ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

আমাদের কালো টাকা কি সুইস্ ব্যাংকে জমা হবে?

প্রকাশিত: ০৫:৫৫, ১৯ জুলাই ২০১৭

আমাদের কালো টাকা কি সুইস্ ব্যাংকে জমা হবে?

পাঠকবৃন্দ সম্প্রতি বাংলাদেশের কালো টাকার উৎপত্তি, তার লক্ষ্যস্থল সুইস্ ব্যাংকের একটি হিসাব সংবাদপত্রে দেখতে পেয়েছেন। অনস্বীকার্য যে, তারা এ টাকার পরিমাণ বৃদ্ধির ধারাবাহিকতা দেখে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ এবং ক্রুদ্ধ হয়েছেন। আরও ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবারের বাজেটেও অর্থমন্ত্রী কালো টাকাকে সাদা করার ব্যবস্থা বলবত রেখেছেন দেখে। কী আশ্চর্য! পাশের ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এত বিশাল দেশের কালো টাকা নিষিদ্ধ করতে অতি গোপনে একরাতে বড় নোটগুলোকে বাতিল ঘোষণা করে হাজার হাজার ট্রাক ভর্তি নতুন টাকার নোট প্রদেশের জেলা, উপজেলা, গ্রামে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করেন! শুরুতে সাময়িক অসুবিধা হলেও অর্থনীতি, বাজার-হাট-দোকান, শেয়ারবাজার, সবকিছু আবার যথাস্থানে ফেরত এসেছে। এ পদক্ষেপের পর পর সুইস্ ব্যাংকে ভারতীয়দের সঞ্চয় হার দ্রুত কমে এসেছে। আমাদের স্মরণে আসে ’৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু কালো টাকার দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে এক শ’ টাকার নোট বাতিল করেছিলেন। তখন অচল টাকার বস্তা যেখানে সেখানে পাওয়া গিয়েছিল। অথচ বিপরীতে, বর্তমানে বাংলাদেশের দেশপ্রেমিক শিল্পপতি, ব্যবসায়ীদের কালো টাকা অথবা বৈধভাবে অর্জিত অর্থও আ-ারইনভয়েসিং, ওভারইনভয়েসিং, হু-ি, সেকেন্ডহোম, ব্যাংকের বেআইনী পথে পাচার হয়ে সেই কালো টাকা সুইস্ ব্যাংক নামক ডাকাতদের ব্যাংকে ক্রমশ উচ্চহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে! এর চাইতে লজ্জার বিষয় আর কি হতে পারে? ছোটবেলায় পড়েছিলাম, অর্থই অনর্থের মূল। এখন সংবাদপত্র খুললে এমন অনর্থের হাজারো ঘটনা প্রতিদিন জানতে হয়। সেই কবিতা, ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি’Ñ আঃ, সকল মন প্রাণ যেন একটা শুচি শুদ্ধ ¯œানে পবিত্র হয়ে উঠত। কবিতা পড়া সেই মানুষগুলো কখনও নিজেকে বিপথে চলতে দিতে পারে না- এ তো সেই সময়ের মানুষকে দেখলেই বোঝা যায়। জন্মভূমির জন্য রচিত যেসব গান, কবিতা বাঙালীর মর্মমূলে চিরস্থায়ী আসন গ্রহণ করেছে, সেগুলো নজরুলের নিপীড়িতের জন্য রচিত গান, কবিতা এখনকার সুইস্ ব্যাংকে অর্থ জমাকারীদের কেউ কি পড়েছে? শুনেছে? সন্দেহ হয়। একটা কথা অর্থমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীকে মান্য করতে হবে যে-একটা দেশের একটা উঠতি ধনী শ্রেণী যত বেশি সংখ্যক হারে সুইস্ ব্যাংকে অর্থ জমা করবে, সে দেশ তত দুর্নীতিপ্রবণ বলে গণ্য হবে এবং দুর্নীতি বৃদ্ধি মানে সুশাসনহীনতা। অর্থমন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর, প্রধানমন্ত্রীকে দুর্নীতি ও সুশাসনের অভাব-এর জন্য সুইস্ ব্যাংকে অর্থ জমার পরিমাণকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক হিসেবে চিহ্নিত করে এটি রোধ করতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একটা কথা স্মরণ করা খুব জরুরী, আমি নিজে সৎ, কিন্তু অধস্তন এবং অন্যদের অসৎ পথ অবলম্বন, অসাধু উপায়ে অর্থোপার্জনকে মেনে নেব- এই ডবল স্ট্যা-ার্ড অন্তত বর্তমান সৎ, জনদরদী প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর কাছে জনগণ দেখতে চায় না। সরকারী ব্যাংকগুলোকে বিগত অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া কঠিন নীতির ওপর স্থাপন করে এ খাতের সংস্কার করছিলেন, যা অর্থনীতিতে সুফল দিতে শুরু করেছিল। ঐ সময় আমি বিদেশীদের সঙ্গে একটি শিক্ষা প্রকল্প মূল্যায়নে কাজ করছিলাম। ওরা আমাকে বলেছিল, ‘তোমাদের অর্থমন্ত্রী দুর্দান্ত কাজ করছেন, তোমাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে’। শুনে অর্থনীতির তত্ত্ব না বুঝলেও গর্বে বুকটা ফুলে উঠেছিল। তাই বলছি, কেন আপনারা দুজন শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির হোতাদের মাথায় তুলে দ-ের বাইরে রাখছেন? ব্যাংকগুলোকে ব্যাংক মালিকদের শোষণের সুযোগ কেন আরও বাড়ালেনÑ এসব প্রশ্নের জবাব এবারের নির্বাচনে দিতে হবে বলেই মনে হচ্ছে। ভ্যাট এবং ব্যাংকের সঞ্চয়ের ওপর কর্তন আগেও ছিল। এ দুটি নিয়ে গণশুনানি করা হলে আমার গভীর বিশ্বাস জনগণ বর্তমানের ব্যবস্থা এবং ভবিষ্যতের বাজেটে গৃহীত ব্যবস্থার তুলনামূলক চিত্রটি পরিষ্কারভাবে বুঝে নিত। এর সঙ্গে জনগণের জানা প্রয়োজন, তাদের চাহিদা ও সেবা প্রদানের অর্থ কিভাবে রাষ্ট্র সংগ্রহ করে? কেন পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্রসহ শত শত সেতু, রাজপথ, হাসপাতাল, স্কুল সরকার তৈরি করছে? তার জন্য যে জনগণের সেবামূল্য প্রদানই সরকারের তহবিল তৈরির একমাত্র উৎসÑ প্রধানত আয়কর ও ভ্যাট এবং অন্যান্য শুল্ক, এই তথ্য পাঠ্যবই ও শিক্ষাক্রমে, মিডিয়ায় প্রচার করা প্রয়োজন। এই সহজ কথাটা কিন্তু কোন সাধারণ মানুষ এমনকি শিক্ষিতরাও জানে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে যখনই কোন বাজারে, বেকারি বা সাধারণ দোকানে সদাই করি, প্রায়ই তরুণ, তরুণী, মহিলা, পুরুষকে দেখি তারা পণ্য কিনে কোন রসিদ না নিয়ে চলে যাচ্ছে। তখন তাদের আমি এই বিষয়গুলো না বলে পারি না। সে সঙ্গে ইনকামট্যাক্স দেয়া থাকলে উপার্জন যে শুদ্ধ হয়, তাও জানাই। আজ পর্যন্ত একজনকেও পাইনি যে এ বিষয়গুলো বোঝে। নাগরিকের এই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব উপলব্ধি করে! এই অবহিতকরণের কাজটিও গণশুনানির মাধ্যমে হতে পারে। আয়করের জন্য যেমন ‘ওপেন হাউস ডে’, আয়কর সপ্তাহ উদ্যাপন করা হয়, তার সঙ্গে সরকার আয়কর, ভ্যাট দিয়ে রাষ্ট্রীয় তহবিল তৈরি করে জনগণকে যে সবরকম নাগরিক সেবা প্রদান করে, সেসব তথ্যও অন্তর্ভুক্ত করে প্রচার করা জরুরী। এই প্রচারটি অতি গুরুত্বপূর্ণ। প্রচার না থাকায় ব্যাংক যে আমানতের ওপর বার্ষিক একটি শুল্ক দীর্ঘদিন যাবত কর্তন করে এ তথ্য অধিকাংশ আমানতকারী জানে না বলে এবার বাজেটে আমানতের ওপর শুল্ক হার শুনেই সবাই রে রে করে উঠেছে। যা ইংল্যান্ডে ব্রেক্সিট হবার পর সমস্ত ইংল্যান্ডবাসী ভোটাভুটি হয়ে যাবার পর বিমূঢ় হয়ে বলেছে ‘ব্রেক্সিট’ জিনিসটা আসলে কি, অনেকটা এরই মতো? যাই হোক, আমরা যারা অবসরপ্রাপ্ত, সঞ্চয়পত্রের সুদের ওপর নির্ভর করে জীবন ধারণ করি, তাদের প্রধানমন্ত্রী রক্ষা করেছেন। তবে, মনে করি, সরকারীর পাশে বেসরকারী খাতেরও অবসরপ্রাপ্ত পেশাজীবীদের জন্য অবসর ভাতা এবং সঞ্চয়পত্রের সুযোগ রাখা হলে ভাল হয়। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা যদি আমাদের গৃহকর্মী, যারা কমপক্ষে পাঁচ বছর আমাদের পরম সেবা দিয়েছে, যার কারণে আমাদের পক্ষে চাকরি করা সম্ভব হয়েছে, তাদেরকে যদি একটা পেনশন দিতে পারতাম, তাহলে কি ভালই না হতো! আমরা কেউ কেউ তাদের কারও পুত্র, ভাইকে কোন চাকরিতে দিতে পেরেছি। কিন্তু বেশিরভাগকে তেমন প্রতিদান দিতে পারিনি, তাদের মাসিক না হলেও, ত্রৈমাসিক একটা অর্থ দিতে পারলে তাদের বৃদ্ধ বয়সে সামান্য সেবা পৌঁছে দিতে পারতাম। বাড়ি করার সময়, মেয়ে বিয়ে দেবার সময় আমরা কেউ কেউ কিছুটা করেছি হয়ত, কিন্তু তাতে আমাদের ঋণ শোধ হয় না। যাই হোক, আমরা জানি, নিশ্চয় আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরাও জানেন যে, বর্তমান সরকারের এই শেষ দুই বছরে দেশী-বিদেশী মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্র অনেক রকম ষড়যন্ত্র সংঘটন করবে, বহুরকম ‘সূচক’ আবিষ্কৃত হবে এবং তাতে অবধারিতভাবে বাংলাদেশ সবচাইতে মন্দ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করবে। সুইস্ ব্যাংকেও দেখা যাচ্ছে কালো টাকা পাচারে এবারের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্তানের ওপরে! গুম, খুন-এর জন্যও বর্তমান সরকার ও এর নিরাপত্তা বাহিনী মন্দ স্কোর করেছে। অবশ্য ২০০১-২০০৬ এ জামায়াত-বিএনপি- বাংলা ভাইদের জঙ্গীদের যৌথভাবে পরিচালিত আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধপন্থী নির্মূলের নামে হাজার হাজার হিন্দু, আদিবাসী, বৌদ্ধ, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী গুম, খুন হয়েছিল, সেই সম্পর্কে হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ্ কেন অন্ধ হয়েছিল, এ প্রশ্ন জনগণের মনে না উঠে পারে না। প্রকাশ্য দিবালোকে বিএনপি নেত্রীর অফিসে অবস্থান ও পেট্রোল বোমা মেরে প্রায় দুই শ’ চালক, হেলপার, যাত্রী, নারী, পুরুষ, তরুণ, কিশোর হত্যার পরও বিদেশী কূটনীতিক, মানবাধিকার সংস্থা কেন নীরব, তা দেখে বিস্মিত না হয়ে পারি না। তবে, বাংলাদেশ ব্যাংক গবর্নরকে বলব, সুইস্ ব্যাংকের এই তথ্য প্রকাশ পাবার পর তাকে অবশ্যই বাংলাদেশী আমানতকারীদের বিষয়ে তথ্য এবং তালিকা চেয়ে দ্রুত পত্র দেয়া উচিত হবে। সরকারেরও এ বিষয়ে সত্যতা জনগণকে জানানোর দায়িত্ব নিতে হবে এবং সত্য প্রকাশে বর্তমান সরকার কোন সংকোচ করবে না- জনগণ এটিই চায়। বলা যায় না, সুইস্ ব্যাংকের তথ্যের মধ্যেও ষড়যন্ত্র থাকা অসম্ভব কিছু নয়। লেখক : শিক্ষাবিদ
×