ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

গৃহকর্মী আদুরি নির্যাতন মামলায় যাবজ্জীবন কারাদ- হলো নির্যাতনকারী গৃহবধূ নওরীন জাহান নদীর;###;এ রায়ের পরে দেশে এই গৃহকর্মী নির্যাতনের মতো জঘন্য ঘটনা কমবে, আশা পর্যবেক্ষক মহলের

দৃষ্টান্তমূলক রায়

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ১৯ জুলাই ২০১৭

দৃষ্টান্তমূলক রায়

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রায় চার বছর আগে মিরপুরের পল্লবীতে নির্মম নির্যাতনের পর শিশু গৃহকর্মী আদুরিকে মৃত ভেবে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়ার ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছিল। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ওই আদুরির মামলার রায়ে গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদীকে যাবজ্জীবন কারাদ- ও এক লাখ টাকা জরিমানার আদেশ দিয়েছেন ঢাকার তিন নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জয়শ্রী সমাদ্দার। জরিমানার অর্থ আদায়ের পর তা নির্যাতিত কিশোরী আদুরিকে দিতে হবে। আর জরিমানা দিতে ব্যর্থ হলে আরও এক বছরের কারাদ- ভোগ করতে হবে নদীকে। নদীর মা ইশরাত জাহানও এ মামলার আসামি ছিলেন। অপরাধে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় তাকে খালাস দিয়েছেন বিচারক। জামিনে থাকা ইশরাত জাহান রায়ের জন্য এদিন আদালতে উপস্থিত হয়েছিলেন। আর তার মেয়ে নদীকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। রায়ের পর যাবজ্জীবন কারাদ-ে দ-িত নদীকে ফিরিয়ে নেয়া হয় কারাগারে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে গহকর্মীর ওপর নির্যাতন আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেলেও অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থাকছিল। গৃহকর্মী আদুরির মামলায় অপরাধী গৃহকর্ত্রী নদীর যাবজ্জীবন শাস্তি দেশের মানুষকে সঠিক বিচার পাওয়ায় আশান্বিত করছে। এ রায় বাস্তবে দৃষ্টান্তমূলক। ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকার একটি ডাস্টবিন থেকে ১১ বছর বয়সী আদুরিকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, তার গৃহকর্ত্রী পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের ২৯/১, সুলতানা প্যালেসের দ্বিতীয় তলার বাসিন্দা নদী আগের দিন ধারালো চাকু দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে, ইস্ত্রি দিয়ে ছ্যাঁকা দিয়ে মারাত্মক জখম করে মেয়েটিকে সেখানে ফেলে রাখেন। এর পর আদুরিকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়, গঠন করা হয় উচ্চপর্যায়ের মেডিক্যাল বোর্ড। তখন চিকিৎসকরা জানান, আগুনের কারণে চামড়া কুঁচকে যাওয়া এবং থেঁতলে যাওয়া মাংসসহ আদুরির মাথা থেকে পাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় জখমের চিকিৎসা করা হচ্ছে। মঙ্গলবার রায় ঘোষণার সময় দ-িত কাটনারপাড়া বগুড়ার আশরাফুল আমীন খালেদের মেয়ে নদীকে কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় এবং জামিনে থাকা ইশরাত জাহান ট্রাইব্যুনালে হাজির হন। এ সময় গৃহকর্মী আদুরি ও তার মা সাফিয়া বেগমও ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। রায় ঘোষণার পর দ-িত নদী ও তার মা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। অন্যদিকে, ভিকটিম আদুরি ও তার মা ন্যায়বিচার পেয়েছেন বলে জানান। রায় ঘোষণার পর সাফিয়া বেগম বলেন, ‘আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা সঠিক বিচার পাইছি। তয় ছেলেমেয়ে নিয়ে অনেক কষ্টে আছি। ধার-দেনা করে আদুরির চিকিৎসা করাইতে হচ্ছে।’ মামলার রায় জানতে মঙ্গলবার মা সাফিয়া বেগমের সঙ্গে আদালতে এসেছিল আদুরি। চার বছর আগের ওই নির্যাতনের স্মৃতি এখনও দুঃস্বপ্ন হয়ে কিশোরী আদুরির ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। শরীরে যেসব জায়গায় নির্যাতন করা হয়েছিল, এখনও মাঝেমধ্যে সেসব জায়গায় ব্যথা হয়, চুলকায়। পটুয়াখালী সদর উপজেলার কৌরাখালী গ্রামের প্রয়াত খালেক মৃধার সপ্তম কন্যা আদুরি এখন পরিবারের সঙ্গেই থাকে। সম্প্রতি পাশের গ্রাম পূর্ব জৈনকাঠীর একটি মাদ্রাসার তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে সে। এদিকে, রায় নিয়ে ভিকটিমের পক্ষে আইনী সহায়তা দেয়া বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক এ্যাডভোকেট সালমা আলী ও রাষ্ট্রপক্ষে বিশেষ পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদা আক্তার সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘এ রায় একটা দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।’ তবে আসামিপক্ষের আইনজীবী মোঃ গাইফুর রহমান রায় নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, উচ্চ আদালতে আপীল করবেন। এর আগে গত ৯ জুলাই মামলাটিতে যুক্তিতর্কের শুনানি শেষ হওয়ার পর রায় ঘোষণার এ দিন ঠিক করে ট্রাইব্যুনাল। যুক্তিতর্ক শুনানির আগে ট্রাইব্যুনাল ১৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করে বলে জানান বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির এ্যাডভোকেট ফাহমিদা আক্তার রিংকি। আদুরির মা সাফিয়া বেগম মেয়ের সঙ্গে ঘটে যাওয়া বীভৎস ঘটনা প্রসঙ্গে বলেন, কয়েক বছর আগে স্বামী মারা গেলে নয় ছেলেমেয়েকে নিয়ে বিপদে পড়েন। তখন এলাকার চুন্নু মীর ঢাকায় তার শ্যালক সাইফুল ইসলাম মাসুদের বাসায় মাসিক ৫০০ টাকা বেতনে আদুরিকে কাজ দেয়ার প্রস্তাব করলে তিনি রাজি হন। ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আদুরিকে ডাস্টবিন থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধারের তিন দিন পর পল্লবী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন আদুরির মামা নজরুল চৌধুরী, যিনি একটি ভবনের নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কাজ করেন। মামলার এজাহারে গৃহকর্ত্রী নদী, তার মা ইশরাত জাহান, স্বামী সাইফুল ইসলাম মাসুদ এবং তাদের আত্মীয় চুন্নু মীর ও মোঃ রনিকে আসামি করা হয়। হাকিমের কাছে নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ২২ ধারায় দেয়া জবানবন্দীতে আদুরি বলে, গৃহকর্ত্রী নদী তাকে দিনে একবেলা খেতে দিতেন, তাও মুড়ি। মাঝেমধ্যে ভাত দিতেন, তাও শুধু লবণ কিংবা মরিচ দিয়ে। থাকতে দিতেন বেলকনিতে। আর নির্যাতন চলত অহরহ। প্রায়ই গরম ইস্ত্রি দিয়ে ছ্যাঁকা দেয়া হতো শরীরের বিভিন্ন স্থানে। ব্লেড দিয়ে গাল কেটে একবার সেখানে আগুনও দেয়া হয়েছিল। ভয়ে এ নির্যাতনের কথা কাউকে বলতে পারেনি আদুরি। মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর ওই বছরের ১ অক্টোবর দোষ স্বীকার করে হাকিমের কাছে জবানবন্দী দেন নদী। তার ভাষ্য ছিল, সংসারে আর্থিক টানাটানিতে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন তিনি। আদুরি কোন কাজে ভুল করলে তার খুব রাগ হতো। ব্লেড দিয়ে শরীরে পোচ দেয়া এবং গরম ইস্ত্রির ছ্যাঁকা দেয়ার কথাও ওই জবানবন্দীতে নদী স্বীকার করে নেন।
×