ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

জুবায়ের বারি

বিদ্যুতহীন সড়কেও জ্বলবে আলো!

প্রকাশিত: ০৬:৫৫, ২১ জুলাই ২০১৭

বিদ্যুতহীন সড়কেও জ্বলবে আলো!

নেদারল্যান্ডসের আফসলাউডাইক যাবার পথে প্রথমে কয়েকটা ঝাপসা আলো চোখে পড়ে। এই ডাইক বা প্রাচীরের উপরে ৩২ কিলোমিটার হাইওয়ে রয়েছে। বাঁ দিকে উত্তর সাগর, ডানদিকে আইসেলমেয়ার। হাইওয়ের বেশিরভাগ অংশ অন্ধকারে ঢাকা, কারণে এখানে আর বিদ্যুত সংযোগ নেই। ডান রোসেখাডের্, তিনি ইঞ্জিনিয়ার নন, শিল্পী। ডাইকের ওপর আলো আনতে চলেছেন। তবে এর আগে আলো নিয়ে নানা চোখ-ধাঁধানো কাজ করে বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন তিনি। যেমন পদ্মফুল নামের এক সৃষ্টি, যা শরীরের উত্তাপ পেলে খুলে যায়। আফসলাউডাইক তাঁর কাছে বড় চ্যালেঞ্জÑ সেইসঙ্গে অভিনব সুযোগও বটে। তিনি বলেন, ‘নেদারল্যান্ডসে ডাইক ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণত ছোঁয়ার উপায় নেই, কিছু করার উপায় নেই। কিন্তু ডাচ মন্ত্রণালয়ের উচ্চাকাক্সক্ষা দেখার মতো। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব হাইওয়ে জ্বালানিমুক্ত করার এক প্রকল্প শুরু করেছে তারা। বেশি প্রযুক্তি ব্যবহার না করে আলো ও ইন্টারএ্যাক্টিভিটির স্তর যোগ করাই আমাদের ‘কনসেপ্ট’। এখানকার চরম আবহাওয়ার পরিস্থিতিতে প্রযুক্তি দুই-এক বছরের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাবে।’ আবহাওয়া ও সমুদ্রপৃষ্ঠের বেড়ে চলা উচ্চতার কারণে প্রায় ১০০ বছর পুরানো ডাইক বেশ চাপের মুখে পড়েছে। এবার তার সংস্কার করা হচ্ছে। ফলে সেখানে অভিনব কিছু করার সুযোগ এসেছে। পথের ধারে ৬০টি লকগেট রয়েছে। সিমেন্টের তৈরি দৈত্যাকার ওই কাঠামোকে দ্রষ্টব্য করে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে। তার আলোকসজ্জাও দেখার মতো। অথচ ভবিষ্যতে কিন্তু বিদ্যুত সংযোগও থাকবে না। রাস্তা আলোকিত করার অভিনব উদ্যোগ দীর্ঘ হাইওয়েতে আলো বসানোর ব্যয় যেমন কম নয়, সেই আলো গাড়িচালকদের চোখ ধাঁধিয়ে দিতে পারে। পরিবেশের জন্যও তা ক্ষতিকর। কিন্তু রোসেখার্ডে এর আগে তাঁর উদ্ভাবনশীল আলোর মাধ্যমে সাইকেলের এক পথকে বিশ্ববিখ্যাত করে তুলেছেন। নেদারল্যান্ডসের ন্যুনে শহরে সেই আলো বিখ্যাত শিল্পী ভিনসেন্ট ফান গগ-এর ‘স্টারি নাইটস’ ছবির কথা মনে করিয়ে দেয়। হাজার হাজার ছোট পাথর সারাদিন সৌরশক্তি শুষে নেয়। রাতে সেগুলো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। রোসেখার্ডে বলেন, ‘গ্লো-ইন-দ্য-ডার্ক ২৫-৩০ বছর ধরে রয়েছে। কিন্তু পুরনো উপকরণে বিষাক্ত রেডিয়াম থাকায় সেটি বেশ বিপজ্জনক, একেবারেই ভাল নয়। প্রকাশ্যে মানুষের আওতায় এমন জিনিস রাখা ঠিক নয়। তাছাড়া মাত্র ৩০-৪০ মিনিট উজ্জ্বল থাকে।’ এর মধ্যে সাইকেলের পথে রাখা উজ্জ্বল পাথরকে অনেক উন্নত করে তোলা হয়েছে। এখন তাতে কোন বিষাক্ত পদার্থ নেই। তবে সারারাত উজ্জ্বল রাখতে হলে সৌরশক্তি চালিত এলইডির সাহায্য লাগে। বিশেষ করে শীতকালে পাথর চার্জ করতে যথেষ্ট সূর্যের আলো পাওয়া যায় না। অর্থাৎ ডাইকের ওপর পথ আলোকিত করতে এই প্রযুক্তি মোটেই উপযুক্ত নয়। সেখানে প্রয়োজন অন্য সমাধানসূত্র। বিশেষ রং সেই সমাধান এনে দিল। গাড়ির হেডলাইটের আলো পড়লে তার প্রতিফলনের মাধ্যমে রাস্তা আলোকিত হয়ে ওঠে। বিশেষ রঙের হাজার হাজার ছোট মুক্তো আলোর প্রতিফলন ঘটাবে এবং রাস্তার পিচকে আলোরমালায় রূপান্তরিত করবেÑ এর জন্য বিদ্যুতেরও প্রয়োজন নেই। ডান রোসেখার্ডে বলেন, ‘সবাই সবসময় শুধু নতুন মডেলের গাড়ি নিয়ে ব্যস্ত। কোন কারণে রাস্তা, মানে অবকাঠামোকে উপেক্ষা করা হয়। সস্তায় রাস্তা বানালেই চলে। বিষয়টা সত্যি অদ্ভুত, কারণ গাড়ি চালানোর সময় তো রাস্তাই দেখতে হয়। তাছাড়া রাস্তাই তো আরও বেশি করে নৈস্বর্গ স্থির করছে। আগামী প্রজন্মের জন্য এটাই তো রেখে যাব।’ লক গেট থেকে আফসলাউডাইক পর্যন্ত দীর্ঘপথের জন্যও রোসেখার্ডে ও তাঁর টিমকে সমাধানসূত্র খুঁজতে হবে। চালকদের আর ঘন অন্ধকারের মধ্যে গাড়ি চালাতে হবে না। উজ্জ্বল লাইন তাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। ধারের বেড়ার রং-ও প্রতিফলন ঘটাবে। একমাত্র চালক সেই প্রতিফলন দেখতে পারবেন। কারণ, বিশেষ এক এ্যাঙ্গেলে হেডলাইটের আলোর প্রতিফলন ঘটানো হয়। এর পোশাকি নাম ‘রেট্রোরিফ্লেকটিভ’। ফলে উলটো দিকের গাড়ির চালকের চোখ ধাঁধিয়ে যায় না। শুধু যার প্রয়োজন, সেই আলো দেখতে পায়। এছাড়া রাতের অন্ধকার বজায় থাকে। ডান রোসেখার্ডে বলেন, ‘এত বেশি আলোর দূষণ ঘটে, অথচ আমরা এ বিষয়ে কিছুই করছি না। তাই এখানে আমরা প্রতিফলিত আলো ব্যবহার করছি। আলোর অপচয়কে আমরা প্রতিফলনে পরিণত করছি।’ বড় পরিকল্পনা বটে। সেই সঙ্গে পথের ধারের বেড়ায় ছোট যন্ত্রাংশ কাজে লাগানোর উদ্যোগ। তবে এখনও আলোর আদর্শ তীব্রতা অর্জন করা যায়নি। ডান রোসেখার্ডে বলেন, ‘শুরুতে অনেকে বলেছিলেন, তুমি এমন করবে, এটা তো নিষিদ্ধ। তুমি নিশ্চিত, এটা সম্ভব? তবে আমি নিশ্চিত, যে একবার করে ফেললে মানুষ বলবেÑ দারুণ আইডিয়া, সব জায়গায় এখনও করোনি কেন? উদ্ভাবনের সময় এই সব অকৃতজ্ঞ পর্যায়ের মুখোমুখি হতে হয়। এটা কাজেরই অংশ।’ রোসেখার্ডের ইনস্টলেশন আশপাশের পরিবেশের নানা স্টিমুলাস বা উদ্দীপকে সাড়া দেয়। নড়াচড়া বা শব্দ কয়েক’শ সেন্সরে ধরা পড়ে এবং তার ফলে ‘ডিউন’ উজ্জ্বল হয়ে যায়। রোসেখার্ডে-র কাছে শুধু সৌন্দর্যের খাতিরে সৌন্দর্য গ্রহণযোগ্য নয়। এ এমন প্রযুক্তিগত মানদণ্ড, যা শুধু ইঞ্জিনিয়ারদের হাতে তৈরি হয়নি। শিল্পীরাও তাতে শামিল হয়েছেন। এভাবে মানুষের হাতে নিসর্গ তৈরি হচ্ছে, যা একই সঙ্গে প্রয়োজনীয় এবং সুন্দর। সূত্র : ডয়েচ ভেলে, বিবিসি
×