ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২০ জুলাই ২০১৭

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন

‘মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন-২০১৭’-এর চূড়ান্ত খসড়া সোমবার অনুমোদিত হয়েছে মন্ত্রিসভায়। আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এটি জাতীয় সংসদে উপস্থাপনের মাধ্যমে পাস হলে কার্যকর হবে আইন। এই আইনে ক্যাডাভেরিক বা ব্রেন ডেথ ঘোষিত কোন ব্যক্তির হৃৎপি-, কিডনি, ফুসফুস, অন্ত্র, যকৃৎ, অগ্নাশয়, অস্থি, চোখ, চর্ম ও টিস্যুসহ মানবদেহে প্রতিস্থাপন ও সংযোজনযোগ্য যে কোন অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ দান করা যাবে। তবে এসব ক্ষেত্রে আইনানুগ উত্তরাধিকারীর লিখিত অনুমতি নিতে হবে অবশ্যই। অবশ্য চোখ ও অস্থিমজ্জা সংযোজনের ক্ষেত্রে নিকটাত্মীয় হওয়ার আবশ্যকতা থাকবে না। একই সঙ্গে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনে নিকটাত্মীয়ের সংজ্ঞাও সম্প্রসারিত করা হয়েছে। এর পাশাপাশি সরকারের অনুমোদন ব্যতিরেকে কোন হাসপাতালে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন বা প্রতিস্থাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে যেসব সরকারী হাসপাতালে বিশেষায়িত ইউনিট আছে, সেখানে এ ধরনের অনুমোদনের প্রয়োজন পড়বে না। আইন অমান্যকারীকে তিন বছর কারাদ- ও ১০ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। দেশে এ রকম একটি সময়োপযোগী আইনের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল দীর্ঘদিন থেকেই। বিশিষ্ট চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, সার্জন ও কিডনি বিশেষজ্ঞদের মতে, মানুষের মৃত্যুর পর একমাত্র মস্তিষ্ক ব্যতিরেকে চোখ, কিডনি, লিভার ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করা যায়। এর মাধ্যমে অর্থাৎ, ক্ষেত্রবিশেষে এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিকে নতুন জীবনদান করা সম্ভব সহজেই। উন্নত দেশের মতো বর্তমানে বাংলাদেশেও চোখের কর্ণিয়া, কিডনি, লিভার ইত্যাদি প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে চিকিৎসার ব্যয়ও তুলনামূলকভাবে অনেক কম বিদেশের তুলনায়। তবে দেশে সেই অনুপাতে প্রতিস্থাপনযোগ্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাওয়া যায় না বললেই চলে। কেননা, প্রথমত এ ক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলনটি তেমন জোরালো নয়। এর পাশাপাশি নানা সংস্কারও রয়েছে। সর্বোপরি রয়েছে নানা আইনী প্রতিবন্ধকতা। কিডনি, লিভার ইত্যাদির ক্ষেত্রে তা জটিল ও ঝামেলার। সরাসরি রোগীর নিকটাত্মীয় ও স্বজন ছাড়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেয়া যায় না। নিকট অতীতে এ নিয়ে কিছু স্বার্থান্বেষী মহল বেআইনী ও নীতিনৈতিকতাহীন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ায় তা রয়েছে প্রায় নিষেধাজ্ঞার পর্যায়ে। সরকার তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে যুগোপযোগী আইনের খসড়া প্রণয়ন করলেও তা চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায়। অপেক্ষাকৃত সহজ হলেও চক্ষুদানও যে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, এমন কথা বলা যাবে না। তবে আইনের চেয়েও বেশি প্রয়োজন সর্বস্তরে জনসচেতনতা এবং সামাজিক আন্দোলন। মানুষকে বুঝতে হবে যে, মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী হলেও সুস্থ ও নীরোগ দেহে বেঁচে থাকাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আর এর জন্য প্রয়োজন নিরন্তর গবেষণা ও অনুসন্ধান। গত কয়েক বছরে চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং ওষুধ শিল্পের প্রভূত উন্নতি সাধন হয়েছে। এর ফলে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে অনেক, এমনকি বাংলাদেশেও। এও সত্য যে, নিত্যনতুন রোগ-ব্যাধি ও জটিলতা দেখা দিচ্ছে, যা সময় সময় রীতিমতো হুমকি হয়ে দাঁড়ায় মানুষের জন্য। এক সময় ক্যান্সার, এইচআইভি এইডস ইত্যাদি দুরারোগ্য ব্যাধি হিসেবে পরিগণিত হতো। বর্তমানে অনেক ভাল ওষুধ আবিষ্কৃত হওয়ায় তা অনেকটাই আয়ত্তের মধ্যে। এর পরও কিছু ক্ষেত্রে তা আজও অনিরাময়যোগ্য। পারকিনসন্স, আলঝেইমার অদ্যাবধি নিরাময়যোগ্য নয়। বার্ধক্য বা বুড়িয়ে যাওয়া প্রতিরোধও মানুষের আকাক্সিক্ষত। এর বাইরেও লিভার, কিডনি, হার্ট প্রতিস্থাপনও যে খুব সহজসাধ্য ও সহজলভ্য, তা নয়। সে জন্য মরণোত্তর দেহ, চোখ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দানের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, সুস্থ দেহ, সুস্থ মনে বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যক নিরন্তর গবেষণা। ইতালির এক বিশ্বখ্যাত শল্য চিকিৎসক প্রফেসর সের্গিও কানাভারো তো চলতি বছরই একটা পূর্ণাঙ্গ মানুষের মস্তক প্রতিস্থাপনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। অনেক উন্নত দেশে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগীর যন্ত্রণা লাঘবে ইউথেনাসিয়া বা স্বেচ্ছা মৃত্যুবরণের আইন রয়েছে। মানুষের মঙ্গল তথা কল্যাণার্থেই তা অত্যাবশ্যক।
×