ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বর্তমান আইনেই ভ্যাট আদায় করা হোক

প্রকাশিত: ০৩:৪১, ২১ জুলাই ২০১৭

বর্তমান আইনেই ভ্যাট আদায় করা হোক

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত কয়েকদিন আগে সংসদে দেশের শীর্ষ ঋণ খেলাপীদের একটা তালিকা পেশ করেছেন। এ তালিকায় ১০০ ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের নাম আছে। কেন এই তালিকায় বহুল আলোচিত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নাম নেই, কী কায়দায় তারা শীর্ষ খেলাপীর তালিকা থেকে মুক্তি নিয়েছেন তার ওপর লেখা যায়। এটা বেশ ভাল বিষয়। আবেগের বিষয়, জনপ্রিয় বিষয়। লেখা যায় বিদেশী বিনিয়োগের ওপর। কারণ গত ১৯ তারিখেই তিনটি কাগজে এর ওপর তিন ধরনের খবর ছাপা হয়েছে। একটি খবরে বলা হয়েছে, ব্যাংকে ব্যাংকে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সাহায্য করার জন্য ‘হেল্প ডেস্ক’ করা হবে। এই ডেস্ক থেকে বিনিয়োগকারীদের যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করা হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রগুলো কী, মুনাফা দেশে নেয়ার ব্যবস্থা কী, বিনিয়োগের সুরক্ষা ব্যবস্থা কী, কোন্ কোন্ প্রতিষ্ঠানের কী কী সহায়তা লাগবে ইত্যাদি তথ্য এই ‘ডেস্ক’ থেকে দেয়া হবে। এমন খবরের ওপর স্বভাবতই লেখা যায়। পরক্ষণেই দেখা যাচ্ছে আরেক খবরে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সাতটি বড় বড় প্রতিষ্ঠানকে বিদেশে বিনিয়োগ করার জন্য অনুমতি দিয়েছে। কারণ, তাদের অনুমতি ছাড়া ডলার নিয়ে বিদেশে বিনিয়োগ করা যায় না। খবরটিতে গুরুত্বের সঙ্গে বলা হয়েছে, ‘দেশে বিনিয়োগের সুযোগ কম, তাই বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা বিদেশে ছুটছেন।’ ওপরের দুটো খবর একসঙ্গে পড়লে কী মনে হয়? যে বাংলাদেশ ব্যাংক সকল ব্যাংককে বলছে ‘হেল্প ডেস্ক’ খুলতে, সেই বাংলাদেশ ব্যাংকই অনুমতি দিচ্ছে দেশী কোম্পানিকে বিদেশে বিনিয়োগের জন্য। কারণ? দেশে বিনিয়োগের সুযোগ নেই। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। আরেকটি কাগজে আরও চমকপ্রদ একটা খবর ছাপা হয়েছে। ‘একচেন্সার’ নামীয় একটি আইটি কোম্পানি বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে পাততাড়ি গুটিয়ে। এরা গ্রামীণফোনে কাজ করত চুক্তির ভিত্তিতে। কোম্পানি বাংলাদেশে আর কাজ করবে না। ৫৫৬ কর্মী-কর্মকর্তা-কর্মচারীর চাকরিচ্যুতি ঘটিয়ে তারা বিদায় নিচ্ছে ৪ বছর পর। স্বাভাবিকভাবেই তারা তাদের বিনিয়োগও সঙ্গে করে স্বদেশে নিয়ে যাবে। এই তিনটি খবর পড়ে বাংলাদেশের বিনিয়োগের অবস্থার ওপর সুন্দর একটা নিবন্ধ লেখা যায়। আজ এই বিষয়ের ওপরও লিখব না। লেখা যায় মূল্যস্ফীতির ওপর যা বর্ধিষ্ণু। লেখা যায় চাল পরিস্থিতির ওপর যা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসছে। ১৫ লাখ টনের মতো চাল আমদানি হচ্ছে। কিছু চাল দেশে এসে পৌঁছেছে। বন্যা পরিস্থিতিও মনে হচ্ছে অবনীতিশীল নয়। যা হলে লিখতে হতো মানুষের দুর্দশার ওপর। অতএব এ বিষয়ের ওপর লেখা হতেও বিরত রইলাম। রফতানি আশানুরূপ বাড়ছে না, রেমিটেন্স ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছেÑ এসব বিষয়ের ওপর গত সপ্তাহে লিখেছি। অতএব চর্বিত চর্বণের কোন মানে হবে না। যে বিষয়ের ওপর লেখা যায় তা হচ্ছে রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি। এটা এবারের বাজেটের জন্য বড় একটা সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বড় আশা করে তার নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে সংসদে গিয়েছিলেন। এই আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কার্যকর করে তিনি মনে করেছিলেন, ২০ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করবেন। না, তা আর হলো না। নতুন ভ্যাট আইন দুই বছরের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন, ২০ হাজার কোটি টাকার কী হবে? এই টাকা বা রাজস্বের কী ব্যবস্থা করা যাবে? কঠিন কাজ, অর্থমন্ত্রী নিজেই বলেছেন। তিনি এখন স্বীকার করেছেন যে, ২০ হাজার কোটি টাকা ভ্যাট জোগাড় করার লক্ষ্যমাত্রাটা বেশি হয়ে গিয়েছিল। এখন তাহলে কী হবে? অর্থ মন্ত্রণালয়ের কথাবার্তায় মনে হয় ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে বড় ধরনের সংশোধনী দরকার হবে। সংশোধনী সাধারণত বছরের মাঝামাঝিতেই করা হয়। এটাই হয় সংশোধিত বাজেট (রিভাইজড বাজেট)। কিন্তু এবার যা হবে সেটা সংশোধন নয়, বড় ধরনের কাটছাঁট। অতএব, শোনা যাচ্ছে তা সংসদে পেশ করেই আগেভাগেই করা হবে। তাই হোক। কাগজপত্র ঠিক করা হোক। যাতে সারাবছর এর ভিত্তিতে আলোচনা করা যায়। নইলে ‘আওলা’ লাগার সম্ভাবনা আছে। এটা না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট সংশোধন হতে থাক। এতে কারও কোন অসুবিধা নেই যতক্ষণ পর্যন্ত না নতুন কর চেপে বসে মানুষের ওপর। বস্তুত আমার প্রশ্ন, কেন নতুন কর বসানো হবে? কেন বিদ্যমান আইনের ‘কমপ্লায়েন্স’ করা হচ্ছে না? দেখা যাচ্ছে বিদ্যমান আইন পুরোদমে বাস্তবায়ন করলেই প্রচুর রাজস্ব বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে এবং তা ভ্যাট খাতেই। বিগত ১২ জুলাই তারিখের একটা খবর এখানে উল্লেখ করছি। এই খবরে দেখা যাচ্ছে দেশের ১০টি প্রতিষ্ঠান সর্বমোট ভ্যাট রাজস্বের ও সাপ্লিমেন্টারি ডিউটির ৪১ শতাংশ প্রদান করে। বাকিরা দেয় সবে মিলে মাত্র ৫৯ শতাংশ ভ্যাট রাজস্ব। এটা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) খবর। খবরের ভেতরে রয়েছে চমকপ্রদ একটি খবর। সারাদেশে সাড়ে ৮ লাখ প্রতিষ্ঠান আছে যারা ‘ভ্যাটের’ অধীনে রেজিস্ট্রিকৃত। এরপরেই সর্বনাশা খবরটি যাতে বলা হচ্ছে এই সাড়ে আট লাখের মধ্যে মাত্র ৩২ হাজার রিটার্ন দেয় এবং ভ্যাট প্রদান করে। এর অর্থ কী? অর্থ হচ্ছে মাত্র ৪ শতাংশের মতো প্রতিষ্ঠান ‘ভ্যাট’ দিচ্ছে। বাকিরা দিচ্ছে না। আমার প্রশ্ন, এই যেখানে অবস্থা সেখানে নতুন ভ্যাট আইন কেন করা? কেন জোর করে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট কার্যকর করা। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, সাড়ে আট লাখের মধ্যে যে ৩২ হাজার প্রতিষ্ঠান ভ্যাট দেয় তাদের কাছ থেকে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আদায় হয়েছে সর্বমোট ৬৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। যদি দশ শতাংশ প্রতিষ্ঠান ভ্যাট দিত তাহলে কত টাকা ভ্যাট আদায় হতো। যদি এক-তৃতীয়াংশ প্রতিষ্ঠান দিত তাহলে কত আদায় হতো? এই জায়গাটাতে সমস্যা কী আমি বুঝতে অক্ষম। একটা বিষয় তো পরিষ্কার এটা তা হচ্ছে ‘কমপ্লায়েন্স’। এটা কী লোকের অভাবে ঘটছে? এটা কী প্রভাবশালীদের চাপে পড়ে এমন হচ্ছে? এটা কী ব্যবসায়ীদের অসহযোগিতার কারণে হচ্ছে? না কি এটা আদায়কারী এবং ব্যবসায়ী দুইয়ের যোগসাজশে ঘটছে? এর তো একটা উত্তর দরকার। কে দেবে এই উত্তর? শুধু ভ্যাট নয়, সকল ক্ষেত্রেই তা লক্ষণীয়। আয়করেও তাই। বিশাল বিশাল ব্যবসায়ী, বড় বড় পেশাজীবী, বড় বড় চাকরিজীবী কিন্তু ট্যাক্স দেয় না, দিলেও কম। সহায়-সম্পত্তি আছে প্রচুর, বেচা-কেনা প্রচুর, কিন্তু ট্যাক্সের খাতায় শূন্য। প্রতিবছর ঘটা করে শ্রেষ্ঠ আয়কর দাতাদের পুরস্কার দেয়া হয়। যেসব নাম এতে আসে তাতে বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করতে হয় বড় বড় ব্যবসায়ী কোথায়? একজন ব্যবসায়ী নেতা গর্বের সঙ্গে একদিন বললেন, আমরা প্রচুর কর সরকারকে দেই। ভ্যাটের কথা বললেন, সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি, আমদানি শুল্কের কথা বললেন, কোম্পানির করের কথা বললেন। কিন্তু সরকারেরও যে আয়কর দিতে হয়Ñ তার কথা তিনি বলতে চান না। এর ফলে দেখা যায় বিড়িওয়ালা, জর্দাওয়ালা জাতীয় অখ্যাত লোকেরা হচ্ছেন শ্রেষ্ঠ করদাতা, আর আসল ব্যবসায়ীরা রয়ে যাচ্ছেন করের অন্তরালে। বহুবার আমি লিখেছি এসব লিকেজ বন্ধ করতে পারলে রাজস্ব বাড়ানো সম্ভব এবং তা নতুন কর না বসিয়েই। এ ছাড়া দেশের জিডিপি ৭ শতাংশ হারে বাড়ছে। নতুন নতুন আয়ের মানুষ তৈরি হচ্ছে, নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে যেখানে মানুষ আয় করে। সে ক্ষেত্রগুলো আয়কর সেটের মধ্যে আনা দরকার। এটা হচ্ছে না। আমরা জোর দিচ্ছি উৎসে কর কাটার ওপর। এ ধরনের ব্যবস্থা কর আদায়ের সহজ একটা ব্যবস্থা। জনবল লাগে না। এক হুকুমেই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, সংগঠনের মাধ্যমে বড় অঙ্কের কর আদায় করা যায়। কিন্তু এতে ধনী-গরিব ও মধ্যবিত্ত সমানভাবে ‘ট্যাক্সড’ হয়। এটা করনীতির ঘোষিত পন্থার পরিপন্থী। সরকার বার বার বলছে সাম্যের কথা, সমতার কথা। অথচ পরোক্ষ করের দিকেই তার দৃষ্টি। এটা বাজার অর্থনীতির কুফল। বাজার অর্থনীতিতে সাধারণ মানুষের স্বার্থ দেখার কোন ব্যবস্থা নেই। যেমন ‘ভ্যাট’। এটা পরোক্ষ কর, এটা ভোগকর। অথচ মানুষ আয়কর দেয়। একই সঙ্গে দুই করের ব্যবস্থা। এটাই চলছে এবং চলবে বলে মনে হচ্ছে। বর্তমান নিবন্ধে আমি যে কথা বলতে চাইছি তা হচ্ছে ‘কমপ্লায়েন্স’। ‘কমপ্লায়েন্স’ যথাযথভাবে করতে পারলে রাজস্ব ভালভাবে বাড়ানো সম্ভব। যেমন বর্তমান নিয়মের আড়াই লাখ টাকার ওপরে আয় হলেই আয়কর দিতে হবে। এই আয়সীমা যুক্তিযুক্ত কিনা সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু দেখা যাবে আড়াই লাখ বা মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা রোজগার করে এমন লোকের সংখ্যা লাখ লাখ। পথেঘাটে এ ধরনের লোক পাওয়া যায়। অথচ এই নিয়ম কাগজেই। এই আয়সীমার উর্ধে যারা আয় করেন তাদের ৯০ শতাংশই ট্যাক্স দেয় না। একইভাবে ব্যবসায়ীরাও কর দেন নাÑ ভ্যাট দেন না, আমদানি শুল্ক দেন না, আয়করও দেন না। দিলেও তা নিয়মমাফিক একটা কর তারা দেন। অথচ এটা জলের মতো পরিষ্কার নিয়মের মধ্যে যদি সবার কাছ থেকে কর/রাজস্ব আদায় করা যেত তাহলে সরকারের টাকার কোন অভাব হতো না। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×