ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পাহাড়ী ঢলে জেলার বিভিন্ন উপজেলা প্লাবিত;###;ডুবে গেছে বন্দরনগরীর নিচু এলাকা;###;বন্দর বহির্নোঙ্গরে পণ্য খালাস বন্ধ;###;আরও বর্ষণের পূর্বাভাস

চট্টগ্রামে ভারি বর্ষণে ফের পাহাড় ধস ॥ সীতাকুণ্ডে হত ৫

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ২২ জুলাই ২০১৭

চট্টগ্রামে ভারি বর্ষণে ফের পাহাড় ধস ॥ সীতাকুণ্ডে হত ৫

হাসান নাসির/জাহেদুল আনোয়ার চৌধুরী ॥ অব্যাহত ভারি বর্ষণ এবং পাহাড়ী ঢলে আবারও বিপর্যয় চট্টগ্রামে। আবহাওয়া দফতরের দেয়া পূর্বাভাসেও এ ধরনের ইঙ্গিত ছিল। শুক্রবার ভোরে সীতাকু- উপজেলার জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় পাহাড়ের পাদদেশের ঝুঁকিপূর্ণ একটি ঘরের ওপর মাটি ধসে পড়লে নিহত হয় দুই শিশুসহ পাঁচজন। এছাড়া পাহাড়ী ঢলে মারাত্মকভাবে প্লাবিত হয়েছে জেলার বিভিন্ন উপজেলা। ডুবে গেছে বন্দরনগরীর নিচু এলাকাগুলো। আবহাওয়া দফতর বলেছে, বায়ুচাপের তারতম্যের কারণে বৃষ্টিপাত সাময়িক অব্যাহত থাকতে পারে। সমুদ্রবন্দরগুলোর জন্য ৩ নম্বর সতর্কতা সঙ্কেত বহাল রয়েছে। ফলে বন্যা পরিস্থিতিও দীর্ঘায়িত হতে পারে। চট্টগ্রামে গত তিন দিন ধরে হচ্ছে বৃষ্টিপাত। থেমে থেমে এ বৃষ্টিপাত মাঝেমধ্যে এমনই অঝোর ধারায় ঝরছে যে, অল্প সময়ের মধ্যে ডুবিয়ে দিচ্ছে বিস্তীর্ণ এলাকা। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন স্থান। শুধু নিচু এলাকাই নয়, অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকাও পড়ছে বন্যার কবলে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো। শত চেষ্টা করেও প্রশাসন সব পাহাড় থেকে বসবাসকারীদের সরাতে সক্ষম হয়নি। বিশেষ করে শহরের বাইরে যে পাহাড়গুলো দৃষ্টির আড়ালে রয়ে গেছে সেখানে বসবাসরত স্বল্প আয়ের দরিদ্র মানুষ শিকার হচ্ছে করুণ বিপর্যয়ের। শুক্রবার ভোরে সীতাকু-ের জঙ্গল সলিমপুর এলাকায় পাহাড়ধসে মৃত্যু হয়েছে একই পরিবারের পাঁচজনের। নিহতরা হলোÑ জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল এলাকার রফিকুল ইসলামের স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৩৫) ও ছেলে মোঃ ইউনুস মিয়া (১০), নোয়াখালী থেকে বেড়াতে আসা রফিকুল ইসলামের বোন রাবেয়া বেগম (২০) এবং তার দুই কন্যা সামিয়া আক্তার (৭) ও লামিয়া আক্তার (২)। এছাড়া আহত হন রফিকুল ইসলাম, তার ভাই গিয়াস উদ্দিন ও গিয়াস উদ্দিনের মেয়ে জান্নাত। পাহাড়ধসের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মোঃ রুহুল আমিন, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মোঃ জিল্লুর রহমান চৌধুরী, চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার নুরে আলম মিনা, সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ আজিজুর রহমান সিদ্দিকী, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম ভূঁইয়া, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ রুহুল আমিন এবং প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধি। প্রশাসন সূত্রে জানানো হয়, উপজেলার জঙ্গল সলিমপুর ছিন্নমূল এলাকাসহ যেসব পাহাড়ী এলাকায় অতিরিক্ত বৃষ্টি হয়, সেসব এলাকায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব সময়ই মাইকিং করা হয়ে থাকে। একই ভাবে স্থানীয় চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা পাহাড়ে বসবাসরতদের সতর্ক করে থাকেন। কিন্তু পাহাড়ে বসবাসকারী স্বল্প আয়ের পরিবারগুলো সরে যেতে অনিচ্ছুক। গত বুধবার রাত থেকে শুক্রবার রাত পর্যন্ত সীতাকু- উপজেলায় সর্বোচ্চ বৃষ্টি রেকর্ড করেছে আবহাওয়া অফিস। অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে পুরো উপজেলা ডুবে যায়। তিন দিনের টানা বৃষ্টির ফলে শুক্রবার ভোরে জঙ্গল সলিমপুর পাহাড়ে ঘুমিয়ে থাকা রফিকুল ইসলামের পরিবারের ওপর এসে আছড়ে পড়ে পাহাড়ের একটি অংশ। এতে রফিকুল ইসলামের স্ত্রী, ছেলে এবং বেড়াতে আসা বোন ও দুই ভাগ্নি নিহত হয়। পরে উপজেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পাহাড়ধসে নিহতের লাশ উদ্ধার করে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করেন। পরিবারের লোকজন পরে তাদের নিজ বাড়ি নোয়াখালীর মাইজদী এলাকায় লাশগুলো নিয়ে যায়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল ইসলাম ভূঁইয়া এ বিষয়ে বলেন, ‘বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসনের নেতৃত্বে আমরা ফায়ার সার্ভিসের সহযোগিতায় লাশ উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি। আমরা বারবার পাহাড়ে বসবাসরতদের মাইকিং করে ও বিভিন্নভাবে সরে যেতে বলেছি। কিন্তু তারা সরতে চায় না। সরিয়ে দিলেও আবার এসে বসবাস শুরু করে।’ সীতাকু- উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) রুহুল আমিন জানিয়েছেন, ঘরের ওপর পাহাড়ের একাংশ ধসে পড়লে ওই পরিবারের সদস্যরা চাপা পড়ে। স্থানীয় লোকজন গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। পরে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা উদ্ধার অভিযানে অংশ নেন। তবে সেখান থেকে আর কোন লাশ উদ্ধার হয়নি। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আবহাওয়া দফতর জানায়, শুক্রবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১০৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার রাতে এবং শুক্রবার বেলা ১১টার আগ পর্যন্ত বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে। চট্টগ্রাম, মংলা এবং পায়রা সমুদ্রবন্দরকে ৩ নম্বর সতর্কতা সঙ্কেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে। সাগরে বর্তমানে কোন নিম্নচাপ কিংবা লঘুচাপ নেই। ইতোপূর্বে সৃষ্ট নিম্নচাপটি স্থল নিম্নচাপে পরিণত হয়ে ভারতের ওড়িশা উপকূলে অবস্থান করছে। তবে এর প্রভাব রয়েছে বঙ্গোপসাগরজুড়ে। মূলত বায়ুচাপের তারতম্যের আধিক্য থাকায় আরও বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে। সেজন্যই ৩ নম্বর সতর্কতা সঙ্কেত বহাল রাখা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে প্রকৃতির এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরণ বলে জানিয়েছেন আবহাওয়াবিদরা। শুক্রবারও চট্টগ্রামে ছিল প্রবল বর্ষণ। এর মধ্যে দুপুরের আগ পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের মাত্রা ছিল অনেক বেশি। দুপুরের দিকে বৃষ্টিপাত কিছুটা কমলেও মাঝেমধ্যেই আকাশের সাজ সাজ অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। সূর্যের আলো দেখা দিলেও তা আবার ঢাকা পড়ছিল মেঘের আড়ালে। যে পরিমাণ পানি জমেছে তা নেমে স্বাভাবিক পর্যায়ে আসতে বৃষ্টিহীন অন্তত দুটি দিন প্রয়োজন। কিন্তু বৃষ্টি এখনই সেভাবে থামার কোন আভাস দেয়নি আবহাওয়া অফিস। এতদিন বৃষ্টিতে ভোগান্তি মূলত শহরে হলেও বৃহস্পতি ও শুক্রবারের বৃষ্টিপাতে তলিয়ে গেছে গ্রামাঞ্চল। জেলার প্রতিটি উপজেলায় বর্ষণের কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। ডুবে গেছে সড়ক, আমন বীজতলা ও ক্ষেতের সবজি। পুকুরের পাড় ডুবে ভেসে গেছে মাছ। ফসলি জমি পানিতে কানায় কানায় পরিপূর্ণ। কৃষক ও মাছচাষীদের মাথায় হাত পড়েছে। ভারি বর্ষণের পর পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে চট্টগ্রামের সীতাকু- ও মীরসরাই। এ দুই উপজেলার পূর্বাংশে রয়েছে বিস্তীর্ণ উঁচু পাহাড়। সেখান থেকে প্রবল স্রোতে নেমে আসছে ঢল, যা মানুষের বাড়িঘর ডুবিয়ে ফেলে। এছাড়া বাঁশখালী, আনোয়ারা, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, ফটিকছড়ি, নাজিরহাট, পটিয়াসহ প্রায় প্রতিটি উপজেলা কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৃষ্টি থামার লক্ষণ না থাকায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অধিবাসীরা। চট্টগ্রাম নগরীর বেশিরভাগ এলাকাই প্লাবিত হয়েছে। শুধু নিম্নাঞ্চলই নয়, পানি এসে পড়েছে অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকায়ও। আগ্রাবাদ সিডিএ আবাসিক এলাকা, ছোটপুল, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, হালিশহর, নয়াবাজার, চকবাজার, কাপাসগোলা, চাক্তাই, মুরাদপুর, কাতালগঞ্জ, শুলকবহর এবং বহদ্দারহাট এলাকা রীতিমতো পানিতে থৈ থৈ অবস্থা। হাঁটু থেকে বুক পানিতে তলিয়েছে এলাকাগুলো। যানবাহন চলাচল থমকে যায়। বিরামহীন বর্ষণের কারণে অধিবাসীদের আটকে থাকতে হয় ঘরবাড়িতে। জনজীবন অনেকটাই স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা যায়, জেটিতে কন্টেনার ওঠানামা স্বাভাবিক থাকলেও অব্যাহত ভারি বর্ষণের কারণে বহিঃনোঙরে কোন কাজ করা যাচ্ছে না। বন্ধ হয়ে আছে বড় জাহাজ থেকে পণ্য লাইটারিং। ভিয়েতনাম থেকে আসা চালবাহী দুটি জাহাজের খালাস কাজও বন্ধ। বিশেষ করে বাল্ক কার্গো হিসেবে যে পণ্যগুলো আসে সেগুলো জাহাজেই ভাসছে। কারণ, হ্যাচ খুললেই পানি ঢুকে পণ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা। লাইটার জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেল (ডব্লিউটিসি) সূত্রে জানা যায়, সাগরে বাতাস এবং উত্তাল ঢেউ থাকায় সেখানে কোন কাজই করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, ছোট জাহাজগুলোর বহিঃনোঙর পর্যন্ত যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ঢেউ এবং বাতাস বেশি থাকায় লাইটার জাহাজগুলোকে বড় জাহাজের কাছাকাছি অবস্থান করানো অসম্ভব। ফলে দুর্যোগপূর্ণ এমন আবহাওয়ায় লাইটার জাহাজের বুকিংও নেই। মাদার ভেসেল থেকে পণ্য খালাস সম্ভব না হওয়ায় বহিঃনোঙরে অপেক্ষমাণ জাহাজের সংখ্যাও বাড়ছে।
×