ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ফটোগ্রাফির নাম্বার ওয়ান

প্রীত রেজা

প্রকাশিত: ০৬:০৭, ১৮ জুলাই ২০১৭

প্রীত রেজা

ডিপ্রজন্ম : প্রীত রেজা সম্পর্কে জানতে পাঠকদের বেশ আগ্রহ। জানতে চাই প্রীত রেজার পাঠকের তারকা হয়ে উঠার পেছনের গল্প... প্রীত রেজা : আমি মূলত ফটোজার্নালিস্ট হওয়ার স্বপ্ন দেখতাম। খুব ছোটবেলার কথা দিয়ে শুরু করা যাক, নোয়াখালীর মাইজদির মধ্যবিত্ত পরিবার আমাদের। বাবা পেশায় ব্যাংকার, একমাত্র বোনের শাড়ি পরে ছবি তোলার বেশ শখ। স্বভাবতই একমাত্র ভাই হিসেবে ফটোগ্রাফির গুরু“দায়িত্ব পড়ে আমার উপর। বলতে পারেন সেখানেই শুরু, ঢাকায় এলাম দেখলাম বড় সাইনবোর্ডে ‘চঞ্চল মাহমুদ ফটোগ্রাফি’ বেশ আগ্রহ থাকলে ক্যামেরা না থাকায় হলো না কিছু, ঠিক সে সময়টি আমার জন্য আশীর্বাদ হয়ে এসেছিল ঢাকা ফটোগ্রাফি ইনস্টিটিউটের ৫০০ টাকার একটি কম্পিউটার বেসিক কোর্স, তখনই বুঝলাম ক্যামেরা আমার লাগবেই! যেই কথা সেই কাজ, কিনে ফেললাম জমানো অর্থে সেকেন্ড হ্যান্ড নিকন এ৪এক্স, যার দাম পড়েছিল প্রায় ১৬ হাজার টাকা। বলতে পারেন, খুব মন থেকে ছবি তুলতেই ভালবাসি আমি। এরপর ঢাবিতে নিজের ক্যাম্পাসে ২০ টাকায় ছবি তোলা শুরু করি প্রিন্টসহ। বন্ধুদের মুখে শুনি হতাশার বাণী, ‘বিশটাকার ফটোগ্রাফার’ ওরা বলত, টাকার দরকার হলে টিউশন করা। তখন বলতে পারিনি, আজ বলি সেদিন বিশটাকার ছবিগুলো ছিল ক্যামেরাকে ভালবেসে তোলা। সেজন্যই আজ আমি এখানে। এরমধ্যে ফটোজার্নালিজমে কাজ শুরু করি, সুযোগটা দেন ‘আজকের কাগজ’ পত্রিকায় দলছুটের ম্যানেজার ‘শাহান কবন্দ’, ২০০৩ এ ইত্তেফাকে কাজ করা হয়েছে। এর মাঝে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আপুর বিয়েতে প্রথমবারের মতো ছবি তুলি, যদিও তখন এমনি তুলেছিলাম ছবিগুলো তবে ওয়েডিং ফটোগ্রাফির প্রতি এক ধরনের ভালবাসা জন্মে যায়। তবে আমি খেয়াল করতে লাগলাম, মানুষের মুখের বাজে কথা ‘বিয়ার ছবি তোলে’। এগুলো পেরিয়ে সিদ্ধান্ত নেই সামনে এগিয়ে যাবো। আর বড়ভাবে আলোচনায় আসা হয়েছে দেশের প্রথম ওয়েডিং ফটোগ্রাফি এক্সিবিশনের আয়োজন করেছিলাম আমি। এভাবেই শুরুটা মূলত। ডিপ্রজন্ম : ব্যক্তি প্রীত রেজা ভালবাসেন কোন ধরনের আলোকচিত্রীকে এবং কেমন ধরনের কাজকে? প্রীত রেজা : আমি নিজে ভালবাসি প্রোট্রেট ফটোগ্রাফি। তবে ভালবাসি সেসব তরুণ ফটোগ্রাফারদের যারা নিজেদের বাইরে গিয়ে পুরো ইন্ডাস্ট্রির জন্য কাজ করেন, আর উদাহরণ দিতে গেলে যার নাম বলব তিনি দৃকের প্রতিষ্ঠাতা শহিদুল আলম। তাদের মতো আলোকচিত্রীদের জন্য শ্রদ্ধা সবসময়। আমি এখনও প্রতিনিয়ত শিখছি। ডিপ্রজন্ম : আলোকচিত্রী থেকে তরুণদের আইকন। প্রীত রেজা : বিষয়টিকে খুব উপভোগ করি। আমি ছোট পরিবর্তনে বিশ্বাসী। এসব পরিবর্তনের কথা বলতে প্ল্যাটফর্ম দরকার, সেজন্যই ভাললাগা তৈরি হয়েছে সম্পূর্ণ দায়িত্ববোধ থেকেই। তরুণদের মধ্যে একটা বিশ্বাস তৈরি করাতে চাই ‘তোমাকে দিয়ে হবে।’ আমার পছন্দের শব্দটি হলো ‘না’। যেখানে না, সেখানেই হ্যাঁ বানাতে আমি হাত তুলব। আমি প্রচুর কর্মশালা করাই, আমি রেডিও এবং টিভিতে দেশের প্রথম ফটোগ্রাফি শো করছি, আর জানা মতে উপমহাদেশের একমাত্র টিভি শো ফটোগ্রাফিভিত্তিক, যেটা আমি পরিচালনা করি। ডিপ্রজন্ম : এ পর্যন্ত প্রীত রেজার অর্জনগুলো- প্রীত রেজা : আমার সবচেয়ে বড় অর্জন ‘পিপল লাভস মি’। এটাকে ধরে রাখতে চাই। আমি ফুজিফিল্মের এ্যাম্বাসেডর। বাংলাদেশী ফটোগ্রাফারদের মধ্যে প্রথম এ্যাম্বাসেডর আমি। ইউএস ডিপার্টমেন্টের একমাত্র প্রফেশনাল ফেলো, এমপিএ ঘোষিত দেশের প্রথম মস্টার ফটোগ্রাফার, ফটোফি এর ফটোগ্রাফার অফ দ্য ইয়ার, ২০১২ তে বেস্ট ওয়েডিং ফটোগ্রাফার, নিউ এইজের ইয়াং আইকন, ‘বেঙ্গলবারত’ ম্যাগাজিনটির চারটি সংখ্যার ফটো এডিটর, ফটোগ্রাফার এবং সামাজিক উদ্যোক্তাদের এক প্ল্যাটফর্মে আনতে দেশের ৬৪টি জেলা থেকে একজন করে নিয়ে ‘ফটোপ্রিনিউরস’ প্রতিষ্ঠা করা, ডচচঅ এর ২০১৪ এর সম্মেলনে আন্তর্জাতিক বক্তা, আমেরিকায় একক ছবির প্রদর্শনী হয়, কাউন্টার ফটোর ফ্যাকাল্টি হিসেবে আছি আর আমার প্রাণের জায়গা ‘ওয়েডিং ডায়েরি’ এর সিইও হিসেবে আছি। আপনি কিভাবে নেবেন জানি না, ইউএসএর ৩৯তম পেসাও আর্ট ফেস্টিভালে আমার তোলা ছবির জন্য আমাকে জানানো হলো ‘ফটোগ্রাফার অফ দ্য ইয়ার’ মনোনীত করা হচ্ছে, আমি তো অনেক খুশি। তবে রাতে ঘুমানোর আগে নিজেকে প্রশ্ন করলাম, পুরস্কারটি যে ছবির জন্য সেটা বাংলাদেশের মানুষের দরিদ্রতাকে সারাবিশ্বের সামনে তুলে ধরে। আরে এ তো আমার দেশকে ছোট করবে, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলাম পুরস্কার নেব না! যেই কথা সেই কাজ, জানিয়ে দিলাম। তারা তো অবাক, কত অনুরোধ। সে বছর পেলাম না পুরস্কার, তবে যে শান্তি আমি পেয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। ডিপ্রজন্ম : আপনার সবচেয়ে পছন্দের ফটোশুট এযাবতকালের কোনটি। যেটি করে নিজেকে সার্থক মনে হয়েছে- প্রীত রেজা : হুম। এটা তো চিন্তার বিষয়। সাকিব মুশফিকের শুট খুব ভাল ছিল আমার জন্য। কিন্তু সবচেয়ে ভাল লেগেছিল আমার প্রথম শুট। ব্যাংকক এ করেছিলাম শুটটা। থাই কন্যা আর ইউকে বরের সুন্দর জুটিতে মুগ্ধ হয়েছিল ব্যাংকক। অনেক ইন্টারন্যাশনাল শুট করেছি, কিন্তু ওই কাজটার মতো প্রশান্তি পাইনি। আসলে প্রীত রেজা হওয়ার পেছনে সবগুলো গল্পই ছিল। কিছু গল্প ছিল কষ্টের আর কিছু গল্প ছিল আনন্দের। সবকিছু মিলিয়ে অনেক কিছুর সম্মুখীন হয়েছি। কিন্তু প্রথম ভাললাগার শুট এখনও সেই ব্যাংককের কাজটা। এ পর্যন্ত পঞ্চাশটি ওয়েডিং করেছি দেশের বাইরে। ডিপ্রজন্ম : তরুণ ফটোগ্রাফার যারা প্রীত রেজাকে অনুকরণ করে, তাদের জন্য পরামর্শ- প্রীত রেজা : তরুণ আলোকচিত্রদের উদ্দেশ্য করে একটা কথাই বলব, ‘সবার আগে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়াটা করতে হবে। ট্রেন্ডের উপর ভিত্তি করে ফটোগ্রাফিকে বেছে নেয়া ঠিক না। এই পেশা তে কতটুকু সফলতা আছে তা বুঝতে হবে। পরিবার-পরিজনদের নিজের ইচ্ছাগুলো ভালভাবে বোঝাতে হবে। ফটোগ্রাফির পেছনের গল্পগুলো জেনে আগানো উচিত। একদিনে সফলতা আসবে না। মানুষ কি বলল? তা চিন্তা না করে নিজের ইচ্ছাটাকে প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে চলতে হবে। ডিপ্রজন্ম : বাংলাদেশের তরুণদের উদ্দেশে কিছু বলুন- প্রীত রেজা : তরুণদের উদ্দেশ করে একটা কথাই বলব, ‘উফ ট্রাফিক, অসহ্য ভিড় এ শহরে থাকব না’ এসব কিছু বলার আগে তাদের জন্য একটা প্রশ্ন যে, ‘তুমি কি করেছো’ দেশটার জন্য। আমি সবাইকে একটা কথা বলি যে নিজের জন্য হলেও মানুষকে সাহায্য কর। আমি আপনি একা দেশ পরিবর্তন করতে পারব না। ছোট ছোট পরিবর্তনেও অনেক কিছু করা সম্ভব। দেশটাকে ভাল বাসতে হবে।স্বপ্ন দেখতে তো ভ্যাট লাগে না। বড় স্বপ্ন দেখ। স্বপ্ন পূরণ এর জন্য নিদারুণ পরিশ্রম করতে হবে। ডিপ্রজন্ম : ধন্যবাদ প্রীত রেজা প্রীত রেজা : ধন্যবাদ আপনাকেও।
×