ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সব বাধা কেটে যাচ্ছে ॥ শীঘ্রই নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালুর সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২০ জুলাই ২০১৭

সব বাধা কেটে যাচ্ছে ॥ শীঘ্রই নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালুর সম্ভাবনা

আজাদ সুলায়মান ॥ নতুন আইন পাস হওয়ায় নতুন উচ্চতায় চলে গেছে সিভিল এভিয়েশন। এতে বেড়ে যাবে এভিয়েশন র‌্যাংকিং। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি দেশের এভিয়েশনের সঙ্গে সমানতালে মর্যাদার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পাবে। আইকাও নির্ধারিত বাংলাদেশের বর্তমান র‌্যাংকিং ৫০ থেকে এক লাফে পৌঁছে যাবে ৭০ এর কাছাকাছি। যা সিভিল এভিয়েশনের জন্য অনন্য অর্জন হিসেবে বিবেচিত হবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা ১৯৬০ সালের পুরানো আইনে এতদিন জোড়াতালি দিয়ে কোনক্রমে কাজ করলেও এখন বিশ্বব্যাপী নতুন করে স্বীকৃতি পাবে সিভিল এভিয়েশন। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল এভিয়েশন এ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফএএ) এই আইনটির জন্যই এতদিন তাগিদ দিয়ে আসছিল। সিভিল এভিয়েশন এ্যাক্ট নামে নতুন এই আইন পাসের দরুন নতুন করে পুনর্গঠন করা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির অবকাঠামো। নতুন আইন বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালুর সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। সিভিল এভিয়েশনের পরিচালক (এফএসআর) উইং কমান্ডার চৌধুরী জিয়াউল কবীর বলেন, আগামী সেপ্টেম্বরে আসছে আইকাও টেকনিক্যাল কমিটির অডিট টিম। তারা ঢাকার সর্বশেষ অবস্থান পর্যবেক্ষণ করার পর তাদের প্রতিবেদন ইতিবাচক হলে অক্টোবরে আসবে এফএএ টিম- যাদের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করছে নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালুর ভাগ্য। বিলম্বে হলেও নতুন আইন পাস হওয়ায় এখন প্রধান প্রতিবন্ধকতা কেটে গেছে। বাকি ইস্যুগুলো সহজেই সমাধান করার মতো। এ বিবেচনায় বলা চলে, নতুন আইনের দরুন নতুন উচ্চতায় পৌঁছে গেছে সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ বা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। জানা গেছে, সিভিল এভিয়েশন এতদিন চলছে ১৯৬০ সালের পুরানো আইন দিয়ে। মূলত জোড়াতালি দিয়েই কোনক্রমে এভিয়েশন সেক্টরের কাজ চালানো হলেও এতে আইকাও এবং এফএএ আরোপিত অনেক শর্তই অপূরণীয় থেকে যায়। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ সেক্টরের আধুনিকায়ন সম্ভব হয়নি। আর প্রধান প্রধান শর্ত পূরণ করতে না পারায় বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশনের মর্যাদাও এতদিন ছিল উপেক্ষিত। যেমন বছরের পর বছর ধরেই আইকাও এবং এফএএ তাগিদ দিয়ে আসছিল ১৯৬০ সালের পুুরানো আইন বাদ দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন আইন পাস এবং নতুন অর্গানোগ্রাম বাস্তবায়ন করার। আইকাও আরোপিত প্রধান ৮টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে এ দুটোই প্রধান। এ দুটোই এখন বাস্তবায়নের পথে। নতুন আইনের পর এখন বাকি রয়েছে সিভিল এভিয়েশনের অর্গানোগ্রাম। এটাও চূড়ান্ত হওয়ার পথে। প্রায় সাড়ে দশ হাজার জনবলের এই অর্গানোগ্রামের মধ্যে ১৯০০ লোক প্রাথমিকভাবে নিয়োগ করার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতিও পাওয়া গেছে। পর্যায়ক্রমে বাকি জনবলেরও অনুমোদন পাওয়া যাবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন সিভিল এভিয়েশনের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এহসানুল গনি চৌধুরী। তিনি বলেছেন, নতুন আইন আর নতুন অর্গানোগ্রাম বাস্তবায়ন এখন সময়ের ব্যাপার- এই যেমন মাস তিনেকের মধ্যেই এ দুটো বিষয়ের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হবে। অর্গানোগ্রামে প্রাথমিকভাবে কিছু লোক নিয়োগের অনুমতি অর্থ মন্ত্রণালয় দিলেও এখন শুধু সার্ভিসরুল (চাকরিবিধি) তৈরির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। আশা করা হচ্ছে মাস তিনেকের মধ্যে এটাও হয়ে যাবে- কারণ এটা সরকারের টপমোস্ট প্রায়োরিটি। জানা গেছে, বর্তমানে আইকাও-এর অন্তর্ভুক্ত ১৯২টি দেশের অন্যতম বাংলাদেশের সিভিল এভিয়েশনের সর্বশেষ নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ ও অগ্রগতির চূড়ান্ত মূল্যায়নের সময় এসেছে। আগামী সেপ্টেম্বরেই আসছে আইকাও-এর একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল। তারা ঢাকায় অবস্থান করে এ যাবত সিভিল এভিয়েশনের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ সচক্ষে প্রত্যক্ষ করবেন এবং এ সংক্রান্ত ডকুমেন্টস পর্যবেক্ষণ করবেন। এতে সন্তুুষ্ট হলে তারা একটি প্রতিবেদন দাখিল করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন পরিচালক (এফএসআর) উই্ং কমান্ডার চৌধুরী জিয়াউল কবীর বলেন, আইকাও যদি ভাল রিপোর্ট দেয় তারপর আসবে এফএএ টিম। ওই টিম ইন্টারন্যাশনাল এভিয়েশন সেফটি এসেসমেন্ট (আইএএসএ) পর্যবেক্ষণ করে যদি সন্তুুষ্ট হয়ে ভাল রিপোর্ট দেয়- তাহলেই নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালুর বিষয়ে আর কোন প্রতিবন্ধকতা থাকবে না। আমাদের দৃঢ বিশ্বাস আগামী ছয় থেকে নয় মাসের মধ্যেই এসব কাক্সিক্ষত ইস্যুর নিষ্পত্তি সম্ভব হবে। এজন্যই বলা চলে বহুল প্রতিক্ষিত নিউইয়র্ক ফ্লাইট চালুর সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। নতুন আইনে বাংলাদেশ সিভিল এভিয়েশনের আন্তর্জাতিক মান কোন পর্যায়ে পৌঁছবে জানতে চাইলে চৌধুরী জিয়াউল কবীর বলেন, র‌্যাংকিং বেড়ে যাবে অনেক। নিরাপত্তা, প্রশিক্ষণ ব্যবস্থাপনা, পেশাদারিত্ব ও অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার দিক বিবেচনায় আইকাও প্রতিটি দেশেরই একটা র‌্যাংকিং (অবস্থান) করে থাকে। সে অনুযায়ী বর্তমানে বাংলাদেশের র‌্যাংকিং হচ্ছে ৫০ দশমিকের সামান্য উপরে। কিন্তু আইকাও মান অনুযায়ী বিশ্বের গড় র‌্যাংকিং দরকার কমপক্ষে ৬০। নতুন আইন ও অর্গানোগ্রাম বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের র‌্যাংকিং দাঁড়াবে ৬০ থেকে ৭০ পর্যন্ত, যা দেশের এভিয়েশন খাত সম্পর্কে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন মর্যাদা সম্মানজনক স্থানে নিয়ে যাবে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এই আইনটিকে যুগান্তকারী উল্লেখ করে জানিয়েছেন, বিশ্বের বহুল আলোচিত এই আইনে উন্নত বিশ্বের এভিয়েশন এ্যাক্টের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বেশ কিছু কঠোর শৃঙ্খলার অনুচ্ছেদ রাখা হয়েছে। যেমন বিমান চলাচলে বিঘœ সৃষ্টির জন্য মৃত্যুদ-সহ নেভিগেশনের অনুরূপ আলো বা সংকেত ব্যবহার করলে যাবজ্জীবন কারাদ- বা অনধিক ৫ কোটি টাকা অর্থদ- রয়েছে। গত সপ্তাহে বেসামরিক বিমান চলাচল আইন নামেই এটি পাস হয়েছে সংসদের সদ্য সমাপ্ত অধিবেশনে। এই বিলের সবচেয়ে আলোচিত সপ্তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে, কোন ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে বিমান চলাচলে বিঘœ সৃষ্টি করলে মৃত্যুদ- বা যাবজ্জীবন কারাদ- বা অনধিক ৫ কোটি টাকা অর্থদ- বা উভয়বিধ দ-নীয় হবেন। বিমানের নেভিগেশনের অনুরূপ বা সাদৃশ্যপূর্ণ আলো বা সংকেত ব্যবহার করলে অনধিক যাবজ্জীবন কারাদ- বা অনধিক ৫ কোটি টাকা অর্থদ- বা উভয়বিধ দ-নীয় হবেন। বিপজ্জনক পদ্ধতিতে বিমান চালানোর জন্যও একই দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। একই দ-ের বিধান রাখা হয়েছে অপরাধ সংঘটনে সহায়তার জন্যও। দুর্ঘটনাকবলিত বিমানের যন্ত্রাংশ বা মালপত্র সরিয়ে ফেলার ক্ষেত্রে সাত বছরের কারাদ- ও অপসারিত যন্ত্রাংশের দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। একইভাবে উড়োজাহাজে বিপজ্জনক পণ্য পরিবহন করলে অনধিক সাত বছরের সশ্রম কারাদ- বা ৫০ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- দেয়া হবে। একই দ-ের বিধান রাখা হয়েছে অবৈধভাবে বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনের জন্যও। এছাড়া নিবন্ধন, লাইসেন্স, পারমিট জাল করাসহ আইনের বিধান লঙ্ঘনের জন্য পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদ- বা অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- দেয়া হবে। রেকর্ড সংরক্ষণের ক্ষেত্রে এয়ার অপারেটররা যদি মিথ্যা প্রতিবেদন দেন, সেক্ষেত্রে তারা অনধিক তিন বছরের সশ্রম কারাদ- বা অনধিক ৫০ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-নীয় হবেন। প্রয়োজনীয় তদন্তের ক্ষেত্রে কেউ রেকর্ডপত্র, দলিলের তথ্য উপস্থাপনে অস্বীকৃতি জানালে এক বছরের কারাদ- বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-নীয় হবেন। নতুন এই আইনে আরও রয়েছে- পারমিট ছাড়া কোন বিদেশী এয়ার অপারেটর বাংলাদেশে কোন বাণিজ্যিক উড়োজাহাজ পরিবহন সেবা দিতে পারবে না। এজন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি থাকতে হবে। বিদেশী অপারেটরদের বিক্রয় প্রতিনিধি নিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশী নাগরিকের শতভাগ মালিকানাধীন নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগের শর্ত আরোপ করা হয়েছে। তবে বিদেশী অপারেটর ও তার বিক্রয় প্রতিনিধির মধ্যে কোন বিরোধ দেখা দিলে, বিরোধ চলাকালীন পরিবহন সেবা বন্ধ করা হবে না। তবে এ আইনের একটি অনুচ্ছেদের চরম আপত্তি জানিয়ে বিমান এয়ারলাইন্স পাইলট এ্যাসোসিয়েসন্স (বাপা) এর সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুব জনকণ্ঠকে বলেন, এটা শুধু নেভিগেশনের কাজে বাধা দিলে বাধাদানকারী ব্যক্তি সাজার আওতায় আসবেন। যেমন, পাইলট জাহাজ নিয়ে উড্ডয়নের প্রস্তুতির সময় কেউ যদি বাধা দেয়, লাইট বিছিন্ন করে দেয়, কিংবা হুমকি প্রদান করে তবেই তাকে মৃত্যুদ-ের মতো সাজা ভোগ করতে হবে। এই আইনের ৩ নং ধারায় বলা হয়েছে কোন পাইলট যদি দুর্ঘটনার শিকার হয়েও বেঁচে যান তাহলেও তাকে সাজা ভোগ করতে হবে। তাকে কমপক্ষে ৫০ লাখ টাকা জরিমানা গুনতে হবে। আমরা এই অনুচ্ছেদের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে অর্থ আইন ও বিমান মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানিয়েছিলাম। কিন্তু তারা সেটা বিবেচনায় আনেনি। ক্যাপ্টেন মাহবুব এই অনুচ্ছেদের প্রতি আপত্তি জানিয়ে বলেছেন, এতে করে একজন পাইলট সব সময় মানসিক চাপ ও অস্থিরতায় ভুগবে। যার ফলশ্রুতিতে তিনি অন্যমনস্ক হয়ে গেলে আরও বড় বিপদের কারণ হতে পারে। কেননা বাসের ড্রাইভার যদি দুর্ঘটনা করে দায়ী হয় তাহলে তাকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ডাক্তারের হাতে যদি রোগী মারা যায়, তাকেও ওয়াকওভার দেয়া হয়। কিন্তু পাইলটের বেলায় কেমন এমনটি হবে। এজন্যই আমরা এর বিরোধিতা করছি। দেশের শীর্ষস্থানীয় এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী নতুন আইনে বিমান চলাচলে একটা বিশেষ মযার্দায় আসীন হবার ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশেই এভিয়েশন সেক্টরের কিছু কমন পলিসি রয়েছে। মূলত দুনিয়ার সব দেশেরই বিমান চলাচল আইন মোটামুটি একই ধাচের। আইনটি অনেক আগেই করা আবশ্যক ছিল। প্রতিবেশী ভারতে কয়েক দশক আগেই এমন কানুন তৈরি করা হয়।
×