ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাগদাদির মৃত্যু ইসলামোফোবিয়া এবং অস্ত্রবাণিজ্য

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ১৯ জুলাই ২০১৭

বাগদাদির মৃত্যু ইসলামোফোবিয়া এবং অস্ত্রবাণিজ্য

সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক শিবিরে ধস নামার পর কমিউনিজমোফোবিয়া অবসানের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে জাগিয়ে তোলা হয় ইসলামোফোবিয়া, ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ’ ঘোষণার মধ্য দিয়ে যার সূচনা। ইসলামিক স্টেটের স্বঘোষিত খলিফা আবু বকর আল বাগদাদির মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কি এর অবসান হলো? না। আশ্বস্ত হওয়ার কিছু নেই। আইএস-এর প্রয়োজন হয়ত ফুরিয়েছে তাই বাগদাদি নিহত হয়েছে। শীঘ্রই হয়ত মঞ্চে আসছে নতুন নামের নতুন কোন বাহিনী। অথবা হতে পারে আইএস-এরই সংস্কার, পরিমার্জন হবে। একটা কিছু হতেই হবে। নইলে অস্ত্র অর্থনীতির গতি প্রকৃতি ঠিক থাকবে কী করে? আরব দেশগুলোর তেল ভা-ারের কর্তৃত্বেরইবা কী হবে? এদিকে চীন হয়ে দাঁড়িয়েছে মাথাব্যথার আরেক কারণ। মধ্যপ্রাচ্যের তেল খনিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ পশ্চিমা দেশগুলোর একক আধিপত্যে তারা নাক গলাতে শুরু করেছে। দু’হাজার চৌদ্দর জুনে তেলের দাম ব্যারেলপ্রতি একশ’ নয় ডলার থেকে একশ’ পনেরো ডলার পর্যন্ত বেড়ে নবেম্বরের মধ্যে পঁচাশি ডলারে এসে স্থির হয়, যা ছিল কয়েক বছরের মধ্যে অস্বাভাবিক রকম কম দাম। তেলের বাজারে এই বড় ধরনের দরপতন হয়েছিল আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা ও সরবরাহের জন্য নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিম্নগামী অর্থনীতির জন্য জরুরী ছিল তাই। আর এতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মাসতুতো ভাই সৌদি আরব এবং তার বলয়ের আরব দেশগুলোর। অবশ্য রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী অভিযোগ করেছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ও তার পরিবার সিরিয়া এবং ইরাকের তেল পাচারের সঙ্গে জড়িত। আর এ কাজে তাদের সহযোগী ছিল আইএস সদস্যরা। যুদ্ধ ও সন্ত্রাসী কার্যক্রমের ব্যয় মেটানোর জন্য তারা কম দামে তুরস্কের কাছে তেল পাচার করত। যা হোক, তেলের বাজারের এ নিম্নগতির সুবিধা শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, চীনও ভোগ করছে। স্বাভাবিকভাবেই এটা মার্কিনীদের কাছে ভাল লাগার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে চীন রাশিয়া ও ইরানের সহযোগিতায় মধ্যপ্রাচ্যে বাণিজ্যিক প্রভাব বিস্তার করেছে। তেলের বাজারে ধারাবাহিক নিম্নগতিতে আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে কাতার। কাতার আরবের অন্যতম তেল ও গ্যাস উৎপাদন এবং রফতানিকারী দেশ। ক্ষতি পোষাতে তারা ভিন্ন পথ বেছে নেয়। পারস্য সাগরের তলায় বিশ্বের বৃহত্তম গ্যাস ক্ষেত্রটির যৌথ মালিকানা কাতার ও ইরানের। কাতার ইরানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন করে পাইপলাইনে গ্যাস নিয়ে ইরান থেকে এশিয়ায় রফতানি করার পরিকল্পনা করছিল। এশিয়ায় তাদের মূল ক্রেতা চীন। অনেকে বলছেন কাতার চীনের কাছে মার্কিন ডলারে নয়, চীনা মুদ্রায় গ্যাস রফতানির কথা ভাবছিল। মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘদিন মার্কিন বলয়ে থাকা কাতারের এমন মৃদু পিঠটান যুক্তরাষ্ট্রের ভাল লাগার কথা নয়। ভাল লাগছে না তাদের আরও অনেক কারণে। যেমন কাতার ফিলিস্তিনে হামাসকে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। হামাসের কার্যালয় দামেস্ক থেকে এখন দোহায়। মিসরে ইসলামী ব্রাদার হুডকেও সহযোগিতা করছে তারা। কাতার এবং সুইস বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান গ্লেনকোর যৌথভাবে রাশিয়ার তেল কোম্পানি রস্নেফ্টের বিশ পার্সেন্ট শেয়ার কেনার ঘোষণা দিয়েছে, যা রাশিয়ার জন্য লাভজনক। এসব কারণে রুষ্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব। সৌদি আরব কিছুদিন আগে রিয়াদে অনুষ্ঠিত আরব-ইসলামিক আমেরিকার সম্মেলনের পর পরই কাতারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন এবং অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করে। সৌদি বলয়ের প্রতিবেশী অন্য আরব দেশগুলোও একই পথ অনুসরণ করেছে। কাতারকে নিজ বলয়ের বাইরে বিরোধী শিবিরে ঠেলে দেয়ার প্রচ্ছন্ন অর্থ হতে পারে তার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধ প্রস্তুতি। ইরান একে সেভাবেই দেখছেÑ কাতারের তেল গ্যাস খনি দখলের জন্য সৌদি আরবের যুদ্ধ প্রস্তুতি। ইয়েমেনে শিয়া মতাবলম্বী হুতি, লেবাননে হিজবুল্লাহ, সিরিয়ায় বাশার আল আসাদকে সহযোগিতা দেয়ার জন্য ইরান নিজেও যুদ্ধ হুমকিতে রয়েছে। সত্যি বলতে মধ্যপ্রাচ্যে সব সময়ই যুদ্ধ প্রস্তুতির মাঠ জরিপ চলে। আরব-ইসলামিক আমেরিকা সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন বলেছিলেন ‘সৌদি আরবের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণে আলোচনা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে ওয়াশিংটন। এ ব্যবসার অন্যতম যে অস্ত্র ব্যবসা তা কাউকে বলে বোঝানোর দরকার নেই। মার্কিন-সৌদি আরব অস্ত্র বাণিজ্য চুক্তি তো হয়েই আছে শিয়া-সুন্নি দ্বন্দ্বকে পুঁজি করে মধ্যপ্রাচ্যে জমজমাট যুদ্ধবাণিজ্য আরও দীর্ঘকাল চলবে নিঃসন্দেহে। ওদিকে দু’হাজার আট থেকে এক দশক পর্যন্ত ইসরাইলকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তিরিশ বিলিয়ন বা তিন শ’ কোটি ডলার সামরিক অনুদান বরাদ্দ করেছে। এক দশক পর থেকে অর্থাৎ দু’হাজার আঠারো থেকে তা হবে আটত্রিশ বিলিয়ন ডলার, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাজেটের শতকরা পাঁচ ভাগ। ইসরাইল নিজেও অস্ত্র উৎপাদন ও বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য অবস্থান তৈরি করেছে। ধরে নেয়া যায় এসবই প্রয়োগ হবে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত এবং সরাসরি যুদ্ধ ক্ষেত্রে। এবং নিশ্চিতভাবেই একের পর এক ক্ষেত্র তৈরি হতে থাকবে। সুতরাং আবু বকর আল বাগদাদি নিহত হওয়া কিংবা ইসলামিক স্টেটের আয়তন ছোট হয়ে আসায় কিছু আসে যায় না। পরবর্তী সিকোয়েন্স এলো বলে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর বিশ্ববাসী অনেক কুৎসিৎ দৃশ্য দেখেছে। তার মধ্যে একটি ছিল আরব-ইসলামিক আমেরিকান সম্মেলনে সৌদি বাদশাহর দেয়া ভোজসভা শেষে তরবারি উঁচিয়ে ট্রাম্পের উল্লাস প্রকাশ। কৌতুককর হলো তীব্র ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত ট্রাম্প তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফরটি করেছিলেন সৌদি আরবে। সেখানে তিনি ইরানের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন। তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসন বলেছেন, ‘সৌদি আরব ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে সাধারণ শত্রু হিসেবে দেখছে। আর এ শত্রুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ঘোষিত অভিযোগেই কাতারকে তারা বয়কট করেছে। পাশাপাশি মার্কিন-সৌদি বলয়ের অন্য দেশগুলোকেও শাসানো হয়েছে এই বলে যে, যদি কেউ মার্কিন নীতির বাইরে যায় তাহলে তাদের অবস্থাও ইয়েমেন বা কাতারের মতো হবে। আর সৌদি আরবের সংবাদ মাধ্যমগুলো বলছেÑ সৌদি আরব কাতারে আগ্রাসন চালালে জোর সমর্থন দেবে মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন। বাহরাইনে মার্কিন পঞ্চম নৌবাহিনীর ঘাঁটি রয়েছে। কাতার অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে সৌদি আরবের বশ্যতা সে মানবে না। কাতারের পাশে রয়েছে ইরান, তুরস্ক ও রাশিয়া। মার্কিন পৃষ্ঠপোষকতায় সৌদি আরবের উদ্যোগে কিছুদিন আগে তথাকথিত যে সন্ত্রাসবিরোধী জোট গঠিত হয়েছে কাতার তার সদস্য ছিল। দীর্ঘকাল বশ্যতা স্বীকার করে চলার পর কাতারের এই ঘাড় গোঁজ করে থাকায় বিশ্বে মার্কিন একক আধিপত্যের প্রতি ছোটখাটো আরেকটি জিজ্ঞাসা চিহ্ন আঁকা হলো। বিশেষ করে তথাকথিত জঙ্গী গোষ্ঠীকে অর্থ সরবরাহ বন্ধ করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও কাতারের মধ্যে যখন আগেই একটি সমঝোতা চুক্তি হয়েছে। কাতার সঙ্কট কাটাতে রেক্স টিলারসন গত তিন-চারদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্য সফর করছেন। ক’দিন আগেও তিনি সফরে এসেছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ তেমন কিছুই হচ্ছে না। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মন্ত্রী নোরা আল কাবি বলেছেন, ‘দু’ হাজার তেরো ও চৌদ্দতে কাতার দু’বার চুক্তি করে এবং সম্পূরক আরও একটি চুক্তিও হয় যেখানে সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদকে ঠেকানোর লড়াইয়ের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সবই ছিল মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। তাই আমরা তাদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছি।’ টিলারসন আসা-যাওয়া করছেন কিন্তু সৌদি জোট এবং কাতার দুইই অনড়। সুতরাং ফলাফল সহজেই অনুমেয়। তবে কে আগে আক্রান্ত হবে ইরান না কাতার সেটা এখনই বলা যাচ্ছে না।
×