টারভিউ দেয়ার প্রস্তুত করে তুলছেন বাবা। পড়াশোনার চাপ তাই এখন একটু বেশি। সরকারী স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তির জন্য আর কিছুদিন পরেই পরীক্ষা। সেজন্য বাবা অর্থিকে পড়াশোনায় বেশি মনযোগী হতে বলে। অর্থি একটু ফাঁক পেলেই দোলনার দিকে ছুটে। বন্ধুদের অনেকেই বিকেলে অর্থির বাড়ি আসে এবং সবাই আনন্দ আর হৈ হুল্লুড়ে দোলনাতে দোল খায়। এদিকে বছরের শেষ, অর্থির ভর্তি পরীক্ষাও ঘনিয়ে এলো। পরীক্ষার প্রস্তুতিও নিচ্ছে অর্থি। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে অর্থি একবার দোল খেয়ে আসেই। দোলনার প্রতি তার কেমন যেন মায়া জমে গেছে। ইতোমধ্যে ভর্তি পরীক্ষার সময় এসে গেল। অর্থি বাবার সঙ্গে শহরে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে আসল। কয়দিন পর ভর্তি ফল প্রকাশ হলে দেখা গেল অর্থি সরকারী স্কুলে ভর্তির জন্য পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন শহরে বাসা নিতে হবে। দীর্ঘদিনের গ্রামের পরিবেশ ছেড়ে শহরে আসতে অর্থির মন কেমন করে ওঠে। অর্থির বাবা শহরে চাকরি করেন। প্রতি সপ্তাহে বাড়ি যান। মনে মনে ঠিক করলেন মেয়ে যখন সরকারী স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে শহরে একটা আপাতত ছোট বাসা নিয়েই থাকা ভাল হবে। শহর বাড়ির দৌড়া দৌড়ি অনেকটা কমবে। মেয়েও একটা ভাল স্কুলে পড়বে। সব চিন্তা করে মেয়েকে সরকারী স্কুলেই ভর্তি করিয়ে দিলেন। সব ঠিকঠাক করে গ্রামের বাড়ি ছোট চাচাকে দেখতে দিয়ে শহরেই উঠল অর্থিরা। বাড়ি থেকে আসার সময় অর্থি বলে, ‘বাবা দোলনাটা শহরে নিয়ে যাই? বাবা বলে, ‘পাগলি কোথাকার, শহরে কি দোলনা টানানো যায়? ‘কেন বাবা’? ‘আরে ওখানে কী আমাদের মতো এ রকম সারি সারি গাছ আছে? এখানে যেভাবে দোলনা টানিয়েছো, শহরে সেভাবে সম্ভব না মা।’ অর্থির মন খারাপ হয়। বাবা বলে, ‘শহরে শিশুপার্ক আছে, সেখানেও দোলনা আছে, একদিন নিয়ে যাব।’ অর্থির মন খুশিতে দোলে ওঠে। নতুন বাসা, নতুন স্কুল। তবুও মুক্ত বাতাস, মুক্ত চলা, দখিনা হাওয়ায় দোলনায় দোলা এসব কিছুর জন্য অর্থির মনটা কেমন করে ওঠে। অর্থির বাবা অর্থিকে একদিন ছুটির দিনে শিশুপার্কে নিয়ে গেলেন। পার্কে ঘেরাাঘুরি ভালই লাগছে অর্থির। বদ্ধ জীবন থেকে খোলা হাওয়ায় একটু স্বস্তি। অনেকগুলো রাইডারে চড়লো অর্থি। ঘুরতে ঘুরতে চোখে পড়ে সেই গাঁয়ের দোলনার মতো একটি দোলনার দিকে। অর্থি বাবাকে বলে, ‘ঐ যে আমাদের দোলনা, ওটাতে চড়বো বাবা’। দোলনাতে ওঠে অর্থি, আর দোল খায়। ফিরে যায় ফেলে আসা গ্রামের সেই দোলনা, সেই হৈচৈ, সেই দখিনা হাওয়ার স্মৃতিতে। কিন্তু তারপরও কোথাও যেন তার আনন্দ হাসির রেশ আগের মতো হৃদয় ছুঁয়ে যায় না। অর্থিকে দোলানায় দোল দেয়ার জন্য দোলনায় চড়ানো ব্যক্তিকে বাবা গুনে গুনে টাকা দেয়। অর্থি অবাক দুচোখে চেয়ে চেয়ে দেখে। অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×