ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

সবাই স্বপ্ন দেখছে সুস্থ জীবন ফিরে পাবে মেয়েটি

এতদিন পর জানা গেল মুক্তামণি ‘লিমফেটিক মেলফরমেশনে’ আক্রান্ত

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ১৯ জুলাই ২০১৭

এতদিন পর জানা গেল মুক্তামণি ‘লিমফেটিক মেলফরমেশনে’ আক্রান্ত

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ যমজ দুই বোন হীরামণি ও মুক্তামণি। হীরামণি আধা ঘণ্টার বড়। সে সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক। চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রী হীরামণির জীবন কাটে হেসেখেলে। কিন্তু মাত্র আধা ঘণ্টার ছোট মুক্তামণি বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে পার করেছে ১০ বছর। কারণ, তার জীবন স্বাভাবিক নয়। মাত্র দেড় বছর বয়সেই একটি বিরল রোগ তার শৈশব কেড়ে নিয়েছে। মুক্তামণির শরীরের চেয়ে তার ডান হাত অনেক মোটা। হাত দেখলে মনে হয় বয়স্ক গাছের অংশ। ওপরটা দেখতে ঠিক গাছের বাকলের মতো। মুক্তামণি তার হাত নিয়ে নড়াচড়া করতে পারে না। অন্যের ওপর নির্ভরশীল সে। সাড়ে নয় বছর বয়সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ওঠার পর হাতে অজানা রোগ বাড়তে থাকায় তার লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকেই মুক্তামণি হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরছে। এখনও সে হাসপাতালে ভর্তি। বর্তমানে মুক্তামণি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রয়েছে। ১৭ জুলাই ঢামেকে গিয়ে দেখা যায়, মুক্তা হাসপাতালের বিছানায় বসে আছে। তার ব্যান্ডেজ করা ডান হাতটি একটি বালিশের ওপরে রাখা। হাতটির ওজন শরীরের থেকে বেশি হওয়ায় মুক্তামণি নিজে নড়াতে পারছে না। প্রয়োজনে তার বাবা ও মা তাকে বিছানা থেকে নেমে হাঁটতে সাহায্য করেন। অন্যদিকে, হীরামণি হাসপাতাল চষে বেড়াচ্ছে। কিন্তু মুক্তামণির সে সক্ষমতা নেই। সে শুধু অসহায়ের মতো মায়াবী চোখে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে সবকিছু দেখছে। মুক্তামণি বলে, হাতে চুলকায়, যন্ত্রণা হয়। একা নাড়াতে পারি না। খুব ব্যথা লাগে। খুব ইচ্ছে করে বোনের সঙ্গে খেলা করতে, স্কুলে যেতে। ডাক্তার বলছে আমি ভাল হয়ে যাব। তারপর আমিও খেলাধুলা করতে পারব। স্কুলে যেতে পারব।’ এদিকে, মুক্তামণির বিরল রোগের বিষয়ে ডাক্তাররা প্রাথমিকভাবে বহুল চর্মরোগ হিসেবে আখ্যা দিলেও বর্তমানে রোগটি শনাক্ত করা হয়েছে। রোগটির নাম ‘লিমফেটিক মেলফরমেশন’। জন্মের পরপরই রোগটির প্রকাশ ঘটে। তবে মুক্তামনিরটা প্রকাশ পেয়েছে তার জন্মের দেড় বছর পর। এটি একটি জন্মগত রোগ (কনজিনেটাল ডিজিস)। সোমবার মুক্তামণির প্রাথমিক মেডিক্যাল রিপোর্ট ডাক্তারদের হাতে এসেছে। মেডিক্যাল রিপোর্টের ফলাফল জানিয়ে সোমবার ডাঃ সামন্তলাল সেন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বেশ কয়েকটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর দেখা গেছে লিমফেটিক মেলফরমেশন রোগে আক্রান্ত মুক্তামণি। যদিও প্রাথমিকভাবে চিকিৎসকরা চারটি রোগের কথা ধারণা করেন। তাকে ইতোমধ্যে দুই ব্যাগ রক্ত, এক ব্যাগ প্লাজমা দেয়া হয়েছে। তাকে হাসপাতাল থেকে ডাবল ডায়েট দেয়া হচ্ছে। গত তিনদিনে মুক্তার রক্তের অনেকগুলো পরীক্ষা এবং ইউরিন টেস্ট হয়েছে। হয়েছে সিটিস্ক্যান, এমআরআই, ডুপ্লেক্স ও আলট্রাসনোগ্রাফি। সবগুলো রিপোর্টই ভাল আছে। আশা করছি, চলতি সপ্তাহের মধ্যেই মেডিক্যাল বোর্ড মুক্তামণির পরবর্তী চিকিৎসা নির্ধারণ করবে।’ কতদিনে মুক্তামণি সুস্থ হতে পারে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, মুক্তার চিকিৎসা সহজ হবে না। এটি নিঃসন্দেহে একটি দীর্ঘমেয়াদী চিকিৎসা। এখানে মূল দায়িত্ব প্লাস্টিক সার্জারির। এর সঙ্গে অর্থোপেডিক, মেডিসিন, ভাসকুলার সার্জারি টিম এরা সবাই জড়িত থাকবে। তবে এটা বলতে চাই, চিকিৎসা এক ধাপে চলবে না। ধাপে ধাপে সার্জারি করে তাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যাবে। মুক্তামণির চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডে ডাঃ সামন্তলাল সেন ছাড়াও আছেন ইউনিটের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদসহ আটজন। ১১ জুলাই মুক্তমণি ঢামেকের বার্ন ইউনিটে ভর্তি হওয়ার পর তার চিকিৎসার সকল দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই খবরটি লোকমুখে শুনেছেন মুক্তামণির বাবা ইব্রাহিম হোসেন। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘শুনেছি, প্রধানমন্ত্রী আমার মেয়ের চিকিৎসার দায়িত্ব নিয়েছেন। ডাক্তাররা বলেছেন, তারা দায়িত্ব নিয়ে মুক্তামণির চিকিৎসা করবেন। তবুও কিছু কিছু জিনিস আমরা বাইরে থেকে নিয়ে আসছি। এতে কিছু টাকা ব্যয় হচ্ছে। ইব্রাহিম হোসেন বলেন, ডাক্তাররা সবসময় মুক্তার খোঁজ নিচ্ছে। ঠিক সময়মতো হাতে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছেন। ভরসা দিচ্ছেন, আল্লাহর রহমতে ঠিক হয়ে যাবে।’ মুক্তার বাবা মোঃ ইব্রাহিম হোসেন একজন মুদি ব্যবসায়ী। তিনি জানান, তার তিন সন্তান। মুক্তামণি ও হীরামণি যমজ দুই বোন। ছোট ছেলে আল আমিনের বয়স ১ বছর ২ মাস। মুক্তার মায়ের নাম আসমা খাতুন। তারা সবাই এখন ঢামেকে আছেন। তাদের বাড়ি সাতক্ষীরার সদর উপজেলার দক্ষিণ কামারপাশা গ্রামে। মুক্তার মা আসমা বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, মুক্তার যখন দেড় বছর বয়স তখন তার হাতে ছোট একটি গুটির মতো বের হয়েছিল। সেই জায়গাটি সবসময় ব্যথা করত আর চুলকাত। সেই ছোটবেলা থেকে আমরা যেখানে যে ডাক্তার, কবিরাজ, ওঝা দেখাতে বলছে, যার কথা শুনেছি, তার কাছেই মেয়েকে নিয়ে গেছি। সাড়ে নয় বছর থেকে বাড়তে থাকে। তারপরও সিআরপি, পঙ্গু, পিজিসহ অনেক জায়গায় দেখানো হয়েছে। কেউ বলেছে, ক্যান্সার, কেউ বলেছে টিবি হয়েছে। কেউ বলেছে চর্ম রোগ। আবার কেউ চিকিৎসা করতে ব্যর্থ হয়েছে। কোন ডাক্তারই রোগ ধরতে পারেনি। রোগ শনাক্ত না করেই ওষুধ দিয়ে গেছে। তাই ছয় মাস আগে চিকিৎসা বন্ধ করে দেই। তবে বেশিরভাগ চিকিৎসকদের অবহেলা লক্ষ করেছি। কেউই দায়িত্ব নিয়ে চিকিৎসা করেনি, দায়সারা। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ডাক্তাররা সঠিক রোগনির্ণয় না করে চিকিৎসা করায় মুক্তার আজ এ অবস্থা। আমি মনি করি, এমন জায়গায় (ঢামেক) যদি প্রথমে আমার মেয়েকে নিয়ে আসতে পারতাম তাহলে এতদিনে আমার মেয়ে সুস্থ হয়ে যেত। তবে এখনও আশা ছাড়িনি। ডাক্তারদের সহযোগিতায়, আল্লাহর রহমতে ও আপনাদের দোয়াতে আমার মুক্তা ভাল হয়ে যাবে।
×