ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আক্তারুজ্জামান সিনবাদ

অন্তিম লগ্নে যন্ত্রণার ছাপ

প্রকাশিত: ০৭:০২, ২১ জুলাই ২০১৭

অন্তিম লগ্নে যন্ত্রণার ছাপ

শিল্পকলা তাঁর ছবিতে আগের মতই রং আছে কিন্তু রস নেই। শুধু আবেগের তীব্র আকুতির সামান্য কিছু রেশ। মনের মধ্যে যে আগুন কয়েক বছর ধরে জ্বলছিল তার প্রতিটি স্ফুলিঙ্গ ছবির রেখায় রেখায় ফুটিয়ে তুলে আজ যে ক্লান্ত। দুপুরে জ্বলন্ত সূর্যের নিচে ফাঁকা ক্ষেতে শুয়ে থাকে ভিনসেন্ট ভ্যানগগ। চোখে মুখে একী অপ্রকৃতিস্থতা। তবুও সূর্যোদয়ের মুহূর্তে রোজ ছবি আঁকা শুরু করে দেয় ভ্যানগগ। আর্লের সূর্য তাঁর মাথার চুলগুলো পুড়িয়ে দিয়েছে। দৃষ্টিশক্তিও যেন জ্বলে পুড়ে ছাই। শস্য ক্ষেতের সবুজ আর আকাশের ঘন নীল যেন একই ঠেকে চোখে। লাল রঙের বেড়া, হলুদ গম ক্ষেত আর জ্বলজ্বলে নীল আকাশ। ক্যানভাস ভরা স্বর্ণাভ হলুদ, আকাশী নীল আর বেগুনী রঙে। আর ক্যানভাস জুড়ে থাকে দামাল ঝড়। ধীরে ধীরে বাড়ে গ্রীষ্মের তেজ। প্রকৃতি জ্বলে পুড়ে থাক। ঝলসানো তামা রঙ, নাকি পুরনো সোনার? আকাশের উজ্জ্বল নীলে কেমন সবজেটে আভাস। সূর্র্যের আলো নেশা ধরানো হলুদ। এই হলুদ রং অকৃপণ হাতে ক্যানভাসে ব্যবহার করে ভিনসেন্ট। রেনেসাঁর পর ইউরোপীয় চিত্রকলার জগতে একদিন এই রড় অচল ছিল। আর ভ্যানেগগ ব্যবহার করে টিউবের পর টিউব। হলুদ ছাড়া রং কই? আর্লেয় সূর্যকে কি হলুদ রং ছাড়া ক্যানভাসে ধরে রাখা যায়? হেমন্তের ধানের ক্ষেত বদরে যায় যেন গমক্ষেতে। ছড়িয়ে থাকা খড়কুটোয় মুছে যাওয়া শস্যের গন্ধ। ‘গম ক্ষেতে কাক’ ছবিটি কী ভীতিকর অনুভূতি আনে মনে। যেন জীবনের অন্তিম লগ্নের মানবিক যন্ত্রণার ছাপ পড়েছে। দূরে অবায়িত উন্মুক্ত নীল আকাশে আর ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে উড়ে চলেছে একদল কারও কুৎসিত কাক। জীবনের আলো ঝলমলে হাসি ঝড়ানো ক্ষেতে কেন মৃত্যু দূত নামিয়ে আনলেন শিল্পী? কি এমন গোপন কষ্ট ছিল। তাঁর এই বসুধয়ার প্রতি, কি সেই চাপা অভিমান? ধারণা করা হয় ‘গমক্ষেতে কাক’ তাঁর শেষ ছবি। তবে এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন প্রমাণ নেই। কাক ভ্যানগগের জীবনের সঙ্গে প্রতীকী দিয়ে যুক্ত ছিল। কাকের সঙ্গে গমের ক্ষেত, একটি ডাবল বর্গাকার ক্যানভাস, একটি গমক্ষেতের ওপর কাকে ভরা একটি নাটকীয় মেঘলা। আকাশ নিয়ে রচিত। বিচ্ছিন্নভাবে উড়ন্ত কাক, বায়ু প্রবাহিত গমক্ষেত ক্যানভাসের দুই-তৃতীয়াংশ, প্রকৃতির সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে মিশে গেছে। ভয় প্রদর্শনকারী, কাকের কোলাহলপূর্ণ, দুর্যোগপূর্ণ আকাশ। অশান্ত আকাশের নিচে গমক্ষেত। কাক মৃত্যু এবং পূনর্জন্ম বা পুনরুত্থানের প্রতীক হিসেবে ভ্যানগগের চিত্রে এসেছে। রাস্তা লাল এবং সবুজ রং বিসদৃশ। যেন তীর্থ যাত্রার রাস্তা। অশান্তত মাঠ একাকীত্ব একটি ধারণা। যা গগের নিজের ভেতরের যন্ত্রণা ও হতাশার প্রতিনিধিত্ব করে। নীল আকাশ এবং হলুদ ক্ষেত দৌরাত্ম্যে একে অপরের থেকে দূরে টান তাদের ভাউন্ডারী জুড়ে। কালো কাকের পাল নড়বড়ে পুরো ভূমির দিকে অগ্রসর। এ যেন একটি শক্তিশালী বিপরীত ক্রিয়ার আবিষ্কার। কাক ও গমের ক্ষেতের মধ্যে কাককে সবচেয়ে শক্তিশালী ইমেজ মনে হয়। অনেক প্রতীকী তাৎপর্য কাকের পালের চিত্রাঙ্কন থেকে সঁজাত হয়েছে। দূরে উপরে উড়ন্ত বিশৃঙ্খলা কাকের দল। এমন বা কাছের কাকগুলো আবার দেখতে আবার দেখতে সজীব ও উচ্ছ্বল। গগের প্রকৃতিতে সবকিছুর জন্য একটি আবেগ এবং প্রথর নজর পরিলক্ষিত হয়। কাকের দল এবং একটি পথ দৃশ্যমান। যা চিত্রটির মাত্রাধিক বিষাদ জাঁকজমক এবং আড়াআড়ি বিশালতার ওপর জোর দেয়। কাকের সঙ্গে গম ক্ষেতের জন্য বিশালতার ওপর জোর দেয়। কাকের সঙ্গে গম ক্ষেতের জন্য শক্তিশালী রং সমন্বয় ব্যবহার। নীল আকাশ, গম হলুদ-কমলা সঙ্গে বৈপরীত্য যখন পথ লাল ঘাসের সবুজ ব্যান্ড দ্বারা তীব্রতর হয়। ব্রাশের কাজে গতিশীলতা, যা উড়ন্ত কাকা দ্বারা আরও অতিরিক্ত হয়। চিত্রটি একটি শক্তিশালী অনুভূতি সৃষ্টি করে। রং জীবনী শক্তি এবং প্রতিটি অশান্ত সম্প্রীতিও প্রতি ব্রাশ স্ট্রোক, অধরা গোপনীয়তা যদি থেকে থাকে তাহলে অনির্বচনীয় অন্তর্জগৎ মধ্যে চাকা অব্যাহত থাকবে কাকের মতো। পুরো চিত্রটি একটি আদিম প্রসার ও সরলতা প্রকাশ করে। মাথার ওপর আগুন ঝড়ায় সূর্য। ধেয়ে আসছে অগনতি কালো পাখি। আর দেখা যায় না সূর্যকে গগের সমস্ত চৈতন্যকে ডানার ঝাপটানিতে আচ্ছন্ন করে দেয় তারা। সোনালী শস্যক্ষেতে কালো পাখিরা। ঘণ্টা বেজে গেছে। শেষ প্রহরের এই ঘণ্টাধ্বনি শুনেছিল আলো। ‘গমক্ষেতে কাক’ চিত্রটি ভ্যানেগগের শব্দ মৌল্পিক উদ্বেগ এবং হতাশা লাইন বরাবর একটি সরল ব্যাখ্যা সমর্থন করে।
×