ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজিম উদ্দিন;###;মোহাম্মদ কামরুল হাসান

হালদা ॥ পাকিস্তানের প্রথম গণহত্যা

প্রকাশিত: ০৭:০০, ২১ জুলাই ২০১৭

হালদা ॥ পাকিস্তানের প্রথম গণহত্যা

১৪ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার, ১৯৭১, ছিল কফিনের শেষ পেরেক। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর, নয় মাসজুড়ে ছিল এমন নৃশংসতা। দেশজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ধ্বংসযজ্ঞ ও গণহত্যা। কেবল নির্দিষ্ট একটি বছর নয় বরং পাকিস্তানের দীর্ঘ ২৩ বছরের পুরোটা সময়জুড়ে ছিল এমন রক্তপাতে ভরা। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯ গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭১, সব পর্বেই ছিল রক্তের দাগ। তবে এ হত্যাযজ্ঞের শুরু পাকিস্তান সৃষ্টির জন্মলগ্নেই। পাকিস্তান হওয়ার পরপরই পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী তাদের স্বরূপ উন্মোচন করে। সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীকে চাপিয়ে দেয় নিজেদের ভাষা উর্দু। এ নিয়ে ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিবাদ ও আন্দোলন। যদিও তখন এ নিয়ে কোন গুলি চলেনি। পড়েনি কোন লাশ। কারণ তার আগেই অপেক্ষা করছিল আরেকটি অজানা অধ্যায়। রক্তরাঙ্গা হালদা হত্যাযজ্ঞ। যা পাকিস্তানের প্রথম গণহত্যা বলে বিবেচিত। এ বর্বরতম হত্যাকা- সংঘটিত হয় উত্তর চট্টগ্রামে। হালদা নদীর বাঁকে। হালদা নদী নদী মাতৃত্রিক বাংলাদেশের ছোট বড় ৮০০ নদীর মধ্যে ছোট একটি নদীর নাম হালদা। প্রকৃতির এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। বিশ্বের একমাত্র জোয়ার ভাটার নদী। যেখানে প্রাকৃতিকভাবে মৎস্য প্রজনন হয়। যে নদীকে চীনের মেকং নদীর সঙ্গে তুলনা করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের বাটনাতলী পাহাড় হতে উৎপন্ন হয়ে হালদা কর্ণফুলী নদীতে মিশেছে। হালদার দৈর্ঘ্য ৮১ কিলোমিটার যার মধ্যে ২৯ কিলোমিটার অংশ সারা বছর বড় নৌকা চলাচলের উপযোগী থাকে। হালদা নদী বাংলাদেশের সাদা সোনার খনি হিসেবেও পরিচিত। এ নদী শুধু মৎস্য সম্পদের জন্য নয় বরং যোগাযোগ, কৃষি ও পানি সম্পদেরও একটি বড় উৎস। এই নদী থেকে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ প্রভৃতি কার্প জাতীয় মাছের সরাসরি ডিম সংগ্রহ করা হয়। গত শতকের পঞ্চাশ দশকে দেশের মোট মৎস্য চাহিদার ৭০ ভাগ পূরণ করত হালদা নদীর পোনা। মৎস্য অধিদফতরের ‘সংকলন ২০১৩’ থেকে জানা যায়, হালদা থেকে ১৯৪৫ সালে সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ ছিল ১,৩৬,৫০০ কেজি। যা ৬৫ বছর পর ২০১১ সালে এসে দাঁড়ায় ১৩,০৪০ কেজিতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য ২০১২ সালে হালদা নদীতে বাঁধ দেয়ার পর থেকেই মাছের ডিম ছাড়ার পরিমাণ নাটকীয়ভাবে হ্রাস পায়। ফিরে যাওয়া যাক ১৯৪৮ সালে। পাকিস্তান সৃষ্টির লগ্নে। আমরা সকলেই পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন সম্পর্কে কম-বেশি অবগত। ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে দ্বিজাতিত্ত্বের ভিত্তিতে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সৃষ্টি। কিন্তু ধর্ম-বর্ণ-গোত্রনির্বিশেষে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সবাই মিলে সমঅংশীদারির ভিত্তিতে একটি জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের যে আকাক্সক্ষা তা পূরণ না হয়ে বরং শুরুতেই তা সংঘাতে রূপ নেয়। পাকিস্তান সৃষ্টি লগ্নে পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগের রাজনীতিক প্রভাবের বাইরে কিছু রাজনৈতিক উদ্যোগ ও ঐক্য দেখা গিয়েছিল। তার মধ্যে বাম ধারার নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ। এছাড়া ১ সেপ্টেম্বর (১৯৪৭) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্রদের নিয়ে গঠিত হয় ‘তমদ্দুন মজলিস’। পাকিস্তান জন্ম হওয়ার আগেই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। এরপর ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচীতে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন বিরোধী দলের পক্ষে কংগ্রেস থেকে নির্বাচিত সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজীর পাশাপাশি বাংলাকে কেন্দ্র ও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি জানান। এ প্রস্তাব নিয়ে সংসদ অধিবেশনে আলোচনা হয়। কিন্তু প্রস্তাবের সমালোচনা করেন পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। তিনি এ প্রস্তাবের ঘোরতর বিরোধিতা করেন। ফলে ভাষা বিতর্কের কারণে শুরুতেই পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে দূরুত্ব সৃষ্টি হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি ‘তমদ্দুন মজলিস’ এক সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সংগঠনটি। পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার এ উত্তাপ অন্যান্য জেলা শহরেও এসে লাগে। বন্দর নগরী চট্টগ্রামেও এ নিয়ে আন্দোলন গড়ে উঠে। কিন্তু অবাক করার বিষয়Ñ মার্চের এক মাস আগেই ফটিকছড়ির নানুপুর গ্রামে এক বিশাল সমবেশের আয়োজন করা হয়। তবে আন্দোলনগামী এসব মানুষের দাবি ভাষা নয় বরং জনদুর্ভোগ লাঘব। সম্মলনে অংশ নেন ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও রাউজানের অগণিত মানুষ। এ জনসমাবেশে সভাপতিত্ব করেন মুসলিম লীগের এক মন্ত্রী। কিন্তু দুর্ভাগ্য পাকিস্তান সরকার মানুষের সেই দুঃখের কথা, দুর্ভোগের কথা তখন গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়নি। এ নিয়ে একজন লোকাল এমএলএ (মেম্বার অব লেজিসলেটিভ এ্যাসেম্বলি) ইস্ট পাকিস্তান লেজিসলেটিভ এ্যাসেম্বলিতে মন্ত্রীকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করেন। জানতে চান তিনি বা তার সরকার কিভাবে হাটহাজারী মানুষের চরম কষ্টকে উপেক্ষা করছে। হালদা নদী কম প্রশস্ত হলেও বর্ষাকালে তা ফুলে ফেঁপে ওঠে। ভাঁটি অঞ্চলকে করে প্লাবিত। চরম জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে। পাহাড়ের আকাঁ-বাঁকা পথে তীব্র গতি নিয়ে চলতে চলতে হালদা গড়দুয়াড়া, মেখল ও মাদার্শার নিচু ভূমিতে আসার পর আঁকা-বাঁকা সর্পিল জিগজাগ আকৃতি নিয়ে মন্থর গতিতে প্রভাহিত হতো। কিন্তু বর্ষা এলেই এ মন্থর গতি দাম্ভিকতার রূপ নিত। ভাসিয়ে দিত দুই পাড়ের কৃষি জমি, বসতভিটাসহ পুরো এলাকা। একদিকে পাহাড় থেকে নির্গত তীব্র জলস্রোত আর অন্যদিকে কর্ণফুলী নদীর জোয়ারের পানির উর্ধমুখী গতি। এই পরস্পর মুখী তীব্র বেগের কারণে সাধারণ মানুষের দুর্গতি বেড়ে যেত। হালদা পারের মানুষের সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে তাই উদ্যোগ নেন স্থানীয় প্রভাবশালী গণ্যমান্যব্যক্তিরা। এ নিয়ে সরকারের অনিহা ও সদিচ্ছার যে অভাব তা স্থানয়ীরাই পূরণ করতে চাইলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন ফাঁড়ি কাটার। মাদার্শা গ্রামের রামদাশ মুন্সীর হাট থেকে আধামাইল লম্বা ফাঁড়ি কাটার সিদ্ধান্ত হয়। যে স্থানটিতে ছিল একটি হিন্দু জমিদার বাড়ি। এ ফাঁড়ি কাটা হলে হালদা নদীর গতি পথ পাঁচ-ছয় মাইল ছোট হয়ে যাবে। যে কারণে নদীর দুই কূলের ভাঙ্গন ও বন্যার প্লাবণ থেকে মুক্তি পাবে এলাকার আপামর জনগণ। এ খাল কাটার ফলে নদী প্লাবিত অনেক কৃষি জমিও পনরুদ্ধার করার স্বপ্ন দেখছিলেন এলাকাবাসী। যা বর্ষার পানিতে তলিয়ে থাকে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার টাকার অভাব ও বৈজ্ঞানিক কারণ দেখিয়ে খাল কাটার বিরোধিতা করে। সঙ্গে খাল কাটার ব্যাপারে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ। কিন্তু জনগণ এ সিদ্ধান্ত মানলেন না। এ ঘটনার আগেও হালদা পারের মানুষ ছোট ছোট খাল ও ফাঁড়ি কেটেছেন। যেহেতু অতীতে খাল কেটে গতিপথ সোজা করার অভিজ্ঞতা তাদের ছিল। তাই নিজেদের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য তারা পুনরায় সে সঙ্কল্প ব্যক্ত করল। কিন্তু সরকারের নিযুক্ত থাকা কর্মচারীরা এ নিয়ে মাদার্শার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করে, তার সমাধান করার কিংবা ফাঁড়ি কাটার অপকারিতা কথা মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার কোন উদ্যোগ নেয়নি। তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকারের পক্ষ থেকেও এ নিয়ে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এমনকি আগ্রহও দেখায়নি সরকার পক্ষ। ১৯৪৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের বন্দর নগরী চট্টগ্রামের অদূরে একটি নদী হালদা। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য চারদিকে। কাশ ফুলে ছেয়ে গেছে নদীর দু-কূল। শরতের নীল আকাশে মেঘের ভেলা। ধানের ক্ষেতে রোদ্রÑছায়ার লুকোচুরি। কবি গুরুর গানের আবেশ দোলা দিচ্ছে প্রকৃতি ও মানব হৃদয়ে। যেন এক উৎসবের দিন। এ যেন নবান্ন এমনি আমেজ চারদিকে। হালদা পাড়ের গ্রামের মানুষ বাদ্যবাজিয়ে জড়ো হয়েছে মার্দাশা গ্রামের রামদাশ মুন্সির হাট নামক স্থানে। চারদিকে উৎসবের আবহ। সাজ সাজ রব। দূর-দূরান্ত হতে গ্রামের মানুষ মিছিল নিয়ে উল্লাস করে জড়ো হচ্ছেন জমায়েতের স্থানটিতে। তাদের অধিকাংশের হাতেই কোদাল-শাবল। সুরে সুরে সেøাগান দেওয়ার শব্দ ভেসে আসছিল আশপাশের গ্রামে। রাউজান, হাটহাজারী ও ফটিকছড়ির তিন উপজেলার ৩৫ হাজার মানুষের এ সমাবেশ। তাই উৎসবের আমেজটাও ছিল চোখে পড়ার মতো। তবে ফাঁড়ি বা টেক কাটার উদ্যোগ যারা নিয়েছেন তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাও কম নয়। কারণ এই ফাঁড়ি কাটা নিয়ে চট্টগ্রাম জেলার ভূমি অফিস, ফিশারি ডিপার্টমেন্ট, কৃষি অফিস ও হাটহাজারী থানা সবখান থেকেই ছিল প্রবল আপত্তি। রামদাশ মুন্সির হাটে কর্তৃপক্ষ ১৪৪ ধারা জারি করে। যে কোন মূল্যে প্রশাসন এ ফাঁড়ি কাটা প্রতিহত করতে চায়। পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার এ নিয়ে তাদের আয়োজনও সম্পন্ন করেছে। প্রস্তুত রেখেছে পর্যাপ্ত পুলিশ বাহিনী ও বুলেট। তবে জনগণ অনড়। তারা পুলিশের উপস্থিতিতেই ঘোষণা করলেন নিজেদের দৃঢ় সংকল্পের কথা। পুলিশের বুলেটকে তারা ভয় পায় না। প্রয়োজনে বুক পেতে দেবে তবুও নিজেদের দুঃখ কষ্ট নিজেরাই লাঘব করবে। কারণ, সরকার ও প্রশাসনকে বিষয়টি অবহিত করা হলেও তারা সমস্যার নিষ্পত্তি না করে বরং মানুষের চরম কষ্টকে উপেক্ষা করেছে দিনের পরদিন । প্রশাসন কিংবা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ব্যর্থ হয়েছে সমাবেত ৩৫ হাজার সাধারণ মানুষের সঙ্গে মধ্যস্থতা কিংবা আপোষ রফা করতে। বরং পেশি শক্তি ও বন্দুকের ভয় দেখিয়ে হাজার হাজার জনগণকে প্রতিহত করতে উদ্যত হয়েছে তারা। জনগণও ছিল ক্ষুব্ধ। তারা পুলিশের চোখ রাঙ্গানো উপেক্ষা করেই খাল কাটার প্রস্তুতি শুরু করে। মারমুখী অবস্থান নেয় পুলিশ। জনগণের ইচ্ছাকে দমিয়ে রাখতে প্রশাসন নির্বিচারে গুলি করার আদেশ দেয়। শরতের নীল আবহে মাটি রক্তের লালে রঞ্জিত হয়। সরকারী এক হিসেবে জানা যায় পুলিশ সেদিন নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর ৪৪ রাউন্ড গুলি ছুড়েছিল। যার দরুন ঝরে পড়ে অসংখ্য তাজা প্রাণ। সরকারী হিসাবে ১০ জন কিন্তু বেসরকারী হিসেবে ছিল ৩৮ জন। আহত মানুষের সংখ্যা ছিল শতাধিক। সরকারী এক অনুসন্ধান প্রতিবেদনে নিহত মানুষের মধ্যে ছিলেন ডাক্তার আবুল খায়ের, যিনি ছিলেন মার্দাশা ইউনিয়ন বোর্ডের মেম্বার ও মার্দাশা উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারি। নিহতের তালিকায় আরও ছিলেন তৎকালীন মুসলিম লীগের সক্রিয় কর্মী আবদুল জব্বার বলিসহ অগনিত নাম না জানা কৃষক, জেলে, ছাত্র ও যুবক। সেদিন হালদা পাড়ের মানুষ পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেননি। বরং জনরোষের শক্তি প্রদর্শন করেছেন এবং আমলা নির্ভর জনবিচ্ছিন্ন শাসনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুল প্রদর্শন করেছিলেন। পাকিস্তান নামক ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র সৃষ্টির মাত্র তের মাস পর এমন অযাচিত ঘটনা। যা পাকিস্তান রাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম ‘গণহত্যা’ হিসেবে বিবেচিত। তবে জাতিসংঘের ‘গণহত্যার’ যে সংজ্ঞা তার সঙ্গে এ ঘটনা কিছুটা সাংঘর্ষিক। চট্টগ্রাম নিয়ে বিভিন্ন দলিল ও ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে হালদার নির্বিচারে কৃষক হত্যার ঘটনাকে অনেক বই, দলিল ও নথিতে গণহত্যা হিসেবে উল্লেখ্য করা হয়েছে। চট্টগ্রামের স্থানীয় পত্রিকা আজাদী ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ শিরোনামে যে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে সেই বইয়ে এ ঘটনাকে পাকিস্তানের ‘প্রথম গণহত্যা’ হিসেবে বর্ণনা করে। সে বইয়ে উল্লেখ করা হয় হালদার রামদাশ মুন্সির হাটে নির্বিচারে মানুষ হত্যার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম শহর জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। কিন্তু জনগণ সেই বাধাও মানতে অপরাগতা জানায়। হত্যার প্রতিবাদে শহর জুড়ে বিশাল মিছিল বেরোয়। যেখানে মুসলিম লীগের অসংখ্য কর্মীও অংশগ্রহণ করে। ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করায় স্থানীয় ‘দৈনিক পূর্ব পাকিস্তান’ সম্পাদক ও প্রকাশক আবদুস সালামকে অর্থদ- ভোগ করতে হয়। পুলিশী হয়রানির কারণে মার্দাশা গ্রামের পুরুষদের ঘর ছাড়তে বাধ্য করা হয়। ১৪৪ ধারা জারি থাকলেও হাজার হাজার মানুষ চট্টগ্রাম শহরের আন্দরকিল্লায় অবস্থিত জেনারেল হাসপাতালে ডাক্তার আবুল খায়েরসহ অন্যান্য মৃতদেহ ও আহত মানুষদের দেখতে যান। অন্যদিকে চট্টগ্রাম শহর জুড়ে চলে তীব্র প্রতিবাদ। এ ঘটনার বিস্তারিত তথ্য জানতে বছর কুড়ি আগে আমি (কামরুল) ব্যক্তিগতভাবে দুজন প্রবীণের সঙ্গে আলাপ করে এ হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। তাদের একজন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী, আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক পুলিন দে। অন্যজন ফতেয়াবাদ কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন। দু’জনই আজ গত। প্রয়াত অধ্যাপক পুলিন দে আমাকে জানান, সেই ঘটনায় নিহত মানুষের সংখ্যা ৩৮। তিনি নিজে আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের মর্গে তাদের লাশ দেখতে যান এবং এ ঘটনায় গভীর দুঃখ প্রকাশ করেন। ফতেয়াবাদ কলেজের সাবেক প্রিন্সিপাল মরহুম ফরিদ ছিলেন তখন বয়সে কিশোর। তিনি তখন ফতেয়াবাদ বিদ্যালয়ের মাধ্যমিকের ছাত্র। হালদা হত্যাকা-ের প্রতিবাদে ফতেয়াবাদ স্কুলের ছাত্ররা স্কুল ধর্মঘটের ডাক দেয় এবং মিছিলসহকারে চট্টগ্রামের ডিসি অফিস ঘেরাও করে।ছাত্ররা ডিসির অপসারণ ও বিচার দাবি করে। সেই মিছিল ও ধর্মঘটে অধ্যাপক ফরিদ নিজেও অংশ নিয়েছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন ও বামপন্থী ছাত্র রাজনীতির জন্য ফতেয়াবাদ স্কুলের তখন বেশ নাম-ডাক। পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরুতে ছাত্রদের এমন স্কুল ধর্মঘট ছিল নজীরবিহীন ঘটনা। পাকিস্তান জন্মের পর স্কুল ধর্মঘটের ঘটনা এটাই ছিল প্রথম। এ ছাড়া কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইত্তেহাদ পত্রিকার ৩রা অক্টোবর ১৯৪৮ সালে এ ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। শিরোনামটি ছিল চড়ষরপব ঙঢ়বহবফ ঋরৎব ঁঢ়ড়হ ঃযরৎঃু ঋরাব ঃযড়ঁংধহফ চবড়ঢ়ষব রহ ঃযব গধফধৎংযধ ঠরষষধমব. বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে মার্দাশার এই ঘটনার প্রভাব পড়েছিল। মুসলিম লীগ শ্রমিক জনতার এক সমাবেশ ২৩ জুন ১৯৪৯ সালে মওলানা ভাসানী পাকিস্তান সরকারকে মার্দাশা ঘটনা নিয়ে তীব্র নিন্দা জানায়। ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮ সালের পাকিস্তান সরকারের বেতনভুক কর্মচারী সাব-ডিভিশনাল অফিসার রিপোর্টে বলেন, মানুষের মতামত ছিল সরকারী বিভিন্ন সংস্থার অভিমতের বিপরীত। রিপোর্ট পাওয়ার পর জেলা কমিশনার তার রিপোর্টে পাকিস্তানের চীফ সেক্রেটারিকে ১৯৫৫ সালের রিপোর্টে বলেন (ঈড়সসরংংরড়হবৎং জবঢ়ড়ৎঃ ঃড় ঃযব ঈযবরভ ঝবপৎবঃধৎু, ঐড়সব চড়ষরপবং ই-চৎড়মং, ঔধহঁধৎু ১৯৫৫, ঘড়ং. ১৩৭৬-১৩৭৬) জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পুরো ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলা করেছেন। দায়িত্ব অবহেলার কথা স্বীকার করলেও কমিশনার জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। কালের গর্ভে হারিয়ে যায় সে ঘটনা ও সময়ের আবর্তনে প্রশমিত হয় সেই বেদনা। হালদা নদীর ঘটনায় উপলব্ধি করা যায়, সরকার যখন সাধারণ মানুষের মতামত অগ্রাহ্য করে, সরকারী কর্মচারী যখন জনদুর্ভোগকে এড়িয়ে যায়, তখন মানুষ নিজেরাই নিজেদের ভাগ্য গড়ার উদ্যোগ নেয়। ডাক্তার আবুল খায়ের চৌধুরী, মুসলীম লীগের সক্রিয় কর্মী আবদুল জব্বার বলি আঞ্চলিক রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও তাদের নিহত হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয় পাকিস্তান আমলে আঞ্চলিক স্বশাসন ব্যবস্থা বাস্তবিক কাজ করত না। বরং পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরু থেকেই পুলিশী শাসন ও দমন-নিপীড়ন ছিল তাদের কর্তৃত্ব টিকিয়ে রাখার উপায়।
×