ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধিকাংশই মনুষ্যসৃষ্ট, ’৯৯ সালের পর ১২ বার পাহাড়ধস

পাহাড়ধস এখন দেশে ভয়াবহ দুর্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ২২ জুলাই ২০১৭

পাহাড়ধস এখন দেশে ভয়াবহ দুর্যোগ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ গত ২০ বছরের মধ্যে দেশে পাহাড়ধসের মাত্রা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। ১৯৬৮ সালের আগে দেশে পাহাড়ধসের কোন রেকর্ড না থাকলেও ’৯৯ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে ১২ বার। প্রতিবারই একাধিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। তবে সবচেয়ে বেশি ১৬০ জনের মৃত্যু হয়েছে বছরের জুনের পাহাড়ধসের ঘটনায়। এছাড়া ২০০৭ সালের পাহাড়ধসের ঘটনায় ১২৭ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিগত প্রায় চার দশকের মধ্যে বর্তমানে পাহাড়ধস দেশে একটি ভয়াবহ দুর্যোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের সব দেশে কম-বেশি পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটলেও বাংলাদেশে পাহাড়ধসের ঘটনা অন্য দেশ থেকে পৃথক। বিশ্বের অন্যান্য দেশে প্রাকৃতিক কারণে পাহাড়ধসের ঘটনা বেশি ঘটলেও আমাদের দেশে পাহাড়ধসের ঘটনার বেশিরভাগই মনুষ্যসৃষ্ট। পাশাপাশি প্রাকৃতিক কারণেও পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম বলেন, মানবসৃষ্ট কারণে ব্যাপকহারে বন উজাড়, পরিকল্পিত বা অপরিকল্পিভাবে আবাসনের জন্য পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ী অঞ্চলে প্রথাগত জুমচাষের পরিবর্তে সমতলভূমির প্রযুক্তিতে চাষাবাদের বিস্তার পাহাড়ধসের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, কোন রকম প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়াই পাহাড় কেটে বা ধ্বংস করে রাস্তাঘাট নির্মাণও এ বছরের পাহাড়ধসের অন্যতম প্রধান কারণ। তিনি আরও বলেন, প্রাকৃতিক কারণে পাহাড়ের গঠন এবং ঢাল, জলবায়ুতে ঋতুগত পরিবর্তন, ভূমিকম্প এবং অতিমাত্রায় বৃষ্টিপাত পাহাড়ধসের জন্য দায়ী। তিনি বলেন, দেশের পাহাড়গুলো মূলত বালুমাটির সৃষ্টি। শুষ্ক মৌসুমে শুষ্কতার জন্য পাহাড়ের গায়ে ফাটল দেখা দেয়। আবার ভূমিকম্পের কারণেও এ ফাটলের সৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে যখন অতিবৃষ্টির কারণে এ ফাটল দিয়ে পানি মাটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তখন পাহাড়ের বালুমাটি সহজেই দৃঢ়তা হারিয়ে ফেলে। ফলে পাহাড়ধসের সৃষ্টি হয়। ইংল্যান্ডের ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিধস গবেষণা কেন্দ্রের সূত্রমতে, বিশ্বব্যাপী প্রায় পাঁচ লাখ লোক ভূমিধসে নিহত হয়েছে, যার অধিকাংশই পর্বতময় স্বল্পোন্নত দেশভুক্ত। ১৯২০ সালের ১৬ ডিসেম্বর চীনের নিংজিয়া ভূমিধসে এক লাখ লোক নিহত হয়, যা ভূমিধসে নিহত সর্বোচ্চ রেকর্ড। আর বাংলাদেশে ১৯৯৯ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত পাহাড়ধসের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৪৪৮ জন। শহিদুল ইসলাম উল্লেখ করেন, দেশে প্রথম পাহাড়ধসের ঘটনা রেকর্ড করা হয় ১৯৬৮ সালে। ওই বছর কাপ্তাই-চন্দ্রঘোনা রাস্তায় পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটে। তবে ওই ঘটনায় কোন প্রাণহানি না ঘটলেও ১৯৯৯ সালের পর এ পর্যন্ত ১২ বার পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। প্রতিবারই মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। পাহাড়ধস বিধ্বংসী রূপ নিয়েছে। তিনি তার গবেষণায় উল্লেখ করেন, ভূমিধসের কারণে শুধু প্রাণহানিই ঘটছে না, এর ফলে পাহাড়ী মাটির দৃঢ়তা নষ্ট হচ্ছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, বনাঞ্চাল ও কৃষিজমির ক্ষতি হচ্ছে। চলতি বছরের ভূমিধসের সঙ্গে পাহাড়ী ঢালের বালুমাটি এবং পাহাড়ী আবর্জনার স্তূপ নিকটবর্তী কৃষিজমিতে গিয়ে জমি চাষাবাদের উপযোগিতা নষ্ট করে দিয়েছে, যা পরবর্তী কয়েক বছর কৃষকদের জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে। তবে তিনি উল্লেখ করেন, বিশ্বব্যাপী ভূমিধস একটি অন্যতম দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও বাংলাদেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এটি এখনও দুর্যোগ হিসেবে পর্যাপ্ত স্বীকৃতি পায়নি। দুর্যোগ নীতিমালা ২০০৮, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা ২০১০ এবং দুর্যোগ নির্দেশনায় (এসওডি) সাইক্লোন, বন্যা, এমনকি ভূমিকম্প ও সুনামি নিয়ে যতটা গুরুত্ব দেয়া হয়েছে, ভূমিধস নিয়ে তেমন আলোকপাত করা হয়নি। স্বভাবতই এসব ডকুমেন্টে ভূমিধসের বিষয়টিকে আর গুরুত্বসহকারে সংযুক্তি করা প্রয়োজন। শুক্রবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, বাংলাদেশ-চায়না কালচারাল এ্যান্ড ইকোনমিক সেন্টার এবং ঢাকায় চীন দূতাবাসের যৌথ উদ্যোগে আয়োজন করা হয় বাংলাদেশে ভূমিধস : কারণ, ফলাফল এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে একটি সেমিনার। সেমিনারে আলোচকরা বলেন, দেশের পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত রয়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতাধর ব্যক্তি, পাহাড়ের মালিক, ব্যবসায়ী এবং শ্রমিক শ্রেণীর লোকজন। মাঝেমধ্যে শ্রমিক শ্রেণীর লোকজন ধরা পড়ে জেল-জরিমানা ভোগ করলেও অন্যরা কখনও পাহাড় কাটার অপরাধে দরা পড়ে না। তারা সব সময় ধরাছোঁয়রা বাইরেই থেকে যায়। তারা পাহাড় রক্ষায় এবং পাহাড়ধসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় পাহাড় ম্যানেজমেন্ট প্লান তৈরির আহ্বান জানান। শহিদুল ইসলাম বলেন, ২০০৭ চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের পর বিশেষজ্ঞ কমিটি পাহাড় রক্ষায় একটি রিপোর্ট দেয়। কিন্তু বিশেষজ্ঞ কমিটি প্রদত্ত রিপোর্টটি এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। ওই রিপোর্টে স্বল্প, মধ্য ও দীর্যমেয়াদি ২২টি সুপারিশ করা হয়েছিল, যার মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাসমূহকে চিহ্নিত করা, সমন্বিত ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনা, সমন্বিত ওয়াটার শেড ব্যবস্থাপনা অন্যতম। এছাড়াও একটি শক্তিশালী পাহাড় ব্যবস্থাপনা সেল প্রণয়ন করা আবশ্যক, যাদের আইনীভাবে ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার থাকবে এবং ভূমিধস নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় সফল দেশ হিসেবে আমরা পরিচিতি লাভ করেছি। পাহাড়ধসে সম্প্রতি যে প্রাণহানি ঘটেছে, তা দুঃখজনক। প্রকৃতি ও পরিবেশকে রক্ষা করে সহাবস্থান ও উন্নয়ন করতে হবে। গত চার দশক ধরে প্রকৃতিকে ধ্বংস করা হচ্ছে, আদিবাসীদের জীবনমান ধ্বংস করা হচ্ছে। তারা প্রকৃতি ও পাহাড়কে রক্ষা করে বসবাস করে। প্রকৃতি ও পরিবেশকে ধ্বংস করা যাবে না। সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট কারণগুলো নির্ধারণ করে ভবিষ্যত পরিকল্পনা নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, ভবিষ্যতে পাহাড়ধস ও ভূমিধস রোধে আমরা সবাই সতর্ক থাকব। এজন্য তিনি সামাজিক সংগঠন ও বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা কামনা করেন। বিশিষ্ট লেখক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, গত কয়েক বছরে ব্যাপকভাবে পাহাড় দখল হচ্ছে এবং পাহাড় কাটা হচ্ছে। পাহাড়ধসের এটি অন্যতম কারণ। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে নদী-জলাধারের মতো আজ পাহাড়গুলো দখল করে পাহাড়ের চরিত্রকে বিনষ্ট করা হচ্ছে। পাহাড় দখল ও পাহাড় কাটা বন্ধে সরকারকে অবশ্যই জরুরী পদক্ষেপ নিতে হবে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহম্মেদ খান বলেন, পাহাড়ী এলাকায় অনেক উন্নয়ন হচ্ছে, রাস্তা তৈরি হচ্ছে। এক্ষেত্রে সঠিক সমীক্ষা খুুব হচ্ছে না। যথাযথ সমীক্ষার মাধ্যমে উন্নয়ন করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, সমস্যাটি বর্তমান যে পর্যায়ে পড়েছে, তাতে ভবিষ্যতে পাহাড়ধস আরও বৃদ্ধি পাবে। পাহাড়ের মাটির স্তরগুলো সম্পর্কে জ্ঞান থাকা জরুরী। পাহাড়ধস রোধে এখনই একটি দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং যেসব পাহাড় ঝুঁকিপূর্ণ সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। পাহাড়ের পাশে অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা যাবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের পরিচালক ড. মাহবুবা নাসরিন বলেন, বন্যা-ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে আজ ভূমিধস ও পাহাড়ধস যুক্ত হয়েছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও বাসস্থান গড়ে ওঠা এর কারণ। পাহাড় বিনষ্ট রোধে জনসচেতনতা তৈরি জরুরী। তাছাড়া নীতিনির্ধারকদের সমন্বয়হীনতা অনেকাংশে দায়ী। পরিবেশ সংগঠন বাপার সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মোঃ আব্দুল মতিন বলেন, আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় পাহাড়ধসের ঘটনা নেই। কারণ তারা পরিবেশসম্মতভাবে বাড়িঘর তৈরি করে সেখানে বসবাস করে। অতএব একমাত্র আদিবাসী পরিবেশ সংরক্ষণের মধ্য দিয়েই এ সমস্যার একটি মৌলিক সমাধান হতে পারে।
×