ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেজাউল করিম খোকন

দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা

প্রকাশিত: ০৭:০১, ২১ জুলাই ২০১৭

দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা

(পূর্ব প্রকাশের পর) গেট পেরিয়ে কিছু দূর যাবার পরেও কাউকে দেখা গেল না। তারপর আরও একটা দরজা পেরোতেই একজনার দেখা পোলো। বিসেপশনিস্ট হবে হয়তো লোকটা। হাসিমুখে সালাম করে বলোলো,‘ওয়েলকাম টু আওয়ার ভূত রেস্টুরেন্ট, স্যার, আপনি কি একা নাকি, সঙ্গে আরও গেস্ট আছে’? ‘আমরা দু’জন’ হাসান জবাব দেয়। ‘আসুন স্যার, রিসেপশনিস্টের আহ্বানে রেস্টুরেন্টের ভেতরে এগিয়ে যায় সে। তেমন ভিড় নেই। নিরিবিলি শান্ত সুনসান পরিবেশ। এক কোণায় একটা টেবিলের দু’পাশে দুটো চেয়ার মুখোমুখি পাতা রয়েছে। দুজনার খাবার দাবার এবং একান্তে কথা বলার জন্য এই ব্যবস্থা। মনে মনে রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষের ক্রিয়েটিভ চিন্তা ভাবনার প্রশংসা করলো হাসান। ‘ওকে এখানেই বসবো, আমার একজন গেস্ট আসবেন, উনি এলেই আমরা খাবারের অর্ডার দেবো’। ‘থ্যাংক ইয়্যু স্যার’ বলেই লোকটা আবার দরজার দিকে চলে যায় অন্য কাস্টমারকে রিসিভ করতে। হাসান আবার ঘড়ি দেখে। দুটো বেজে গেছে। ভেতরে তো রুমানা আগে থেকে এসে বসে নেই এ ব্যাপারে সিওর হওয়ার পর হাসান দরজার দিকে এগোয়। তখনই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে সালোয়ার কামিজ পরা এক মহিলা। উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের মহিলার চুলগুলো এখনও ভেজা। হয়তো কিছুক্ষণ আগে স্নান সেরেছে। মেক আপ এর চিহ্ন নেই মুখে। স্বাভাবিক সৌন্দর্য আর লাবণ্য ছড়িয়ে আছে সেখানে। তাকে দেখে বয়সটা ঠিক অনুমান করা যায় না। বয়স হলেও তার ছাপ পড়েনি চেহারা কিংবা ফিগারে। চমৎকার স্মার্ট ভঙ্গিতে হেঁটে আসছে সে। রুমানা বলেছিলো সে সালোয়ার কামিজ পরে আসবে, কোনো সাজগোজ করবে না, ওর চুলগুলো থাকবে খোলা আর কপালে থাকবে টিপ। হাসান এবার চিনতে পারে রুমানাকে। মনে মনে এতোদিন রুমানার যে ছবি এঁকে রেখেছিলো তার সঙ্গে মিল না থাকলেও এই মুহূর্তে রুমানাকে বেশ লাগছে দেখতে। এই বয়সেও তার মধ্যে নিটোল একটা সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে। যা যে কাউকে মুগ্ধ করবে। হাসান দাঁড়িয়ে রুমানার আগমনটা দেখছিলো, ঠিক সামনে আসতেই নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলে, ‘আপনি মানে তুমি রুমানা তো, আই এম হাসান। হাসানের কথা বলার ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলে রুমানা। ‘আরে বাবা, আমিই মিসেস রুমানা আফরোজ, দরজা দিয়ে ঢোকার সময় তোমাকে দেখেই আমি চিনেছি, আমি যেমনটা ভাবতাম তুমি ঠিক তেমনই, কোনো নড়চড় নেই। আমার প্রি এ্যাজমশন একেবারে মিলে গেছে। আমাকে দেখে তুমি পুরোপুরি হতাশ এ ব্যাপারে আমি হানড্রেড পাসের্ন্ট সিওর। তোমাকে তো আগেই অনেকবার বলেছি, আমি সে রকম নই মোটেই, তুমি আমাকে যেমনটি কল্পনা করেছ। আমি একটা পেতœী দেখলে তো এবার। আর এ জন্যেই তো এই ভূতের আস্তানায় ডেকেছি আজ তোমার ঘাড় মটকে খাবো বুঝলে ; রুমানার রসিকতায় হাসানও হাসতে থাকে। তারপর বলে, ‘এখানে দাঁড়িয়েই কথা বলবে না কি ভেতরে যাবে’? হাসান ও রুমানা মুখোমুখি বসে। ‘আমাকে এক নজর দেখেই তুমি কিভাবে কনফার্ম হলে আমিই রুমানা’? এরকম পোশাকে এলোচুল কপালে টিপ দিয়ে অন্য কোনো মহিলাও তো আসতে পারতো’। ‘আমার মনের ভেতর থেকে কে যেন বলে দিচ্ছিলো তুমিই রুমানা,’ দার্শনিক ভঙ্গিতে বলে হাসান। ‘ওমা তাই বুঝি, তোমার মনের মধ্যে আবার কে বাস করে গো’? রুমানা রসিকতার সুরে বলে। ‘বাসায় ছেলেকে কি বলে এসেছো’? ‘কী বলবো, আমি তো রোজই নানা কাজে বাইরে বেরোই, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফিরবো বলেছি’। এর মধ্যে ওয়েটার এসে খাবার অর্ডার নিয়ে যায়। হাসান অর্ডার দিতে চাইলে রুমানা বাধা দেয়, তুমি আজ আমার এলাকায় এসেছ তুমি আমার গেস্ট বুঝলে, আমি হলাম হোস্ট, আমিই খাবারের অর্ডার দেবো, আমার পছন্দ অনুযায়ী খাবার খেতে হবে তোমাকে? ‘ঠিক আছে বাবা, পড়েছি মোগলের হাতে খানা খেতে হবে তার সাথে। আমার অন্য কোনো উপায় আছে? কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে হাসান। ‘অফিস থেকে ছুটি নিয়ে এসেছো তো, সন্ধ্যের আগে তোমাকে আজ ছাড়ছি না, তোমার কোনো প্রবলেম হবে না তো? রুমানা জানতে চায়। ‘আমি অফিসে বলে এসেছি আজ আর ফিরব না, তোমার জন্য আধাবেলা ছুটি নিয়েছি। ‘ওহ ফাইন, আমার জীবনের অনেক না বলা কথা জমে আছে। আমার জীবনে গত তেইশ চব্বিশ বছরে অনেক কিছুই ঘটে গেছে যার অনেক কিছুই তুমি জানো না। আজ তোমাকে বলবো সব কথা, শুনতে শুনতে তুমি অবাক হয়ে যাবে হয়তো বা। আমাকে নিয়ে গল্প উপন্যাসও লিখে ফেলতে পারবে। তবে আমার রিকোয়েস্ট, ও কাজটা তুমি করবে না প্লিজ, আমাদের দু’জনার জীবনের একান্ত বিষয়গুলো আমাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকুক এটাই আমি চাই, রুমানা বলে। ওয়েটার খাবার রেডি করে টেবিলে সাজিয়ে রেখে যায়। ‘আমার ভীষণ ক্ষিধে পেয়েছে খাওয়া শুরু করে দিই কি বলো;’ কথা বলতে বলতে রুমানা নিজেই প্লেটে খাবার বাড়তে থাকে এবং হাসানের দিকে এগিয়ে দেয়। তারপর নিজের জন্য নেয়। ‘দুপুরে আমি খুব বেশি খাই না, হালকা সালাদ, ভেজিটেবল এসব খাই, শরীরটা ঠিক রাখতে হলে অনেক কিছু কন্ট্রোল করতে হয়, আমি এসব মেনে চলার চেষ্টা করি’, ভেজিটেবল রাইস চামচ মুখে দিতে দিতে বলে রুমানা। ‘রুমানা তুমি তোমার কথা বলো। এর আগে তোমার বিয়ে হয়েছিলো অন্য আরেকজনের সঙ্গে সেদিন বললে। কার সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়েছিলো, কখন বিয়ে করেছিলে তুমি’? কিছুটা অধীরভাবে প্রশ্ন করে হাসান। তারপর রুমানা বলতে শুরু করে, তোমার সঙ্গে চিঠিপত্র যোগাযোগ থাকতেই শিহাবের সাথে আমার পরিচয়। ঢাকাতেই আমাদের আলাপ এবং পরিচয়। বিমানের কেবিন ক্রু মানে এয়ার হোস্টেস হিসেবে আমি তখন দেশ-বিদেশে যাই। আকাশেই সময় কেটে যায়। যখন ফ্লাইট থাকতো না ঢাকায় নিজেকে বড্ড নিঃসঙ্গ মনে হতো। সময়গুলো কাটতেই চাইতো না, হাঁপিয়ে উঠতাম। চিঠিপত্রের মাধ্যমে তোমাকে যেভাবে আপন ভাবতে শুরু করেছিলাম তোমার খুব কাছাকাছি চলে এসেছিলাম তোমাকে সামনা-সামনি না দেখে, টেলিফোনে কথা না বললেও তোমার মনটা সম্পর্কে আমার স্পষ্ট একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিলো। আমি ঠিকই বুঝে নিয়েছিলাম, খুব ভদ্র শান্তশিষ্ট একজন মানুষ তুমি। তুমি সবে মাত্র চাকরিতে ঢুকেছ। তখন আমি একটা আশ্রয় খুঁজছিলাম ঢাকা শহরে। আমার জীবনের জন্য একটা নির্ভরতার খুব প্রয়োজন ছিলো। শিহাবের সান্নিধ্যে যাবার পর মনে হলো তার ওপর আমি নির্ভর করতে পারি। চাকরি-বাকরি করতো না সে। বুয়েট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করার পর এখানে-ওখানে চাকরির সন্ধানে ছিল। ঢাকা শহরে তারও কোনো স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। থাকতো তার এক ফুফুর বাসায়। ওখানে থেকেই পড়াশোনা করতো। বেকার জীবনেও থাকতো ফুফুর বাসাতেই। বড়লোক ফুফুর বাসার টুকটাক কাজ-কর্ম, ব্যাংকে গিয়ে ইলেকট্রিক বিল, গ্যাস বিল লোনের কিস্তির টাকা জমা দেয়ার কাজ করা ছাড়া আর করার কিছুই ছিল না। তেমন একটা ছেলেকেই আমার কেন যে ভালো লেগে গিয়েছিলো, তাকেই আমার অনিশ্চিত জীবনের একজন নির্ভরযোগ্য মানুষ ভাবতে শুরু করেছিলাম, জানি না। এয়ার হোস্টেসদের বিয়ে করার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের নানা রকমের বিধিনিষেধ থাকে। অফিসের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তাদের না জানিয়ে অনেকটা লুকিয়েই একদিন শিহাবের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। বিয়েতে শিহাবের তেমন আগ্রহ বা তাড়া না থাকলেও আমি নিজেই তৎপর হয়েছিলাম বিয়ের জন্য। কারণ আমি ঢাকা শহরে একটা ঠিকানা গড়তে চেয়েছিলাম, নিজের নিরাপত্তা এবং নিশ্চিত জীবনের জন্য। বিয়ের পর আমরা ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে উঠলাম। দেড় রুমের ছোট্ট ফ্ল্যাট। কোনোভাবে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা হয়েছিল। আমার ধারণা ছিল, বিয়ের পর শিহাবের মধ্যে একটা পরিবর্তন আসবে। দায়িত্ববোধ জাগবে আমার ব্যাপারে, কেয়ারনেস ভাব আসবে। কিন্তু আমাদের দাম্পত্য জীবন একবছর পূর্ণ হয়ে যাবার পরেও তার মধ্যে কোন পরিবর্তন এলো না। ততোদিনে আমার বিয়ের ব্যাপারটা অফিস জেনে গেছে। তাদের না জানিয়ে বিয়ে করায় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে আমাকে গ্রাউ-েড করা হয়। ব্যাপারটা আমার কাছে অপমানজনক মনে হয়। তীব্র অভিমানে এয়ার হোস্টেসের চাকরিটা ছেড়ে দিই। শিহাবের মধ্যে তখনও দায়িত্ববোধ না জাগায় আমি অবাক হয়ে যাই। যার ওপর ভরসা করে আমি ঢাকা শহরে নিজের একটা ঠিকানা গড়তে তাকে বিয়ে করেছিলাম সে-ই আমার ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল দিনে দিনে। ফুফুর বাড়ি ছেড়ে আমার সঙ্গে ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকলেও নিজে উপার্জন করে আপন যোগ্যতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার কোনো তাগিদই সৃষ্টি হয়নি শিহাবের মধ্যে। নিজে একজন ইঞ্জিনিয়ার হওয়া সত্ত্বেও এয়ার হোস্টেস-এর চাকরিতে ভালো বেতন হওয়ায় আমার উপার্জন-এর ওপরই নির্ভর করতে শুরু করেছিলো। আমাকে আরও বেশি করে উপার্জনের জন্য নানা রকম ধান্ধার জন্য প্ররোচিত করতে শুরু করেছিল। এয়ার হোস্টেসদের বিদেশ থেকে স্বর্ণ এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র এনে ব্যবসা বাণিজ্য করার নানা সুযোগ থাকে। এছাড়া কেউ কেউ স্বর্ণ পাচারকারী, মাদক ব্যবসায়ীদের বাহক হিসেবে কাজ করে লাখ লাখ টাকা উপার্জন করতো। আমাকেও অনেক অফার দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আমার বিবেক কোনোদিনই তেমন কাজকে সমর্থন করতে পারেনি। অনেক লোভনীয় অফার পেলেও আমি তাতে সাড়া দিইনি। শিহাব এসব জানতো। আমাকে অনেকভাবে প্ররোচিত করতে চেয়েছে সে। রাতারাতি বড় লোক হওয়ার জন্য অবৈধভাবে টাকা-পয়সা উপার্জনের জন্য আমাকে অনেক চাপাচাপি করেছে। কিন্তু আমি অটল ছিলাম আমার নীতিতে। এর মধ্যে আমি মা হবার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠি। শিহাবও চাইতো আমি ওর সন্তানের মা হই। কিন্তু পর পর কয়েকবার আমার মিসক্যারেজ হয়ে যায়। আমি নিজেও তাতে বেশ ভেঙ্গে পড়ি। এয়ার হোস্টেস-এর চাকরিটাকে আমাদের সমাজে তখনও খুব ভালোভাবে নিতে পারেনি। আমার আত্মীয়স্বজনদের অনেকেই এ নিয়ে আড়ালে আজেবাজে কথা বলতো। আবার কেউ কেউ সামনাসামনি এমন আচরণ করতো যেন আমি খুব খারাপ একটা কাজ করছি, নষ্ট হয়ে গেছি। এই সমাজে আমার পরিচয় একজন নষ্ট নারী হিসেবে। আমি অবশ্য এসব একদম কেয়ার করতাম না। কারও অপমান গায়ে মাখতাম না। নিজের ব্যাপারে আমার মধ্যে এক ধরনের শক্তিশালী আত্মবিশ্বাস ও প্রত্যয় ছিল। আমি কোনো খারাপ কিছু করছি না, নিজের যোগ্যতা, মেধা ও শ্রম দিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চাইছি। আমার মধ্যে কোনো পাপবোধ নেই। নিজের পরিশ্রমে জীবনে সুখ শান্তি আনতে চাইছি। আমি কোনোভাবেই পরাজিত হবো না, তেমন বিশ্বাস ছিল। কিন্তু পরপর কয়েকবার মিসক্যারেজ হয়ে যাওয়ায় এবং শিহাবের সংসার ও বৈষয়িক জীবনে চরম উদাসীনতা ইত্যাদির পর এয়ার হোস্টেসের চাকরিতে গ্রাউন্ডেড করে দেয়ার ঘটনা আমাকে ভীষণভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিলো। আমি অনেক দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। অনেকটা জেদের বশে চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছিলাম। একটানা নিজের অতীত জীবনের কথাগুলো বলতে বলতে কিছুটা হাঁপিয়ে ওঠে রুমানা। গলাটাও শুকিয়ে গেছে। বোতল থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে নিয়ে কয়েক ঢোক খায়। ‘তারপর কী হলো?’ কৌতূহলী হয়ে হাসান জানতে চায়। এয়ার হোস্টেস এর চাকরিটা এভাবে হঠাৎ করেই ছেড়ে দেবো কল্পনাও করতে পারেনি শিহাব। আমাকে সোনার ডিম পাড়া রূপকথার সেই হাঁস ভাবতে শুরু করেছিল সে। চাকরি ছেড়ে দেয়ার পর রীতিমতো ক্রেজি হয়ে উঠলো। আমার সঙ্গে ওর দুর্ব্যবহার চরমে পৌঁছুলো। প্রথমদিকে মুখ বুজে সহ্য করলেও একসময় আমি প্রতিবাদ শুরু করলাম। এতে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠলো শিহাব। আমি আগেই জেনেছিলাম জুয়ার নেশায় মেতেছে সে। আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে জুয়ার আড্ডায় গিয়ে সব হারিয়ে আসতো। আমার উপার্জন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জুয়ার আড্ডায় গিয়ে টাকা ওড়ানোর সুযোগ হারিয়ে ফেললো। ভেবেছিলাম এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। ভালো হয়ে যাবে লোকটা। কিন্তু আমার কাছ থেকে টাকা না পেয়ে বাইরে যার তার কাছ থেকে ধারকর্জ শুরু করে দিলো। নিজের সামাজিক অবস্থান, প্রেস্টিজ, শিক্ষাদীক্ষা সবই জলাঞ্জলি দিয়ে অল্পদিনেই অনেক টাকা ধার করায় ঠিকভাবে বাসায় বসবাস করা তার জন্য অসম্ভব হয়ে পড়লো। পাওনাদারদের নানা হুমকি, অশোভন আচরণ, নানা ধরনের কুপ্রস্তাব, দুর্ব্যবহার আমাকেও অতিষ্ঠ করে তুলেছিলো। অনেক টাকার ঋণের ভারে বিপর্যস্ত অসহায় শিহাব তখন পালিয়ে বেড়াতে শুরু করলো। বাসায় থাকতো না প্রায় সময়ে। অনেক গভীর রাতে বাসায় ফিরতো। আমি একাকী কীভাবে থাকছি, সংসার কীভাবে চলছে আমি খেয়েছি না অনাহারে আছি সেদিকে তার কোনো ভ্রƒক্ষেপ ছিলো না। আমার নিজের কিছু গয়নাগাটি ছিল। সেগুলো বিক্রি করে কয়েকদিন চলার পর আমার হাত একেবারে শূন্য হয়ে যায়। কার কাছে গিয়ে হাত পাতবো? ঢাকা শহরে আমাকে সাহায্য করার মতো আপনজন বলতে তখন কেউ ছিল না পাশে। পরিবারের কারও মতামত না নিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে শিহাবকে বিয়ে করেছিলাম। এ কারণে নিজের অসহায় অবস্থার কথা জানিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে সাহায্য-সহযোগিতা চাওয়ার অবস্থা ছিল না। কথাগুলো বলতে গিয়ে রুমানার গলাটা ধরে আসে। কয়েক মুহূর্ত কিছু বলতে পারে না। চুপ থাকে। তারপর আবার বলতে শুরু করে সে, ‘তখন আমি একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে চাকরি নিই, বেতন খুব বেশি ছিল না। তারপরেও আমি মহাসংকটের মধ্যে সামান্য খড় কুটো অবলম্বন করে উত্তরণের পথ খুঁজছিলাম। একসময় আমার স্কুলের চাকরির কথা জেনে যায় শিহাব। আমার কাছে জুয়া খেলার জন্য টাকা চাইতে শুরু করে। আমি তাকে একটি টাকাও দেবো না, কঠিন ভাষায় জানিয়ে দিই। জবাবে সে আমার গায়ে হাত তোলে। আমি তখন চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি। শিহাবকে ডিভোর্স দিয়ে ওর ভাড়া করা ফ্ল্যাট থেকে চলে আসি। ‘এরপর কোথায় গিয়ে উঠলে তুমি আর তোমার স্কুলের চাকরির কী হলো?’ হাসান অনেক উত্তেজনা নিয়ে জানতে চায়। রুমানার মুখে তার জীবনের গল্প শুনতে শুনতে হাসান নিজেও কেমন যেন হয়ে যায়। গল্প উপন্যাস নাটক সিনেমার কাহিনীর মতো মনে হতে থাকে সবকিছুই। ভেতরে চেপে থাকা উত্তেজনা প্রকাশ পায় তার কাছে। ‘শিহাবকে ডিভোর্স দিয়ে আমি গিয়ে উঠি আমার এক বান্ধবীর ফ্ল্যাটে। আরেকটা মেয়েকে নিয়ে দু’জনে মিলে দু’রুমের একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতো সে। স্কুলের চাকরিটা তখন আমার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠেছিলো। ওটা ছাড়ার কোনো উপায় ছিল না। আমাদের এই সমাজে সিঙ্গেল মেয়েদের একাকী জীবনযাপন কতো কঠিন ব্যাপার তখনই টের পেতে শুরু করলাম। পদে পদে নানাজনের সন্দেহ আর অনেক কৌতূহলের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতে হয়। সমাজে এটাকে কেউ সহজভাবে গ্রহণ করতে চায় না। আজেবাজে কথা শুনতে হয়। কেউ কেউ একাকীত্বের সুযোগ নিয়ে নানা ফায়দা লুটতে ফন্দি ফিকির করে। ব্যাপারগুলো আমার জীবনে আরেক দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা বয়ে আনতে শুরু করে। তখনই হঠাৎ একদিন শাহেদ চৌধুরী মানে আমার হাসব্যান্ডের সাথে পরিচয় হয়। লোকটার বিয়ের বয়স পেরিয়ে গেছে। কিন্তু বাবা ব্যবসা বাণিজ্য গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রি এক্সপোর্ট ইমপোর্টের নানা বিষয় দেখতে গিয়ে বিয়ে সাদী করা হয়ে ওঠেনি। ভাইবোন আরও থাকলেও তারা কেউ তার মতো যোগ্য এবং দায়িত্ববান ছিল না। ফলে পুরো ব্যবসা-বাণিজ্যের দেখভাল তাকেই করতে হতো। নিজের আলাদা সংসার করার কথা ভুলেই গিয়েছিল মানুষটা। আমার সাথে পরিচয় এবং আলাপের পর কেন জানি আমাকে তার ভীষণ ভালো লেগে যায়। এর আগে কোনো মেয়ের সঙ্গে তেমন অন্তরঙ্গ হওয়ার তাগিদ অনুভব করেনি সে। আমার সঙ্গে তার বয়সের কিছুটা ব্যবধান থাকলেও একসময়ে আমিও তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। তাকে আমার ভালো লেগে যায়। একদিন শাহেদ চৌধুরী সরাসরি আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলে আমি আমার সব কথা তাকে খুলে বলি। শিহাবের সঙ্গে আমার বিয়ে এবং ডিভোর্সের বিষয়টা জানার পরেও আমাকে নিয়ে নতুন জীবন শুরুর ব্যাপারে অটল থাকে সে। আমি নিজেও তখন সিঙ্গেল নারী হিসেবে এই ঢাকা শহরে একাকী জীবন-যাপন করতে গিয়ে নানা বিরূপ অভিজ্ঞতা অর্জনের কারণে শক্ত একটা অবলম্বন খুঁজছিলাম নিশ্চিত জীবনের আশায়। শাহেদ চৌধুরী অনেক ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান, তাদের অর্থবিত্ত প্রাচুর্য অনেক। সমাজে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি এবং সম্মান! সে তুলনায় আমি নিতান্তই সাধারণ ঘরের মেয়ে। বাবা নেই, মা থাকেন মফস্বল শহরে। আমাদের অর্থবিত্ত বলতে তেমন কিছুই নেই। আমি বাড়িতে মায়ের কাছে গিয়ে থাকবো সে উপায়ও নেই। পরিবারের অমতে ঢাকায় প্রেম করে বিয়ে করেছিলাম, সেই বিয়েটা টিকেনি। নিজে তেমন কোনো চাকরি বাকরি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে পারিনি। আমি পদে পদে পথ চলতে গিয়ে আমার অসহায়ত্ব অনুভব করছিলাম। তাই নিজেকে সেই অসহায় অবস্থা থেকে টেনে তুলতে অনেকটা মরিয়া হয়েই শাহেদ চৌধুরীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। আমাদের বিয়ে হয়ে যায় একদিন। বধূবেশে আমি শাহেদ চৌধুরীর বাড়িতে উঠে আসি। তার সংসারে এসে উপলব্ধি করি মানুষটার সত্যি খুব ভালো উদারমনা, আমার আগে একবার বিয়ে হয়েছিলো শিহাবের সঙ্গে, কয়েক বছর দুঃসহ দাম্পত্য জীবন কেটেছে আমার সবই ভুলে গেলাম আমার স্বামী শাহেদ চৌধুরীর সান্নিধ্যে এসে। শ্বশুর বাড়ির লোকজনেরাও আমাকে সহজভাবে গ্রহণ করেছিলো। শিহাবের সাথে থাকতে গিয়ে আমি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যে অন্ধকার হতাশার মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম, তা দূর হয়ে গেলো। আমি আবার লেখাপড়া শুরু করলাম। ডিগ্রি এবং মাস্টার করলাম। পড়াশুনার ব্যাপারে আমার স্বামী আমাকে নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। যে কারণে এক চান্সেই পাস করলাম পরীক্ষাগুলোতে। মাস্টার্স কমপ্লিট করতে না করতে আমার কোলজুড়ে এলো আমাদের সন্তান অনন্যা। ওকে পেয়ে আমার জীবনটা যেন আরও পরিপূর্ণ হলো। নিজের ওপর আমি আরও আস্থাশীল হয়ে উঠলাম। স্রেফ স্বামীর ওপর সবকিছুতে নির্ভরশীল না থেকে নিজে নিজে কিছু করার জন্য উদ্যোগী হলাম। বড় বড় কয়েকটা অফিসে দুপুরের লাঞ্চ তৈরি করে সাপ্লাইয়ের জন্য ক্যাটারিং সার্ভিস চালু করলাম নিজের একান্ত চেষ্টায়। আমার স্বামীর অর্থ বিত্তের অভাব ছিলো না। আমার বাড়িতে আয়ের ধান্ধা করার কোনো প্রয়োজন না থাকলেও শাহেদ আমার উদ্যোগকে পুরোপুরি সমর্থন করলো। এ কাজে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করলো। অল্পদিনের মধ্যেই আমার ক্যাটারিং বিজনেজ বেশ জমে উঠলো। ঘর সংসার করে পাশাপাশি আমি এই বিজনেজটা বেশ চালিয়ে যাচ্ছি। ঢাকায় বেশ অনেকগুলো ব্যাংক এবং কর্পোরেট অফিসে আমার ক্যাটারিং সার্ভিস থেকে রেগুলার লাঞ্চ স্যাপ্লাই হয়। এছাড়া বেশবিছু নামী-দামী ডিপার্টমেন্টাল শপে হোম মেড সিঙ্গার, সমুচা ও অনন্য নাস্তা সাপ্লাইয়ের কাজও করছে আমার লোকজন। এ কাজে আমার আলাদা একটা সুনামও তৈরি হয়েছে এর মধ্যে। এতো ব্যস্ততা ছুটোছুটির মধ্যেও আমি ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএটাও কমপ্লিট করেছি। আমি চাইলে এখন যেকোনো কর্পোরেট জবও করতে পারি। এতোসব কিছুর পেছনে শাহেদ চৌধুরীর মানে আমার স্বামীর অবদান সবচেয়ে বেশি। যখনই আমি যা করতে চেয়েছি সেটা সাপোর্ট করেছে, প্রয়োজনে সাহায্য করেছে। আজ আমার অর্থবিত্ত, প্রভাব, প্রতিপত্তি, সম্মান, পরিচিতি সবই হয়েছে, নিজেকে শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছি। এখন আমার মধ্যে কোনো হতাশা নেই, দুঃখ বেদনা নেই, আমার আত্মীয়স্বজনরাও এখন আমাকে নিয়ে গর্ব করে। তারা খুব বড় গলায় আমার পরিচয় দেয় । হাসান, এখন আমার কোনো দুঃখ নেই, আমার মধ্যে না পাবার কোনো বেদনা নেই। বলতে বলতে আবেগে গলা জড়িয়ে আসে রুমানার। হাসান বেশ কয়েকমুহূর্ত তার দিকে তাকিয়ে থাকে। শত প্রতিকূলতা অনেক কঠিন বাধা অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত জীবন যুদ্ধে জয়ী একজন নারীর সামনে মুখোমুখি বসে আছে সে। রুমানাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে সে এই মুহূর্তে। (চলবে)
×