ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ মিরাজুল ইসলাম

ধা রা বা হি ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

প্রকাশিত: ০৭:০৩, ২১ জুলাই ২০১৭

ধা  রা  বা  হি  ক ॥ উপন্যাস ॥ মোঘল গীবত

(পূর্ব প্রকাশের পর) সারমেয় সমাচার ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে আওরঙ্গাবাদ হতে বুরহানপুরে যাত্রাবিরতি দেয়া হলো। নিজ তাঁবুতে শাহজাদা আওরঙ্গজেব দুপুরের অবসরে পুরনো নথিপত্র উল্টাতে গিয়ে অনেক কিছুর মধ্যে খুঁজে পেলেন এক সচিত্র পুস্তিকা। সম্রাট আকবরের সময়কালের। সেখানে এক শিবভক্ত ‘কানফাটা যোগী’-কে তার পোষা কুকুর নিয়ে বসে থাকতে দেখা যায়। যার নিচে লেখা- ‘বিশ্বস্ততার দুনিয়াতে কুকুরের চেয়ে সেরা আর কে আছে?’ পুরনো পুস্তকগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকলেন আওরঙ্গজেব। সম্রাট বাবর দুই চোখে সহ্য করতে পারতেন না কুকুর প্রাণীটিকে। তুলনায় সম্রাট আকবর কেবল কুকুরপ্রেমিক ছিলেন না, কুকুর জাতির ভাল-মন্দ দেখভালের জন্য অনেক সুবন্দোবস্তের ব্যবস্থা করেছিলেন। বাবরের প্রিয় প্রাণী ছিল ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠেই শান্তি পেতেন। মদ্যপান, আফিম খাওয়া হতে শুরু করে যুদ্ধ-বিগ্রহ সবক্ষেত্রেই তিনি ঘোড়ার উষ্ণ সান্নিধ্য উপভোগ করতেন। একবার বাবর সন্দেহ করলেন তাঁর খাবারের সঙ্গে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছে। বাবরনামায় লিখেছিলেন, ‘আমি সাধারণত কখনও খাবারের পর বমি করি না, এমনকি সুরা পান করলেও। তাই আমার মাথায় সন্দেহ দানা বাঁধল। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার বাবুর্চিকে গ্রেফতার করতে বললাম ও আমার বমি একটা কুকুরকে খাওয়াতে আদেশ দিলাম।’ পরবর্তীতে সেই দোষী বাবুর্চিকে বাবর জ্যান্ত অবস্থায় শরীরের চামড়া ছিলে ফেলেছিলেন। তাঁর খাদ্য যে ব্যক্তি পরীক্ষা করেছিল তাকে কেটে টুকরা টুকরা করা হয়। ওই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যে নারীটি জড়িত ছিলেন তাকে হাতির পায়ের নিচে পিষে মারা হয় আর বেচারা কুকুরের কথা নাই বা বললাম। বিনা দোষে প্রাণীটি শাস্তি পেল। হিন্দুস্তানী কুকুরদের সুদিন এলো আকবরের আমলে। আকবর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত হতে নানান জাতের কুকুর আমদানি করেন। তাঁর প্রথম পছন্দ ছিল শিকারি কুকুর। সেগুলো দিয়ে তিনি বাঘ শিকার পর্যন্ত করতেন। কুকুরদের পাশে বসিয়ে দস্তরখানায় মাঝে মাঝে সঙ্গীদের নিয়ে খেতে বসতেন। আকবরের কুকুরপ্রীতিকে আরও উস্কে দিতে কোন কোন সভাসদ সম্রাটকে তৈলমর্দনের নিমিত্তে অতিরিক্ত কুকুরভক্তি প্রদর্শন করতেন। আকবরের জীবনীকার আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, মহামান্যকে খুশি করতে সভাসদদের কেউ কেউ খেতে বসে কুকুরের জিহ্বা নিজের মুখের ভেতর ঢুকিয়ে চুষতে থাকতেন। আকবরের শাসনামলে ১৬১২ হতে ১৬১৭ সালে থমাস কোরেয়াট নামের এক ব্রিটিশ ভদ্রলোক লন্ডন থেকে ভারত ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি আকবরের কুকুরের প্রতি চরম সহনশীলতার এক কাহিনী শুনিয়েছিলেন। আকবরের মাতা অভিযোগ করেন, পর্তুগীজ পাদ্রীরা এক কুকুরের গলায় পবিত্র কোরান শরীফ বেঁধে পুরো হরমুজ শহর চক্কর দেয়। তিনি দাবি করেন, পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে একটা গাধার পাছার সঙ্গে বাইবেল বেঁধে একই ভাবে পুরো শহর ঘোরানো হোক। আকবর তাঁর মাতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানান, একজন বিজ্ঞ সম্রাট হিসেবে তিনি কোন ধর্মের ওপর প্রতিশোধ নিতে চান না। এটা করলে ঈশ্বরের অপমান হয়। তিনি সেই কুকুরটিকেও বাড়তি শাস্তি দিতে নিষেধ করেন। আকবর আরও বিশ্বাস করতেন, কুকুরের দশটা গুণের মধ্যে একটাও যদি কোন ব্যক্তি অর্জন করত, তবে সে সাধু পুরুষে পরিণত হতো। শাহজাদা আওরঙ্গজেব সারমেয় জীবটিকে নিয়ে লেখা পুস্তিকাগুলোর দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকলেন। পূর্বপুরুষদের মতো প্রভুভক্ত কুকুর তিনিও পছন্দ করেন। তবে সেটা যদি মনুষ্য আকৃতির হয় তবে আরও ভাল। ইতোমধ্যে হিসাব কষে রাজ্যে ছড়িয়ে রেখেছেন অসংখ্য অনুগত গুপ্তচর। এ সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। আওরঙ্গজেবের মনে পড়ে গেল শাহ সুজার শিবিরে নিয়োজিত বিশ্বস্ত গুপ্তচর মোবারক বেগের কথা। ইতোমধ্যে খবর পেয়েছেন তার পরামর্শ মোতাবেক মুরাদের সেনাবাহিনী পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে যাচ্ছে। এখন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য আওরঙ্গজেবের আরও কিছু সময় দরকার। নিশ্চয়ই এতদিনে আগ্রায় এ অভিযানের সংবাদ পৌঁছে গেছে। বড় ছেলে সুলতান আগেভাগে বুরহানপুরে পৌঁছে যাবতীয় বিষয়ে তদারকি করে রেখেছিলেন। গুপ্তচর মারফত খবর পাঠিয়েছেন, তাঁর নানাজান শাহ নওয়াজ খানের মতিগতি নাকি ভাল না। সবাইকে নিজ জামাইয়ের বিরুদ্ধে বলে বেড়াচ্ছেন। এ অভিযান মুঘল সম্রাটের বিরুদ্ধে সরাসরি বিদ্রোহের শামিল। আপাতত নির্লিপ্ত থাকলেন আওরঙ্গজেব। অপেক্ষায় আছেন বেনারসে সুজা-সুলাইমানের যুদ্ধের সংবাদের জন্য। শীতের ঠাণ্ডা আমেজ আওরঙ্গজেবের ভেতরের উত্তাপ প্রশমিত করার জন্য যথেষ্ট নয়। বেশিদিন অপেক্ষায় থাকতে হলো না আওরঙ্গজেবকে। ভোরের দিকে প্রহরী জানাল বেনারস থেকে এক বিশেষ দূত এসেছে সরাসরি শাহজাদার সঙ্গে দেখা করতে। কালবিলম্ব না করে তাকে হাজির করতে বললেন শাহজাদা। সারা শরীরে রক্তের ছোপ নিয়ে ঘর্মাক্ত চেহারার এক সৈনিক এসে দাঁড়ালো আওরঙ্গজেবের সামনে। - কে পাঠিয়েছে তোমাকে? জিজ্ঞাসা করলেন শাহজাদা। - মোবারক বেগ হুজুর। তখনও হাঁপাচ্ছিল সৈনিকটি। - কী পাঠিয়েছে দেখাও। - তিনি কিছু লিখে পাঠাননি। বলেছেন সরাসরি আপনাকে মৌখিকভাবে সব জানাতে। - কেন? কারণ জানা থাকলেও পরীক্ষা করলেন আওরঙ্গজেব। - আমার মনিব মোবারক বেগ বলেছেন লিখিত চিঠি দিলে দারার রাজকীয় সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়লে মৃত্যু নিশ্চিত ও একই সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা প্রকাশ হয়ে যেতে পারে। - ঠিক আছে। আমি সন্তুষ্ট। এখন কী দেখেছো বলো...। - আজ হতে নয় দিন আগে গঙ্গার উত্তর পাড় দিয়ে সুলাইমানের বাহিনী আচমকা সুজার শিবিরে আক্রমণ চালায়। সুজার সেনাবাহিনী পুরোপুরি অপ্রস্তুত ছিল এ হামলা ঠেকাতে। সুজার প্রায় সব সেনাপতি নিহত হন। তাঁর কিছু অনুগত সৈন্য একটি হাতির পিঠে চড়িয়ে সুজাকে যুদ্ধক্ষেত্র হতে পালিয়ে যেতে সাহায্য করেন। খুব বিশ্রীভাবে পরাজিত হয়েছেন বাংলার সুবেদার। জানা গেছে, তিনি পূর্ব দিকে পাটনাতে পালিয়ে গেছেন। - সুলাইমানের অবস্থান এখন কোথায়? ব্যগ্রকণ্ঠে জানতে চাইলেন আওরঙ্গজেব। - হুজুর, শুনেছি তিনি শাহ সুজাকে ধাওয়া করতে পাটনার দিকে রওনা দিয়েছেন। আওরঙ্গজেবের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। (চলবে )
×