ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

হলি আর্টিজানে হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডগুলো মাহফুজের বানানো

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ২১ জুলাই ২০১৭

হলি আর্টিজানে হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডগুলো মাহফুজের বানানো

শংকর কুমার দে ॥ এক হাতেই গ্রেনেড-বোমা তৈরিতে খুবই দক্ষ জঙ্গী সংগঠন জেএমবি ও নব্য জেএমবির জঙ্গী হাতকাটা সোহেল মাহফুজ। শুধু তাই নয়, এক হাতেই আগ্নেয়াস্ত্র চালানায় পারদর্শী সে। এরপর জঙ্গীদের গ্রেনেড-বোমা ও আগ্নেয়াস্ত্র চালানার প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করেছে। দুই দুর্ধর্ষ ও ভয়ঙ্কর জঙ্গীর জবানবন্দীতে উঠে এসেছে হাতকাটা সোহেল মাহফুজকে জেএমবির জঙ্গী থেকে নব্য জেএমবির পথে কারা, কিভাবে এনেছে, জঙ্গী তৎপরতার অজানা কাহিনী; তারপর কিভাবে গ্রেফতার হয়েছে, গ্রেফতারের পর কি বলছেন তার নেপথ্য কাহিনী বের হয়ে এসেছে তদন্তে। বাংলাদেশ ও ভারত-দুই দেশেরই মোস্টওয়ান্টেড জঙ্গী সোহেল মাহফুজ। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পরিকল্পনাকারী ও অস্ত্র-বোমার যোগানদাতা এই দুর্ধর্ষ জঙ্গী এখন রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাধীন। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্রে এ খবর জানা গেছে। জিজ্ঞাসাবাদে হাতকাটা মাহফুজ তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জানিয়েছে, ২০০৫ সালে নওগাঁর আত্রাই এলাকায় বাংলাভাইয়ের সঙ্গে বোমা বানাতে গিয়ে এক হাত উড়ে গিয়েছিল তার। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডগুলো তৈরি করে সে। জঙ্গীরা গ্রেনেডগুলো ছুড়েই দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা, পুলিশ কর্মকর্তা-সদস্যদের আহত ও ভয়ঙ্কর আতঙ্ক সৃষ্টি করে জঙ্গী হামলার ঘটনার সময়। সোহেল মাহফুজ স্বল্পশিক্ষিত। কিন্তু গ্রেনেড-বোমা তৈরি ও অস্ত্র পরিচালানায় যে ধরনের দক্ষ তাতেই মনে হয় সে একজন ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ প্রকৃতির জঙ্গী। এ কারণে জঙ্গী সংগঠনেও তার আলাদা করে গুরুত্ব দেয়া হতো। জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার পর সে বগুড়া ও রাজশাহী এলাকায় বোমা তৈরির প্রশিক্ষণ নেয়। পরবর্তী সময় নিজেই প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করে। ২০০৯ সালের ১৪ মে ঢাকার কাফরুল এলাকা থেকে গ্রেফতার হওয়ার পর পুরনো জেএমবির আরেক বোমা বিশেষজ্ঞ জাহিদুল ইসলাম সুমন ওরফে বোমা মিজান র‌্যাবের কাছে যে স্বীকারোক্তি দিয়েছে, সেই নথির তথ্য অনুযায়ী, সোহেল মাহফুজ তার (বোমা মিজান) সমপর্যায়ের বোমা তৈরিতে পারদর্শী। ওই সময় মোল্লা ওমর, ওসমানসহ কয়েকজন জঙ্গীদের বোমা তৈরিতে প্রশিক্ষণ দেয়। এরমধ্যে সোহেল মাহফুজ অন্তত ১০ জনকে বোমা তৈরিতে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের এক কর্মকর্তা বলেন, সোহেল মাহফুজ জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, তার ডান হাত উড়ে যাওয়ার পরও সোহেল মাহফুজ বাম হাত দিয়েই বোমা তৈরি করতে পারত। তার সঙ্গে সংগঠনের কেউ একজন সহযোগিতা করত। ভারত থেকে অস্ত্র ও বিস্ফোরক আনার রুটটি সম্পর্কে তার জানাশোনা ছিল। এ কারণে তার তত্ত্বাবধানেই গুলাশান হলি আর্টিজান বেকারিতে ব্যবহৃত অস্ত্র-গ্রেনেড আনা হয়। সোহেল মাহফুজ অল্প বয়সেই জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে থাকার পর গ্রেফতার হয় এই শীর্ষ জঙ্গী। তার গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর শিলাইদহ এলাকার সাদিপুর কাবলিপাড়া এলাকায়। তার বাবার নাম রেজাউল করিম শেখ। মায়ের নাম মনোয়ারা বেগম। পাবনা জেলা স্কুলে দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে সে। ২০০২ সালে এক চাচাত ভাইয়ের মাধ্যমে জেএমবিতে যোগ দেয়। পড়াশোনা বাদ দিয়ে সে চলে যায় রাজশাহী। সেখানে সে বেশ কয়েক বছর জেএমবির শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের সঙ্গে থাকে। ২০০৪ বা ২০০৫ সালে বাংলা ভাইয়ের হয়ে এক আস্তানায় বোমা বানাতে গিয়ে ডান হাত উড়ে যায় তার। হাত উড়ে যাওয়ার পর সে রাজশাহী থেকে বাড়িতে চলে যায়। বাড়িতে কিছুদিন অবস্থান করার পর আবার চলে যায় সংগঠনের কাজে। ২০০৬ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় সংগঠনের এক দ্বীনই ভাইয়ের মেয়েকে বিয়ে করে। এর বছরখানেক পর দিনাজপুরের ঘোড়াঘাটে দ্বিতীয় বিয়ে করে। বর্তমানে সে সাত সন্তানের জনক। দুর্ধর্ষ জঙ্গী হাতকাটা সোহেল মাহফুজের দুই স্ত্রী নিজ নিজ বাবার বাড়িতে অবস্থান করছে বলে জানা গেছে। পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজমের এক কর্মকর্তা বলেন, সোহেল মাহফুজ জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, ২০০৬ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ইউসুফ নামে এক জঙ্গী বগুড়ায় এসে পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে। এ সময় ইউসুফ পশ্চিমবঙ্গে কাজ করার জন্য একজনকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। ওই সময় সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত ও ধরপাকড় চলায় সোহেল মাহফুজ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। সেখানে সে ইন্ডিয়ান মুজাহিদীন নামে জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সাংগঠনিক কার্যক্রম শুরু করে। তবে ২০০৮ সালে দেশে ঢাকাতেই অবস্থান করছিল। বোমা মিজান র‌্যাবকে দেয়া স্বীকারোক্তিতে বলেছে, ২০০৮ সালের মে মাসে বাংলাদেশে আসে সে। জেএমবির আমির শায়খ সাইদুর রহমানের নির্দেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তপথ ধরে বাংলাদেশে আসে বোমা মিজান। তারপর সেখানকার সেলিমের তত্ত্বাবধানে চাঁপাইনবাবগঞ্জে একদিন থেকে ঢাকায় এসে মাহফুজের বাসায় ওঠে বোমা মিজান। তারপর মাহফুজ সস্ত্রীক তাকে ডেমরার কোনাপাড়ার আসাদ ওরফে টিটুর ভাড়া বাসায় ওঠায়। সে তখন জেএমবির ঢাকা বিভাগের দায়িত্বে ছিল। বোমা মিজান জিজ্ঞাসাবাদে হাতকাটা সোহেল মাহফুজ সম্পর্কে বলেছে, ২০০৮ সালের আগস্টে ঢাকার অজ্ঞাতস্থানে জেএমবির বর্তমান (তৎকালীন) আমির শায়খ মাওলানা সাইদুর রহমানের উপস্থিতিতে মিটিং হয়। মিটিংয়ে শাহবাগ এলাকা হতে শাহেদ ট্যাক্সিযোগে এক ঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে ওই স্থানে অবস্থান নেয়। আমিসহ রাসেল, সায়েম, সোহেল মাহফুজ, শাহেদ মিটিংয়ে উপস্থিত থেকে তাদের নির্দেশনা শুনি ও অবস্থান করি। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় থাকত সোহেল মাহফুজ। এ সময় তার দুই স্ত্রীও সঙ্গে ছিল। পুরনো কাপড় ব্যবসার আড়ালে সে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাত। জেএমবির তৎকালীন আমির মাওলানা সাইদুর গ্রেফতার হওয়ার পর জেএমবির ইন্ডিয়ান শাখার আমির হিসেবে মনোনীত হয় এই সোহেল মাহফুজ। ২০১৪ সালের ২ অক্টোবর বর্ধমানের খাগড়াগড়ে বোমা বিস্ফোরণের পর ভারতীয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাহফুজকে মোস্ট ওয়ান্টেড হিসেবে খুঁজতে থাকে। তাকে গ্রেফতারের জন্য ১০ লাখ রুপী পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। ওই বছরের নবেম্বর বা ডিসেম্বর মাসে সে পালিয়ে আবার বাংলাদেশে আসে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে দেশে ফেরার পর সোহেল মাহফুজ পুরনো জেএমবি থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত আমির হিসেবে সালাউদ্দিন ওরফে সালেহীন তার সঙ্গে জহিরুল নামে একজনের মাধ্যমে যোগাযোগ করত। জহিরুল তাকে মাসিক খরচ হিসেবে ৪/৫ হাজার টাকা দিত। ওই টাকা দেয়া বন্ধ হয়ে গেলে বিপাকে পড়ে যায় মাহফুজ। পরবর্তী সময়ে রবিন নামে পূর্ব পরিচিত এক সঙ্গীর মাধ্যমে নব্য জেএমবির দাওয়াত পায় সে। রবিন তাকে একটি মেমোরি কার্ডের মাধ্যমে নব্য জেএমবির কর্মপদ্ধতি ও আনুষঙ্গিক বিষয় মাহফুজকে দেয়। মাহফুজ তাতে দেখে ‘খিলাফত শুরু হয়েছে’ মনে করে নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়। ২০১৫ সালের কোন এক সময় সে নব্য জেএমবির কাছে বায়াত গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে নিও জেএমবির দুই সদস্য রজব ও জনির মাধ্যমে শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। উত্তরাঞ্চলে নব্য জেএমবির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকও হয়। এছাড়া ২০১৬ সালের রমজানের শুরুতে রজবের সঙ্গে ঢাকায় আসে মাহফুজ। ঢাকায় ফরিদুল ইসলাম আকাশ তার সঙ্গে দেখা করে মিরপুরের শেওড়াপাড়ার আস্তানায় নিয়ে যায়। ওই আস্তানাতে তামিম চৌধুরী (নিহত), বাশারুজ্জামান চকলেট, নূরুল ইসলাম মারজানের (নিহত) সঙ্গে অবস্থান করে। সেখানেই সে গুলশান হামলায় ব্যবহৃত গ্রেনেডগুলো তৈরিতে সহযোগিতা করে। নব্য জেএমবি গঠনের পর নব্য জেএমবির সদস্যদের সঙ্গে তার যোগাযোগ হয়। পরে মাহফুজ নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়। সে দীর্ঘদিন জেএমবির সঙ্গে জড়িত থাকায় তাকে মজলিসে শূরার সদস্য করা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) আছাদুজ্জামান মিয়া বুধবার বলেছেন, নব্য জেএমবির অন্যতম শীর্ষ নেতা সোহেল মাহফুজ জিজ্ঞাসাবাদে গুলশান হামলায় প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে অনেক তথ্য দিয়েছে। শীঘ্রই গুলশান জঙ্গী হামলায় তারা আদালতে এ মামলার অভিযোগপত্র দেবেন। হাতকাটা সোহেল মাহফুজের দেয়া তথ্যানুযায়ী দুনিয়া কাঁপানো গুলশান জঙ্গী হামলার চার্জশীট দেয়া সম্ভব হওয়ার ঘটনাতেই বোঝা যায়, কত বড় মাপের জঙ্গী হাতকাটা সোহেল মাহফুজ।
×