ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

চট্টগ্রাম বন্দর-কাস্টমস সমন্বয়হীনতা ॥ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ২১ জুলাই ২০১৭

চট্টগ্রাম বন্দর-কাস্টমস সমন্বয়হীনতা ॥ দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা

হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টমসের সমন্বয়হীনতা, পলিসিগত দুর্বলতা এবং বেসরকারী অফডকগুলোর অদক্ষতায় প্রতিবছরই দেশের বাইরে চলে যায় বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। জাহাজের ওয়েটিং টাইম বেড়ে যাওয়ার ডেমারেজ, ইয়ার্ডে অতিরিক্ত সময় কন্টেনার পড়ে থাকার চার্জ এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পণ্য খালাস নিতে না পারার কারণে দ-ভাড়া ও নানা খাতে বাড়তি ব্যয়ের খাতগুলো প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে দিচ্ছে জাহাজ ভাড়া, যা পরিশোধ করতে হয় বৈদেশিক মুদ্রায়। এর ফলে শুধু আমদানিকারক তথা ব্যবসায়ীরাই নন, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি। আর অতিরিক্ত ব্যয় শেষ পর্যন্ত গিয়ে চাপে ভোক্তা সাধারণের ওপর। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে কিছুক্ষেত্রে পণ্য খালাস প্রক্রিয়া সহজীকরণের দাবি দীর্ঘদিনের। দফায় দফায় বৈঠকে সুপারিশ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের আশ্বাসে কাটছে বছরের পর বছর। কিন্তু উল্লেখ করবার মতো সুফল নেই বলে অভিযোগ আমদানিকারকদের। বিশেষ করে সামগ্রিক প্রক্রিয়ায় অভিযোগের তীর অফডকগুলোর দিকে, যারা প্রয়োজনীয় সার্ভিস দিয়ে সহযোগিতা করতে পারছে না। সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিদেশ থেকে আসা এফসিএল (ফুললোড) কন্টেনারগুলোর মধ্যে ৩৭ ধরনের পণ্য সরাসরি চলে যাবে অফডকে। বন্দর ইয়ার্ডে চাপ কমাতে নেয়া হয় এ সিদ্ধান্ত। কিন্তু বেসরকারী কন্টেনার ডিপোগুলো দক্ষতার সঙ্গে কাজটি করতে পারছে নাÑএমন অভিমত খোদ বন্দর কর্তৃপক্ষের। বেশিরভাগ আইসিডিরই প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্রেইলর নেই। ফলে আমদানির কন্টেনার পড়ে থাকছে বন্দর ইয়ার্ডে। আর সেখানে নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত সময়ের জন্য দৈনিক হিসাবে ভাড়া গুনতে হয়। এরপর আরও বেশি দিন থাকলে কখনও বা আরোপিত হয় দ্বিগুণ বা তিনগুণ হারে দ-ভাড়া। জাহাজের ওয়েটিং টাইম বাড়লে গুনতে হয় ডেমারেজ, যা শিপিং কোম্পানিগুলোকে পরিশোধ করতে হয়। কন্টেনার ভেসেল এবং ভাল্ক কার্গো আমদানির ভেসেলগুলোকে যে পরিমাণ মাশুল গুনতে হয় তা বছরে অন্তত অর্ধশত কোটি ডলার, এমনই ধারণা দিচ্ছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এবং শিপিং কোম্পানিগুলো। বাড়তি এ ব্যয় প্রভাবিত করছে দেশের অর্থনীতিতে। তাছাড়া আমদানি ব্যয় বাড়লে বাজারে দ্রব্যমূল্য বাড়ে, যা গিয়ে চাপে ভোক্তাদের ঘাড়ে। চট্টগ্রাম বন্দর ইয়ার্ডে কন্টেনারের স্তূপ জমে যাওয়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম অফডকগুলোর কাছ থেকে ঠিকমতো সার্ভিস না পাওয়া। গড়ে প্রায় ৫ হাজার কন্টেনার ইয়ার্ডে পড়ে থাকে, যেগুলো সরাসরি অফডকে চলে যাওয়ার কথা। কিন্তু বেসরকারী আইসিডিগুলো প্রয়োজনীয় ট্রেইলর এবং যন্ত্রপাতিতে সমৃদ্ধ না হওয়ায় সেই সেবা প্রদানে অক্ষম। বার বার তাগিদ দেয়া সত্ত্বেও তারা ট্রেইলর সংগ্রহ করছেন না বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, অফডকে যাওয়ার ৩৭ ধরনের পণ্যবাহী কন্টেনারের মধ্যে শতকরা ৬০ ভাগই স্ক্র্যাপ, যা স্টীল রি-রোলিং মিলগুলোর কাঁচামাল। আমদানিকারক এ প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্যাপ্ত সংখ্যক নিজস্ব ট্রেইলর রয়েছে। কিন্তু অফডক থেকে ডেলিভারি নেয়ার বাধ্যবাধকতা থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো বন্দর ইয়ার্ড থেকে সরাসরি পণ্য গ্রহণ করতে পারছে না। অথচ, সরাসরি কন্টেনার ডেলিভারি নিতে পারলে ইয়ার্ডে কন্টেনারের চাপ, সময় এবং অর্থ ব্যয় সবদিকেই সাশ্রয় হতো। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে গত ২২ জুন একটি সিদ্ধান্তও হয় বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স এ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি, সিএন্ডএফ এজেন্টস এ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ ইনল্যান্ড কন্টেনার ডিপো এ্যাসোসিয়েশন (বিগডা) প্রতিনিধিদের সভায়। এতে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয় যে, স্ক্র্যাপ পণ্যবাহী এফসিএল কন্টেনারগুলোর অফডকে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এগুলো সরাসরি বন্দর হতে খালাস গ্রহণ করা যাবে। এ মর্মে চট্টগ্রাম কাস্টমসের এডিশনাল কমিশনার খালেদ মোহাম্মদ আবু হোসেন স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তিও জারি হয়। কিন্তু দু’সপ্তাহ না যেতেই নতুন সিদ্ধান্ত হয়। বন্দর ব্যবহারকারী এবং কাস্টমসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর সঙ্গে অনুষ্ঠিত আরেক বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, ‘অফডকগামী আমদানিকারকরা ৩৭টি পণ্য বন্দর হতে সরাসরি খালাস গ্রহণ করতে পারবেন। তবে এ সুযোগ ৪ জুলাই হতে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।’ এর অর্থ দাঁড়ায় পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত রহিত হয়ে গেছে পরবর্তী সভার সিদ্ধান্তে। এ সিদ্ধান্তে হতাশা এবং অসন্তোষ ইস্পাত শিল্প সেক্টরে। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার এএফএম আবদুল্লাহ খান এ প্রসঙ্গে জনকণ্ঠকে বলেন, অবস্থার প্রেক্ষিতে বিশেষ করে সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে যে কন্টেনারজট সৃষ্টি হয়েছে তা কমাতে সাময়িকভাবে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। তবে কাস্টমস কমিশনার তা বললেও পূর্ববর্তী সভার সিদ্ধান্তে এ ধরনের কোন মেয়াদের উল্লেখ ছিল না। কাস্টমস কমিশনার বলেন, যেহেতু ৩৭ ধরনের পণ্য অফডকে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সরকারের সেহেতু তা বহাল থাকবে। গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের পর বন্দর ইয়ার্ড থেকে সরাসরি স্ক্র্যাপ ডেলিভারি নেয়া যাবে না। আমদানি করা অফডকের পণ্য সরাসরি অফডকেই চলে যাবে। সেখান থেকেই আমদানিকারকদের ডেলিভারি নিতে হবে। বেসরকারী আইসিডিগুলোর অদক্ষতা এবং প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্রেইলর না থাকা প্রসঙ্গে কাস্টমস কমিশনার জানান, এর জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষের টার্মিনাল ম্যানেজারের নেতৃত্বে একটি মনিটরিং কমিটি রয়েছে। কোন কোন অফডকে যন্ত্রপাতি এবং ট্রেইলর সঙ্কট রয়েছে তা নিরূপণ করে তাগাদা দেয়া হচ্ছে। অফডকগুলোকে বলা হয়েছে, প্রয়োজনীয় ট্রেইলর সংগ্রহ করতে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (এ্যাডমিন এ্যান্ড প্লানিং) জাফর আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বন্দরে কন্টেনারের চাপ কমাতে আমদানিকারকরা সরাসরি ইয়ার্ড থেকে কন্টেনার ডেলিভারি নিতে পারবেন, এমন সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তবে কাস্টমস, বিকডা এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর আরেকটি বৈঠকে সবদিক বিবেচনা করে একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর অফডক থেকেই কন্টেনার ডেলিভারির সিদ্ধান্ত হয়। তিনিও স্বীকার করেন যে, স্ক্র্যাপ আমদানিকারক ইস্পাত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর পর্যাপ্ত সংখ্যক ট্রেইলর রয়েছে, যা দিয়ে তারা সরাসরি ইয়ার্ড থেকে কন্টেনার ডেলিভারি নিতে সক্ষম। এ ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ প্রদান করতে অসুবিধা কী, এমন প্রশ্নের জবাবে বন্দরের শীর্ষ পর্যায়ের এ কর্মকর্তা বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবছি। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনে প্রাইভেট জেটি নির্মাণ করতে পারে। বন্দরের সকল ডিউজ পরিশোধ করে তারা নিজস্ব জেটিতে কন্টেনার নিয়ে যেতে পারেন। এ ধরনের জেটি নির্মাণে কোন বাধা নেই বলে তিনি জানান।
×