ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ২০ জুলাই ২০১৭

নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র -স্বদেশ রায়

দেশের প্রধানমন্ত্রী যখন বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে তখন বিষয়টিকে হাল্কাভাবে দেখার কোন পথ থাকে না। তাছাড়া বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে, ক্ষমতার পালাবদল নিয়ে যে ষড়যন্ত্র দেশ স্বাধীনের পর থেকে চলে আসছে এটা আরও কিছু কাল চলবে। সমাজের নানান স্তরে আরও কিছু পরিবর্তন, দীর্ঘস্থায়ী প্রগতিশীল শাসন ও রাষ্ট্রের কাঠামো এবং রাজনৈতিক দলের মধ্যে ভারসাম্য আসার পরেই এ ষড়যন্ত্র বন্ধ হবে। এই ষড়যন্ত্রের পেছনে অনেক সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় কাজ করে। ১৯৭২ সাল থেকে দেখা যাচ্ছে ষড়যন্ত্র বেশি হয় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে বা ক্ষমতায় থাকলে। এর অনেক কারণ আছে, তবে প্রধান কারণ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে এ দেশের গ্রামের মানুষ ক্ষমতাবান হন এবং ঢাকাকেন্দ্রিক এলিটের বদলে গ্রামকেন্দ্রিক নেতারা রাষ্ট্র পরিচালনায় চলে আসেন। যেমন নুরুল আমীন, সোহ্রাওয়ার্দী প্রমুখ বিলেত ফেরত শিক্ষিতের স্থানে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজের গ্রাজুয়েট শেখ মুজিবুর রহমানকে এই ঢাকা শহরকেন্দ্রিক এক ধরনের এলিটরা মানতে পারেনি তবে তাদের মেনে নিতে হয়েছিল। কারণ, কমিউনিস্টরা রাষ্ট্রে যে বিপ্লব করতে চায় অথচ আগে নিজের জীবনে সে বিপ্লব করতে পারেন না শেখ মুজিবুর রহমান নিজের জীবনে সেই বিপ্লব করেছিলেন। তিনি বিশ্বমানের এলিটদের ওপরে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিলেন। আর শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ঘটিয়েছেন আরেক বিপ্লব নিজেদের পারিবারিক জীবনে, তাঁরা গোটা পরিবারটাকে নিয়ে গেছেন বিশ্ব পরিম-লে। তাই শেখ হাসিনাকে আর গ্রাম থেকে উঠে আসা বলে গালি দেয়ার সাহস নেই কোন তথাকথিত এলিটের। তবে এর পরেও বঙ্গবন্ধুর ওপরে এই তথাকথিত এলিট শ্রেণীর যে কারণে ক্ষোভ ছিল একই ক্ষোভ শেখ হাসিনার ওপরও। কারণ, বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনা উভয়েরই নীতি এক। ক্ষমতায় গেলেই দেশের সাধারণ মানুষকে ক্ষমতাবান করা। দেশের প্রায় সব চালকের স্থানে বসেন সারাদেশ থেকে উঠে আসা মানুষÑ এরা সাধারণ মানুষকে চেনেন তবে এলিটদের আলাদা করে চেনেন না। এলিটরা সংখ্যায় কম হলেও কী হবে; তাদের হাতে অনেক ক্ষমতা। যেমন মুনতাসীর মামুনদের মতো শিক্ষিত ও নীতিবান প্রফেসররাও আওয়ামী লীগার বা দলীয় হয়ে গেছেন এই এলিট নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া-মনোজগতের কাছে। অন্যদিকে ফরহাদ মজহার (মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন) মাত্র ক’দিন আগেও তিনি এ দেশের মিডিয়ার কাছে ছিলেন ব্লু আইড বয়। তাই আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে এলিটরা এভাবে নানা দিক থেকে ষড়যন্ত্র করবেই। আগামী নির্বাচন নিয়ে এ দেশের তথাকথিত এলিটদের একটি ষড়যন্ত্র থাকবেই। আগামী নির্বাচনে যদি ধর্মের ধুয়ো না তুলতে পারে, শেখ হাসিনা তাঁর বুদ্ধিমত্তা দিয়ে যদি এই ধুয়ো বন্ধ রাখতে পারেন তাহলে নির্বাচন হবে ‘উন্নয়নের’ ওপর। সেখানে আওয়ামী লীগের সমস্যা থাকবে একটিÑ তাদের কিছু কর্মীর অসৎ কাজ ও একটা সংখ্যক এমপির লোকাল দুর্নীতি। যার বিরুদ্ধে এখন থেকেই শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদের কাজ করছেন। তারা যদি আগামী দেড় বছরের ভেতর তাদের ওই সব কর্মী ও নব্য আওয়ামী লীগারদের রাশ টেনে ধরতে পারেন এবং নির্বাচনে সঠিক প্রার্থী দিতে পারেন তখন নির্বাচনের একমাত্র বিষয় হবে উন্নয়ন। উন্নয়নে দুটি শর্ত অপরিহার্য : এক. সরকারের ধারাবাহিকতা। দুই. সরকার পরিচালনার জন্য যোগ্য নেতৃত্ব। শুধু সব দলের অংশগ্রহণের একটি নির্বাচন কখনই উন্নয়নের মুখ্য ভূমিকা রাখে না। এমনকি সুশাসনও আনতে পারে না। ২০০১ সালে তথাকথিত কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচন হয়েছিল। সব দল অংশগ্রহণ করেছিল। দেশ কী পেয়েছিল? উন্নয়নের দিকে যদি তাকাই দেশ পেয়েছিল শুধু ‘হাওয়া ভবন’ আর ‘খাম্বা’। এক মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করতে পারেনি ওই সরকার। কেন পারেনি তা তৎকালীন মুখ্য সচিব কামাল সিদ্দিকী পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, শুধু তারেক রহমানের কমিশনের চাপেই কেউ বিদ্যুতকেন্দ্র করতে এগিয়ে আসেনি। তাঁদের ক্ষমতার শেষের দিকে এসে তাঁরা ৫০টি কুইক রেন্টাল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তাও তারেক রহমানের কমিশনের চাপের কারণে আর বাস্তবায়িত হয়নি। অন্যদিকে ওই সময়ের সুশাসনের আর কিছু নমুনা হলো, বগুড়ার অস্ত্র, চট্টগ্রামের দশ ট্রাক অস্ত্র, একুশে আগস্ট, আর ৫২৭টি বোমা ৬৩ জেলায়। এর মূল কারণ সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হয়েছিল ঠিকই তবে দেশ সঠিক নেতা নির্বাচন করতে পারেনি। অন্যদিকে আগামী নির্বাচনের আগে নয়, এখনই কেবল দেশে নয় বিদেশেও প্রতিষ্ঠিত শুধু সত্য বাংলাদেশে নয়, এ মুহূর্তের পৃথিবীতে শেখ হাসিনা অন্যতম যোগ্য নেতা। আগেও এ কলামে লিখেছি এবং বাংলাদেশের যে কাউকেই সকল দলীয় চিন্তার উর্ধে উঠে সত্য বলতে হলে বলবেন, উন্নয়নের জন্য সিঙ্গাপুর যেমন লি কুয়ানকে পেয়েছিল, থাইল্যান্ড যেমন রাজা ভূমিবলকে পেয়েছিল, মালয়েশিয়া যেমন মাহাথিরকে পেয়েছিল বাংলাদেশ তেমনি শেখ হাসিনাকে পেয়েছে। তাই ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে যদি মূল ইস্যু হয় ‘উন্নয়ন’ তাহলে সে নির্বাচনের ফল জনগণ আগের থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছে। দেশের উন্নয়নের জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ধারাবাহিকতার বিকল্প ভাবার কোন সুযোগ জনগণের নেই। এর পরে স্বাভাবিকই প্রশ্ন আসে নিশ্চিত পরাজয় জেনেও বিএনপি কেন নির্বাচনে যাবে? বিএনপি যদি সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হতো তাহলে তারা নির্বাচনে যেত। তাদের নির্বাচনে যাওয়ায় দুটো লাভ ছিল– এক. গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বিএনপি ক্রমেই একটি মৌলবাদী জঙ্গী দলে পরিণত হয়েছেÑ এই নির্বাচনে মৌলবাদীদের বাদ দিয়ে অংশগ্রহণ করার ভেতর দিয়ে তারা একটি কনজারভেটিভ রাজনৈতিক দলের চরিত্রে ফিরতে পারত। দুই. এ মুহূর্তে বিএনপির বিরোধীদলীয় স্ট্যাটাস নেই। সেটায় ফিরে যাওয়ার জন্য তারা চেষ্টা করার একটা সুযোগ পেত। এই অবস্থায় পড়ার পরে যে কোন দেশের একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের জন্য এ দুটোই অনেক বড় অর্জন। কিন্তু বিএনপির মূল নিয়ন্তা পাকিস্তানী গোয়েন্দা বাহিনী আইএসআই ও তাদের এ দেশীয় জঙ্গী সংগঠনগুলো বিএনপিকে সেখানে যেতে দেবে কিনা তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। তারেক রহমান যেভাবে জঙ্গীদের হাতের মুঠোয় চলে গেছেন তাতে বিএনপির শুধুমাত্র এই দুই স্ট্যাটাসের জন্য নির্বাচনে আসার সম্ভাবনা খুবই কম। অন্যদিকে ওই তথাকথিত এলিট শ্রেণী বা সুশীল সমাজ যখন দেখবে নির্বাচনে আবার শেখ হাসিনা ফিরে আসছে তখন তারাও চাইবে বিএনপিকে সঙ্গে নিয়ে একটি অন্ধকার পথে হাঁটতে। আর এ রাষ্ট্রে ও সমাজে যখনই বিএনপির মতো একটি শক্তি ও তার সঙ্গে বেশ বড় আকারের একটি এলিট এক জোট হবে সে সময়ে তারা নির্বাচন বন্ধের ষড়যন্ত্র করার নানান সুযোগ পাবে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নির্বাচন বানচাল করার জন্য একের পর এক চেষ্টা তারা করবে। যেমন বেশ কিছু দিন যাবত বাংলাদেশে পাকিস্তানের ইফতেখারের একটা ছায়া দেখা যাচ্ছে। শেখ হাসিনার অসীম ধৈর্যশীল নেতৃত্বের কারণে এই ছায়া কায়ায় রূপ নিতে পারছে না। এসব পাঁয়তারাও মূলত নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারার ভেতর পড়ে। অন্যদিকে ইসি রোডম্যাপ ঘোষণার পরে ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মওদুদ আহমদ, জামায়াত-বিএনপিপন্থী সুশীল বদিউল আলম মজুমদার প্রমুখ যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন, তাতে স্পষ্ট, তারা এখনও নির্বাচন বানচাল করে অন্য কোন ধরনের সরকারের পক্ষে। বিএনপির পক্ষে এক শ্রেণীর লোকের যুক্তি হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপি কখনই সংগঠিত হতে পারবে না। তাই অসংগঠিত সংগঠন নিয়ে নির্বাচনে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠে না। এ জন্য বিদেশী নানান শক্তিকে বোঝানো হচ্ছে, বাংলাদেশে একটি ইনক্লুসিভ ইলেকশন করার জন্য আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদ শেষ ও ইলেকশন হওয়ার আগে একটা মধ্যবর্তী সময় দরকার। যেখানে একটা দল নিরপেক্ষ সরকার ক্ষমতায় থাকবে- যার ফলে সব দল তাদের সংগঠন গোছানোর সময় পায়। এসব কথার উত্তর বাংলা প্রবাদে অনেক আগেই দেয়া আছে, ‘শঠের ছলের অভাব হয় না।’ বাংলা লোককথাগুলোতে শঠের প্রতীক শিয়াল। সে যেমন ধূর্ত তেমনি রাতের বেলা তার চলাচল। এই ধূর্ত ও অন্ধকারের জীবগুলোর চলাচল বেড়ে গেছে এবং তারা এমন কোন কিছু ইতোমধ্যে করেছে যে প্রধানমন্ত্রী জনগণকে জানিয়ে দিলেনÑ রাতে শিয়াল নেমে গেছে দেশে। এখন এই ধূর্ত শিয়ালদের ঠেকাতে হবে জনগণকে তাদের ঐক্য দিয়ে। কারণ, যে কোন ধরনের একটি নির্বাচিত সরকার বা রাজনৈতিক সরকার যে কোন অনির্বাচিত সরকারের থেকে অনেক ভাল। ২০১৪ সালের নির্বাচন ইনক্লুসিভ ছিল না, কিন্তু দেশের উন্নয়ন ও গণতন্ত্র থেমে থাকেনি। আর ফখরুদ্দিনের আমলে দেশের শিল্প-বাণিজ্য কোথায় গিয়েছিল ব্যবসায়ীরা এ মুহূর্তে জনগণকে জানাতে পারেন। তাতে দেশের উপকার হবে। [email protected]
×