ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

২৫ কিলোমিটারে সময় লাগে ৩ ঘণ্টা, বাকি ৮০ কিলোমিটারে এক ঘণ্টা ১৫ মিনিট;###;রাস্তার দুপাশে ইচ্ছামতো পার্কিং;###;মহাসড়কে চলছে ধীরগতির ছোট গাড়ি

দুই ঘণ্টার পথ পাঁচ ঘণ্টায়

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ১৯ জুলাই ২০১৭

দুই ঘণ্টার পথ পাঁচ ঘণ্টায়

রাজন ভট্টাচার্য ॥ মাত্র ১১৬ কিলোমিটার সড়ক পাড়ি দিতে কত সময় লাগে? পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্বাভাবিক গতিতে বাস চললে ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটারের বেশি রাস্তা অতিক্রম করতে পারে। এই হিসাবে ১১৬ কিলোমিটার সড়ক যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টা। কিন্তু ঢাকা থেকে ময়মনসিংহগামী পরিবহনগুলো দুই ঘণ্টার রাস্তা অতিক্রম করছে প্রায় চার ঘণ্টায়। এর মধ্যে মহাখালী টার্মিনাল থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার সড়ক পাড়ি দিতে সময় লাগে তিন ঘণ্টার কাছাকাছি। বাকি প্রায় ৮০ কিলোমিটারের কিছু বেশি সড়ক অতিক্রম করে ময়মনসিংহ পৌঁছাতে সময় লাগে এক থেকে সোয়া ঘণ্টা। এমন দুর্ভোগ চলছে প্রায় এক বছর। প্রশ্ন হলো দুর্ভোগের কারণ নিয়ে। এদিকে প্রায় সাত মাসেও এ সড়কের উন্নয়ন কাজ শুরু করেনি চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মূল সমস্যা হলে টঙ্গী ব্রিজ থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত। এইটুকু সড়কে প্রতিদিন দুর্ভোগে নাকাল হতে হচ্ছে যাত্রীদের। এই অংশটুকু মহাসড়কের চরিত্র হারিয়েছে অনেক আগেই। আন্তর্জাতিক নিয়মানুযায়ী মহাসড়কের উভয় পাশে অন্তত ১০ মিটার খালি জায়গা থাকার কথা। কিন্তু এই সড়কের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত সড়কের দুই পাশে তিন মিটার জমিও ফাঁকা নেই। বালাই নেই কোন মানদ-ের। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পর্যন্ত অন্তত ১০টি পয়েন্টে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে, টঙ্গী ব্রিজের আগে আশুলিয়া-সড়ককে কেন্দ্র করে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার অভাব। মূলত এ কারণে সোজা পথে যানবাহনগুলোকে চলতে নানা ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়। এরপর মহাসড়কে অযান্ত্রিক ও নিষিদ্ধ যানবাহন চলাচল, সড়কের ওপর হাঁট বাজার, রাস্তার দুই পাশে অবৈধ টার্মিনাল, সড়কের ওপর ট্রাক ও ওয়াগন পার্কিং, ভাঙাচোরা সড়ক, ভোগড়া বাইপাস ও চান্দনা চৌরাস্তায় পরিবহন ব্যবস্থাপনার অভাব, ইচ্ছামতো গাড়ি পার্কিং, অবৈধ টার্মিনালের কারণেই এই ভোগান্তি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, টঙ্গী থেকে চান্দনা মোড় পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার মহাসড়কের বিভিন্ন স্থান ভেঙেচুরে ছোট বড় অসংখ্য খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে স্বাভাবিক গতিতে যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। এতে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টিতে সড়কে জলাবদ্ধতার কারণে যানজট সমস্যা আরও প্রকট রূপ ধারণ করেছে। আধা ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে সময় লাগছে ৩ ঘণ্টার বেশি। আর এ মহাসড়কের যানজটের চাপ ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-বাইপাস সড়ক পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। জানতে চাইলে মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম জনকণ্ঠকে বলেন, মহাখালী থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা যেতে সময় লাগছে এর চেয়ে তিন ভাগের এক ভাগ সময়ে সেখান থেকে ময়মনসিংহ যাচ্ছে বাসগুলো। মূল সমস্যা শুরু হয় টঙ্গী ব্রিজের আগে থেকেই। অথচ সমস্যা সমাধানে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে কিছুই করা হচ্ছে না। সড়কের দু’পাশে কোন ড্রেনেজ সিস্টেম না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতে রাস্তা ডুবে যাচ্ছে। গাজীপুর জেলা প্রশাসনকেও এসব বিষয়ে অবহিত করা হয়েছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না। ঢাকা ময়মনসিংহ রুটে চলা এনা ও সৌখিনসহ বিভিন্ন পরিবহন চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই রুটে নতুন সমস্যা হলো শিল্প কারখানা। ফোর লেন প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার পর পরই শিল্প স্থাপনের রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। সড়ক ঘেঁষে এসব প্রতিষ্ঠান হওয়ায় ইচ্ছামতো গাড়ি পার্কিং করে রাখা হয়। কোন কোন স্থানে এক লেনের বেশি সড়ক আটকানো থাকে। ভোরে বাস নিয়ে যাত্রা শুরু করলেও নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছানো সম্ভব হয় না। পাশাপাশি এই রুটে নসিমন, করিমন, ভটভটি, সাধারণ রিক্সা, ব্যাটারিচালিত নানা ধরনের রিক্সা, ইজিবাইক, অটোরিক্সা, ট্রাক্টরসহ স্বল্প গতির যানবাহন ইচ্ছামতো চলছে। বালু ও মাছবাহী ট্রাক, শিল্প পণ্যবাহী পরিবহন সবচেয়ে বেশি চলছে। এসব কিছুর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সড়কের ভাঙাচোড়া। জানা গেছে, গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী ব্র্রিজ পর্যন্ত ১২ কিলোমিটারের বেশি সড়ক উন্নয়ন কাজ বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছে। এজন্য গত বছরের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে এ সড়কটি কার্যাদেশ পাওয়া সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ ছয় মাস অতিবাহিত হলেও ঠিকাদার এখনও কোন উন্নয়ন কাজ শুরুই করতে পারেনি। এদিকে অতিবৃষ্টির কারণে এবং দীর্ঘদিন মেরামত না করায় মহাসড়কটির বিভিন্ন অংশ ভেঙেচুরে কার্পেটিং উঠে গিয়ে ছোট-বড় অসংখ্য খানাখন্দের সৃষ্টি হয়েছে। এতে মহাসড়কে যান চলাচলে মারাত্মক বিঘœ সৃষ্টি হচ্ছে। প্রায়ই কোন না কোন যান গর্তে আটকে বা ফেঁসে যাচ্ছে। ফলে যানজট আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। মহাসড়কে যানবাহনের অত্যধিক চাপ যানজট সৃষ্টির অন্যতম প্রধান কারণ। বিশেষ করে ঈদের আগে থেকে যানবাহনের চাপ দিন দিন বাড়তে থাকায় যানজট সমস্যা বর্তমানে মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। এতে যাত্রীসাধারণ অবর্ণনীয় দুর্ভোগের সম্মুখীন হচ্ছেন। পরিবহন মালিক, শ্রমিকসহ সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গাজীপুরের চান্দিনা চৌরাস্তার দক্ষিণ পার্শ্ব, বর্ষা সিনেমা হলের সামনে, ভোগড়া বাইপাস মোড়, বাসন সড়ক, ছয়দানা মালেকেরবাড়ি, সাইনবোর্ড, বোর্ডবাজার, বড়বাড়ি, তারগাছ, গাজীপুরা, হোসেন মার্কেট, কলেজ গেট, চেরাগআলী ও স্টেশন রোড এলাকাসহ বিভিন্ন স্থানে মহাসড়ক ভেঙ্গে গিয়ে কার্পেটিং উঠে গেছে। পানির নিচে খানাখন্দ দেখা না যাওয়ায় ঝুঁকি এড়াতে যানবাহনগুলোকে ধীরে চলতে হচ্ছে। ফলে চান্দনা চৌরাস্তা থেকে টঙ্গী ব্রিজ পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা অন্যত্র না ফেলে মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে জড়ো করে রাখে। সময়মতো তা অপসারণ না করায় ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে ছিটিয়ে মহাসড়কের পাশে ড্রেনে জমে গিয়ে ড্রেনগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত হতে না পেরে মহাসড়কে প্রায়ই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। উপরন্তু বিভিন্ন শিল্প কারখানা, মার্কেট ও ঘরবাড়ির ড্রেনের পানি প্রতিনিয়ত মহাসড়কে এসে পড়ছে, সৃষ্টি হচ্ছে খানাখন্দের। গাজীপুর জেলা ট্রাফিক পুলিশের এএসপি সালেহ আহমেদ জানান, মহাসড়ক মেরামতের জন্য সওজের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বার বার অনুরোধ করা হলেও তারা তেমন কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। গাজীপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিন রেজা জানান, মহাসড়কটি বিআরটির প্রকল্পের আওতায় উন্নয়ন কাজের জন্য গত জানুয়ারি মাসের শেষে কার্যাদেশ পাওয়া সংশ্লিষ্ট চীনা ঠিকাদারকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। এ কারণে গাজীপুর সড়ক বিভাগের এ মহাসড়কটি মেরামতের এশতিয়ার নেই। তবে টঙ্গী ব্রিজ থেকে চেরাগআলী মার্কেট পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার মহাসড়ক মেরামতের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে বিআরটি প্রকল্পের পরিচালক সানাউল হক জানান, মহাসড়কে জমে থাকা পানি অপসারণ এবং গর্তগুলো ইটের খোয়া দিয়ে ভরাট করা হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে এ মুহূর্তে রাস্তায় কার্পেটিং করা সম্ভব হচ্ছে না। টঙ্গী থেকে চান্দনা চৌরাস্তা পর্যন্ত মহাসড়কের পাশে উন্নতমানের ড্রেন তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এতে বৃষ্টির পানি মহাসড়কে না জমে দ্রুত বের হয়ে যেতে পারবে। ঢাকার যানজট নিরসনে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর রুটে দেশের প্রথম বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণে চীনের একটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। চীনের গেৎহুবা গ্রুপ ৮৫৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকায় ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এ প্রকল্পের জন্য ১৬ কিলোমিটার বিআরটি লেইন, ৩২ কিলোমিটার ফুটপাথ ও ধীরগতির যানবাহন চলাচলের জন্য আলাদা লেন নির্মাণ করে দেবে। গত বছরের ডিসেম্বরে চুক্তির পর কথা ছিল আগামী ৩০ মাসের মধ্যে এ নির্মাণ কাজ শেষে উভয় দিক থেকে ঘণ্টায় ২৫ হাজার যাত্রী পরিবহন সম্ভব হবে বলে আশা করছে সরকার। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য হবে ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার। এর মধ্যে উত্তরা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত সাড়ে চার কিলোমিটার এলিভেটেড বিআরটি লেন থাকবে। বাকি ১৬ কিলোমিটার থাকবে সমতলে। নির্মাণ করা হবে ছয়টি ফ্লাইওভার। দুই প্রান্ত গাজীপুর ও বিমানবন্দরে থাকবে দুটি টার্মিনাল, আর মাঝের পথে হবে ২৫টি স্টেশন। মূল নির্মাণের পাশাপাশি কিছু সড়ক প্রশস্তকরণ, সার্ভিস সড়ক ও গাজীপুরে তিন কিলোমিটার ড্রেনেজ নির্মাণ, আট লেইনের টঙ্গী সেতু ও ফ্লাইওভার নির্মাণের খরচ মিলিয়ে এই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে মোট ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা। সরকারের পাশাপাশি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসি দাতা সংস্থা (এএফডি) ও গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (জিইএফ) এতে অর্থায়ন করছে।
×