ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মূল : নোয়াম চমস্কি;###;অনুবাদ : এনামুল হক

ট্রাম্প কি করে বসবেন কিছুই বলা যায় না

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ১৮ জুলাই ২০১৭

ট্রাম্প কি করে বসবেন কিছুই বলা যায় না

ট্রাম্প, তার প্রশাসন ও পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি নিয়ে এ যুগের অন্যতম চিন্তাবিদ নোয়াম চমস্কি কিছু মন্তব্য করেছেন এক সাক্ষাতকারে। সাক্ষাতকারটি নিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক জর্জ এয়ান্সি। সাক্ষাতকারটি নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গত কয়েক মাসে ট্রাম্প প্রশাসনের আবির্ভাবের গোলমেলে সম্ভাবনা এক গোলমেলে বাস্তবতায় পরিণত হওয়ায় আমি নোয়াম চমস্কির সঙ্গে যোগাযোগ করার সিদ্ধান্ত নেই। গত পঞ্চাশ বছর ধরে এই দার্শনিকের লেখা, কথাবার্তা ও ক্রিয়াকলাপের মধ্য দিয়ে আমেরিকান ও বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থার নজিরবিহীন অন্তর্নিহিত চিত্র এবং চ্যালেঞ্জসমূহ বেরিয়ে এসেছে। আমাদের কথোপকথন যা এখানে পরিবেশিত হয়েছে আসলে তা গত দু’মাস ধরে বেশকিছু ই-মেইল বিনিময়ের আকারে অনুষ্ঠিত হয়। অধ্যাপক চমস্কি অতিমাত্রায় ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও আমাদের অতীত বুদ্ধিবৃত্তিক বিনিময়ের কারণে তিনি অতি সহৃদয়তার সঙ্গে এই সাক্ষাতকারের জন্য সময় দিয়েছেন। অধ্যাপক চমস্কি বেশকিছু বেস্ট সেলার রাজনৈতিক গ্রন্থের রচয়িতা যেগুলো অসংখ্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার অতি সাম্প্রতিক গ্রন্থাবলীর মধ্যে রয়েছে ‘হেগিমনি অর সারভাইভাল’, ‘ফেইলড্ স্টেটস্’, ‘হোপস্ এ্যান্ড প্রসপেক্টস’, ‘মাস্টার্স অব ম্যানকাইন্ড’ এবং ‘হু রুলস্ দ্য ওয়ার্ল্ড?’ ১৯৭৬ সাল থেকে তিনি ম্যাসাচুসেটস্ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে এমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে রয়েছেন। জর্জ ইয়ান্সি : আমাদের সত্য-উত্তর (অর্থাৎ যে পরিস্থিতিতে মানুষের বাস্তব সত্য নির্ভর যুক্তির চাইতে আবেগ ও বিশ্বাস নির্ভর যুক্তিকে মেনে নেয়ার প্রবণতা বেশি থাকে- অনুঃ) রাজনৈতিক সময় এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শাসনামলে যে ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচার আমরা প্রত্যক্ষ করছি তার প্রেক্ষাপটে এই পরিস্থিতি গুরুত্বের সঙ্গে মোকাবেলায় পেশাদার দর্শন কোন জনস্বার্থমূলক ভূমিকা পালন করতে পারে বলে আপনি মনে করেন? নোয়াম চমস্কি : আমাদের একটু সতর্ক থাকতে হবে যে আমরা যেন মশা মারতে এটম বোমা ব্যবহারের চেষ্টা না করি। ‘সত্য-উত্তর’ মুহূর্তের কার্যকলাপগুলো এতই চরম আকারের উদ্ভট যে এর সর্বোত্তম উপযুক্ত জবাব হতে পারে বিদ্রƒপ। যেমন স্টিফেন কোলবার্টের সাম্প্রতিক মন্তব্য এ ব্যাপারে প্রাসঙ্গিক হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। একটি বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পূর্বাভাষ দেয়া হলে তার জবাবে রিপাবলিকান প্রধান নর্থ ক্যারোলিনার আইনসভায় এই সমস্যা মোকাবেলায় রাজ্য ও স্থানীয় সংস্থাগুলোকে বিধি বা পরিকল্পনা দলিল প্রণয়ন করতে নিষেধ করে। কোলবার্ট তখন মন্তব্য করেছিলেন, ‘এ এক দারুণ সমাধান। বিজ্ঞান যদি এমন কোন ফল বয়ে আনে যা আপনার পছন্দ নয় তা হলে আইন পাস করে বলুন গবেষণার এই ফলটা বেআইনী। ব্যস, সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।’ মোটামুটি এভাইে ট্রাম্প প্রশাসন সংগঠিত মানবজীবনের অস্তিত্বের প্রতি সত্যিকারের হুমকি মোকাবেলা করছেন : পরিবেশের প্রতি হুমকি মোকাবেলার আইনবিধি এমনকি তা নিয়ে গবেষণা ও আলোচনা নিষিদ্ধ কর এবং যত দ্রুত সম্ভব খাড়া পাহাড়ের চূড়ার দিকে ধাবিত হও (স্বল্পমেয়াদী মুনাফা ও ক্ষমতার স্বার্থে) জর্জ ইয়ান্সি : এ ব্যাপারে ট্রাম্পবাদকে আমি কতকটা আত্মঘাতী দেখতে পাচ্ছি। নোয়াম চমস্কি : অবশ্যই এ ব্যাপারে বিদ্রƒপ করাটাই যথেষ্ট নয়, যারা জালিয়াতির দ্বারা প্রভাবিত হয় কিংবা যারা অন্যান্য কারণে সমস্যাগুলোর প্রকৃতি ও তাৎপর্য স্বীকার করে না তাদের ভাবনা ও বিশ্বাসগুলোর জবাব দেয়া দরকার। দর্শন বলতে আমরা যদি যুক্তিবাদী ও চিন্তাপ্রসূত বিশ্লেষণ বুঝে থাকি তাহলে তা এ মুহূর্তের সমস্যাবলীর সমাধান দিতে পারে। তবে তা বিকল্প তথ্যাবলীর মোকাবেলা করে নয় বরং সমস্যা যেটাই হোক না কেন সেই সমস্যা বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করে। এর বাইরে যেটা প্রয়োজন তা হলো এ্যাকশন বা কর্ম : জরুরী ও নিবেদিতপ্রাণ এবং যেগুলো এমন অনেক উপায়ে যেগুলো আমাদের কাছে উন্মুক্ত। জর্জ ইয়ান্সি : পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেখানে আমি বিশ্বেষণধর্মী ধারায় প্রশিক্ষিত হয়েছিলাম, যেখানে দর্শনের আন্ডার গ্রাজুয়েট থাকাকালে ধারণা বা কল্পিত বিষয়গুলোর ব্যাখ্যার বাইরে দর্শন বলতে কি বোঝায় আমার কাছে পরিষ্কার ছিল না। তথাপি মার্ক্সের এই ব্যাখ্যায় আমি বিশ্বাস করতাম যে দর্শন বিশ্বজগতকে পাল্টে দিতে পারে। বিশ্বকে বদলে দিতে দর্শনের এই ক্ষমতা সম্পর্কে আপনার কি কোন ভাবনা আছে? নোয়াম চমস্কি : ‘দার্শনিকরা এযাবত নানাভাবে বিশ্বজগতের ব্যাখ্যাই শুধু দিয়েছেন; প্রশ্নটা হলো একে বদলে দেয়া’ কথাগুলো লেখার সময় মার্ক্স মনে মনে কি ভেবেছিলেন সে ব্যাপারে আমি ঠিক নিশ্চিত নই। তিনি কি বলতে চেয়েছিলেন যে, দর্শন বিশ্বকে বদলে দিতে পারে, কিংবা দার্শনিকদের উচিত বিশ্বকে বদলে দেয়ার অধিকতর অগ্রাধিকারমূলক বিষয়ের দিকে ঝুঁকে পড়া? যদি আগেরটা হয়ে থাকে তাহলে সম্ভবত তিনি দর্শন শব্দটাকে ব্যাপক অর্থে বোঝাতে চেয়েছেন যার মধ্যে আছে সমাজ ব্যবস্থার বিশ্লেষণ এবং কেন ও কিভাবে সেই ব্যবস্থার পরিবর্তন করা উচিত সেই সংক্রান্ত, ধ্যান-ধারণা। এই ব্যাপক অর্থে দুনিয়াকে বদলে দেয়ার ক্ষেত্রে দর্শন একটা ভূমিকা পালন করতে পারে, বস্তুতপক্ষে একটা অপরিহার্য ভূমিকা পালন করতে পারে। আর বিশ্লেষণধর্মী ধারার দার্শনিকরাসহ দার্শনিকবৃন্দ তাদের দার্শনিক রচনাবলী ও বাস্তব কর্মময় জীবনে সেই প্রচেষ্টাই চালিয়েছেন। খ্যাতিমান একজনের দৃষ্টান্ত দিতে গেলে বার্টান্ড রাসেলের কথা উল্লেখ করতে হয়। জর্জ ইয়ান্সি : হ্যাঁ, রাসেল একজন দার্শনিক ছিলেন এবং চলমান ঘটনাবলীর ওপর মন্তব্য বা বক্তব্য দিতে আগ্রহের জন্য সাধারণ মানুষের কাছে সুপরিচিত একজন বুদ্ধিজীবী ছিলেন, সেই অর্থে নিজেকে আপনি কিভাবে বর্ণনা করবেন? নোয়াম চমস্কি : সত্যি বলতে কি আমি আসলে এ নিয়ে একদম ভাবি না। আমি সেই ধরনের লেখালেখি ও ক্রিয়াকলাপে যুক্ত যা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জিং বলে মনে হয়। এর কিছু কিছু ওইসব শ্রেণীর মধ্যে পড়ে যেমনটি সচরাচর ধারণা করা হয়। জর্জ ইয়ান্সি : কিছু কিছু সময় আছে যখন মানুষের দুঃখ-কষ্ট দুর্ভোগের স্রেফ বিশালত্বটাই অসহনীয় বলে মনে হয়। বিশ্বে দুঃখ-কষ্ট ও যন্ত্রণার কথা এত বেশি বলে থাকেন এমন একজন মানুষ হিসেবে এসবের প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার যন্ত্রণা কিভাবে আপনি সহ্য করেন অথচ তার পরও সামনে এগিয়ে চলার শক্তি বজায় রাখেন? নোয়াম চমস্কি : সামনে এগিয়ে চলার প্রেরণা যোগানোর জন্য চোখে দেখাটাই যথেষ্ট নয়। আর আমাদের পরিবেশের সঙ্গে তুলনাও করা যায় না এমন অতি শোচনীয় অবস্থায় থাকা গরিব ও দুর্গত মানুষেরা কিভাবে নীরবে এবং নিরহঙ্কারের সঙ্গে ন্যায়বিচার ও মর্যাদার জন্য সাহসিকতাপূর্ণ এবং অঙ্গীকারাবদ্ধ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে তা দেখতে পাওয়ার চাইতে প্রেরণাদায়ক আর কিছুই হতে পারে না। জর্জ ইয়ান্সি : আপনাকে যদি এমন দুই বা তিন ধরনের রাজনৈতিক কর্মধারার কথা উল্লেখ করতে হয় যেগুলো ট্রাম্পের শাসনামলে প্রয়োজন তাহলে সেগুলো কি কি হতে পারে? আমি জিজ্ঞেস করছি এই কারণে যে আমাদের এই সময়টা অবিশ্বাস্য রকমের নৈরাশ্যজনক ও নিপীড়নমূলক বলে মনে হচ্ছে। নোয়াম চমস্কি : আমার মনে হয় না পরিস্থিতি এতটা নিরানন্দ। বার্নি স্যান্ডার্সের প্রচারাভিযানের সাফল্যের কথাই ধরুন। ওটাই ছিল ২০১৬ সালের নির্বাচনের সবচেয়ে লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। আর যাই হোক ব্যাপারটা মোটেই বিস্ময়কর নয় যেÑ একজন বিলিয়নিয়ার শোম্যান যার প্রতি উদারপন্থী মিডিয়াসহ প্রচারমাধ্যমের ব্যাপক সমর্থন আছে তিনি উগ্র প্রতিক্রিয়াশীল রিপাবলিকান পার্টির মনোনয়ন পেয়েছিলেন। স্যান্ডার্সের প্রচারাভিযান অবশ্য ছিল এক শতাব্দীর বেশি মার্কিন রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে এক নাটকীয় ছেদ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ব্যাপক গবেষণা বিশেষ করে টমাস ফার্গুসনের গবেষণায় বিশ্বাসযোগ্যভাবে দেখানো হয়েছে যে নির্বাচনগুলো অনেকটাই কিনে নেয়ার বিষয়। দৃষ্টান্ত দিয়ে বলা যায়, নির্বাচনী প্রচারে কত অর্থ ব্যয় করা শুধু তা থেকেই নির্বাচনী সাফল্য লক্ষণীয় রকমের উত্তম পূর্বাভাস মিলতে পারে এবং কর্পোরেট শক্তির সমর্থন ও ব্যক্তিগত সম্পদ রাজনৈতিক অঙ্গনে অংশ নেয়ারও কার্যত একটা পূর্বশর্ত। স্যান্ডার্সের প্রচারাভিযানে দেখা গেছে, সামান্য মাত্রায় প্রগতিশীল কর্মসূচী (মূলত নিউ ডিল) আছে এমন একজন প্রার্থী মনোনয়ন লাভ করতে এমনকি নির্বাচনে জিততেও পারেন। এমনকি বড় ধরনের অর্থ যোগানদাতা বা মিডিয়ার কোন রকম সমর্থন ছাড়াও জিততে পারেন। এমন মনে করার সঙ্গত কারণ আছে যে ওবামা-ক্লিনটন পার্টি ম্যানেজারদের হীন অপকৌশল না থাকলে স্যান্ডার্স দলীয় মনোনয়ন লাভ করতেন। বিশাল ব্যবধানে স্যান্ডার্স এখন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। নির্বাচনী প্রচার থেকে যে সক্রিয়তার জন্ম তা এখন নির্বাচনী রাজনীতিতে ঢুকে পড়তে শুরু করেছে। বারাক ওবামার শাসনামলে ডেমোক্র্যাটিক পার্টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় ও রাজ্য পর্যায়ে অনেকটাই ধসে পড়েছিল। তবে এটাকে পুনর্গঠিত করে একটা প্রগতিশীল শক্তিতে পরিণত করা যেতে পারে। তা করতে হলে নিউ ডিলের সময়কার পরিবেশ পরিস্থিতি পুনরুজীবিত করতে হবে এবং সেটাকেও ছাড়িয়ে গিয়ে শ্রমিক শ্রেণীকে পরিত্যাগ করার পরিবর্তে তাদের পুনর্গঠিত করে ক্লিনটনপন্থী নব্য ডেমোক্র্যাটে পরিণত করতে হবে। এই নব্য ডেমোক্র্যাটরা যাদের মডারেট রিপাবলিকান বলা হতো মোটামুটিভাবে তাদেরই মতো। দুটো দলই নব্য উদার রাজনীতির অধ্যায়ে দক্ষিণ দিকে ঝুঁকে পড়ায় এই শ্রেণীর লোকেরা বহুলাংশেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। এই সম্ভাবনাগুলো হয়তবা নাগালের বাইরে নয়। এগুলো অর্জন করার প্রচেষ্টা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে এই মুহূর্ত থেকে প্রত্যক্ষ সক্রিয়তা যুক্ত করা যেতে পারে। রিপাবলিকান প্রশাসনের আইনগত ও নির্বাহী পদক্ষেপগুলো মোকাবেলা করার জন্য এটা জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজন। ট্রাম্পের ক্ষুদে আমেরিকা গঠনের প্রকল্পটিকে মোকাবেলা করার বস্তুতপক্ষে অনেক উপায় আছে। তার সেই ক্ষুদে আমেরিকা হবে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন, চার দেয়ালের মধ্যে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে থাকবে এবং রিপাবলিকান এস্টাবলিশমেন্টের সবচেয়ে বর্বর অংশের প্রতিনিধিত্বকারী পলরায়ান স্টাইলের অভ্যন্তরীণ নীতি অনুসরণ করে চলবে। জর্জ ইয়ান্সি : আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় ইস্যু কি কি? নোয়াম চমস্কি : মোকাবেলা করার মতো সবচেয়ে বড় ইস্যুগুলো হচ্ছে আমাদের অস্তিত্বের প্রতি সত্যিকারের যে সব হুমকি রয়েছে সেগুলো : যেমন জলবায়ু পরিবর্তন ও পারমাণবিক হুমকি। প্রথমটির ক্ষেত্রে বিশ্ব থেকে চমৎকারভাবে বিচ্ছিন্ন রিপাবলিকান নেতৃত্ব আমাদের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার সম্ভাবনাগুলো নস্যাত করে দিকে প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে উৎসর্গীকৃত। কথাগুলো কঠিন তবে অতিরঞ্জন নেই। তাদের এই হীনপরিকল্পনা মোকাবেলা রকার জন্য স্থানীয় ও রাজ্য পর্যায়ে করতে পারার মতো অনেক কিছুই আছে। পারমাণবিক যুদ্ধ প্রসঙ্গে বলতে হয় যে সিরিয়ায় এবং রুশ সীমান্তে যেসব কর্মকা- চলছে তা থেকে এমন সংঘাতের অতি গুরুতর হুমকি সৃষ্টি হচ্ছে যা যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটাতে পারে। এই সম্ভাবনার কথা চিন্তাই করা যায় না। তদপুরি ট্রাম্প পারমাণবিক শক্তি আধুনিকায়নের ওবামা কর্মসূচী যেভাবে অনুসরণ করছেন সেটাও মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি আমরা জানতে পেরেছি যে আমাদের অস্তিত্ব যে সুরু সুতার ওপর ঝুলছে মার্কিন পারমাণবিক শক্তির আধুনিকায়নের ফলে তা আশঙ্কাজনকভাবে ক্ষয়ে যাচ্ছে। গত মার্চ মাসে ‘বুলেটিন অব দ্য এটমিক সায়েন্টিস্টস’-এ প্রকাশিত অতি গুরুত্বপূর্ণ এক নিবন্ধে এ বিষয়ে সবিস্তারে আলোচনা করা হয়েছে। বিষয়টি প্রথম পৃষ্ঠার সংবাদ হিসেবে পরিবেশিত হওয়া ও থাকা উচিত ছিল। নিবন্ধের লেখকরা অতি শ্রদ্ধাভাজন বিশ্লেষক। তারা লক্ষ্য করেছেন যে পারমাণবিক অস্ত্রের আধুনিকায়ন কর্মসূচীর ফলে ‘যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর সার্বিক প্রাণসংহার ক্ষমতা মোটামুটিভাবে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে যে অবস্থাটা প্রত্যাশা করা যায় ঠিক সেটাই সৃষ্টি হয়েছে। তাহলে পারমাণবিক অস্ত্রধারী কোন রাষ্ট্র যদি পারমাণবিক যুদ্ধ। লড়বার ক্ষমতা অর্জন করতে এবং সে যুদ্ধে জয়লাভ করতে চায় তাহলে অতর্কিত প্রথম আঘাত হেনে শত্রুদের নিরস্ত্র করে দিয়ে তা করতে পারে।’ এর তাৎপর্যটা পরিষ্কার। এর অর্থ দাঁড়ায় এই যে সঙ্কটের মুহূর্তে এবং সে ধরনের সঙ্কট অনেকই আছে, রুশ সমর পরিকল্পকরা এই উপসংহারে পৌঁছতে পারেন যে নিবর্তনমূলক শক্তি না থাকার কারণে অস্তিত্ব রক্ষার একমাত্র উপায় হলো প্রথমে আঘাত হানা এবং তার মানেই আমাদের সবার শেষ হয়ে যাওয়া। জর্জ ইয়ান্সি : সবার জন্যই আতঙ্কজনক? নোয়াম চমস্কি : এসব ক্ষেত্রে নাগরিক আন্দোলন অতি বিপজ্জনক কর্মসূচীগুলো পাল্টে দিতে পারে। সেই আন্দোলনের চাপের মুখেও ওয়াশিংটন, উত্তর কোরিয়া ও ইরানসহ অন্যান্য এলাকায় পাল্টা শক্তি প্রয়োগ এবং জবরদস্তির আশ্রয় নেয়ার পরিবর্তে কূটনৈতিক পদক্ষেপ যেগুলো আছে সেগুলোর সন্ধান করে দেখতে পারে। জর্জ ইয়ান্সি : কিন্তু নোয়াম, আপনি যে নানা ধরনের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে নিরন্তর সমালোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন আপনার এই সামাজিক ন্যায়বিচারবোধের পেছনে কোন্টি প্রেরণা হিসেবে কাজ করছে? আপনার সামাজিক ন্যায় বিচারমূলক ক্রিয়াকলাপের পেছনে ধর্মীয় কোন প্রেরণা কি রয়েছে? না থাকলে কেন নেই? নোয়াম চমস্কি : কোন ধর্মীয় প্রেরণা নেই এবং সঙ্গত কারণেই নেই। একজন তার যে কোন ধরনের ক্রিয়াকলাপের জন্য সর্বোচ্চ আদর্শের প্রতি অঙ্গীকার থেকে শুরু করে অতি ভয়াবহ ধরনের নিষ্ঠুরতার প্রতি সমর্থনের পেছনে ধর্মীয় প্রেরণা খুঁজে পেতে পারে। ধর্মীয় গ্রন্থাবলীতে আমরা শান্তি, ন্যায়বিচার ও ক্ষমার উদাত্ত আহ্বান দেখতে পাই। সাহিত্য গ্রন্থাবলীতেও অতি ভয়াবহ গণহত্যার বিবরণ থাকে। আমরা একে মোড়কে ঢেকে রাখার জন্য যত রকমের ছলচাতুিররই আশ্রয় নেই না কেন, বিবেকই হলো আমাদের পথের দিশা হিসেবে কাজ করবে। জর্জ ইয়ান্সি : এত দুঃখ-দুর্দশা-দুর্ভোগ প্রত্যক্ষ করার প্রসঙ্গে ফিরে এসে একটা প্রশ্ন করি। আমার আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ছাত্রদের অনেকের সঙ্গে আমি কোন্টি শেয়ার করব বলে আপনি সুপারিশ করে যাতে করে আমাদের দেখা দুঃখ-দুর্দশার চেয়েও শোচনীয় ধরনের দুঃখ-দুর্দশা-যন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করে তা সইতে পারার মতো ক্ষমতা ও সামর্থ্য তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে? আমার অনেক ছাত্র কেবল স্নাতক হওয়ার ভাবনা নিয়েই ভাবিত থাকে এবং প্রায়শই তারা বিশ্বের মানুষের দুঃখ-দুর্দশা-যন্ত্রণার কথা বিস্মৃত হয়ে যায়। নোয়াম চমস্কি : আমার সন্দেহ, যারা কাছের হোক আর দূর প্রান্তেরই হোক অন্য মানুষদের দুঃখ-দুর্দশা-যন্ত্রণা সম্পর্কে বিস্মৃত থাকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সে ব্যাপারটা তাদের জানা থাকে না এবং সম্ভবত মতবাদ ও আদর্শের দ্বারা তারা অন্ধ হয়ে যায়। তাদের জন্য আমার জবাবটা হচ্ছে বিশ্বাস, ধর্মনিরপেক্ষতা বা ধর্ম সম্পর্কিত নিবন্ধগুলোর প্রতি সমালোচনাধর্মী মনোভাব গড়ে তোলা; তাদের প্রশ্ন করার, অনুসন্ধান করার এবং অন্যদের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বকে দেখার ক্ষমতাকে উৎসাহিত করা। আর আমরা যেখানেই বাস করি না কেন দুঃখ-দুর্দশার প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসার সুযোগটা কখনই খুব বেশি দূরে নয়। হয়ত দেখা যাবে গৃহহীন মানুষ প্রচ- ঠা-ার মধ্যে গাদাগাদিভাবে পথ চলেছে কিংবা খাবারের জন্য গুটিকয়েক পয়সা চাইছে অথবা হয়ত এর চেয়ে আরও বেশি কিছু দৃশ্য দেখা যাবে। জর্জ ইয়ান্সি : অন্যের দুঃখ-কষ্টের সংস্পর্শে আসার সুযোটা যে খুব বেশি দূরে নয় আপনার এই বক্তব্য আমি উপলব্ধি করি এবং সমর্থনও করি। আবার ট্রাম্পের প্রসঙ্গে ফিরে এসে আমি বলতে চাই যে আপনি তাকে এমন এক ব্যক্তি হিসেবে দেখেন যিনি কি করবেন না করবেন আগে থেকে সে সম্পর্কে একেবারে কিছুই বলতে পারা যায় না। আমিও অবশ্যই তাই মনে করি। আমাদের সময়কার অধ্যায়ে যে কোন ধরনের পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা কি আমাদের করা উচিত? নোয়াম চমস্কি : আমি করি এবং একমাত্র আমিই যে এমন আশঙ্কা করি মোটেও তা নয়। এমন আশঙ্কা ব্যক্তকারী সবচেয়ে বিশিষ্ট ব্যক্তিটি হলেন উইলিয়াম পেরি। সমকালীন বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় পারমাণবিক স্ট্র্যাটেজিস্ট যার সর্বোচ্চ পর্যায়ে যুদ্ধ পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত থাকার বেশ কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা আছে। তিনি সহজে কোন মন্তব্য করেন না এবং মন্তব্যের ব্যাপারে বেশ সতর্ক। অতিরঞ্জন কোন বক্তব্য তো দূরের কথা। প্রায়-অবসর অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে তিনি জোরালোভাবে এবং বারংবার ঘোষণা করেছেন যে চরম ও ক্রমবর্ধমান হুমকিতে এবং সেই হুমকির ব্যাপারে কাউকে উদ্বিগ্নবোধ করতে না দেখে তিনি আতঙ্কিত বোধ করছেন। তার ভাষায় ‘স্নায়ুযুদ্ধের সময় পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা যতটা ছিল আজ যে কোন ধরনের পারমাণবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা তার চাইতেও বেশি এবং অধিকাংশ লোক এই বিপদ সম্পর্কে অনবগত থেকে পরম সুখে আছে।’ ১৯৪৭ সালে ‘বুলেটিন অব দ্য এটমিক সায়েন্টিস্টস’ তার বিখ্যাত ‘ডুমসডে ক্লক’ অর্থাৎ মহাপ্রলয়ের ঘড়ি স্থাপন করেছিল এবং হিসাব করে দেখিয়েছিল যে মধ্যরাত বা শেষ সময় থেকে আমরা কত দূরে আছি। ১৯৪৭ সালে বিশ্লেষকরা সেই সময়টা নির্ধারণ করেছিলেন যে মধ্যরাত হতে আর ৭ মিনিট বাকি। ১৯৫৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন হাইড্রোজেন বোমা ফাটানোর পর তারা সময়টা এগিয়ে এনে দেখান যে মধ্যরাতের ঘণ্টাধ্বনি হতে আর দুই মিনিট বাকি। তারপর থেকে এই সময়টা ওঠানামা করেছে, কিন্তু আর কখনই এই বিপজ্জনক বিন্দুতে পৌঁছায়নি। গত জানুয়ারিতে ট্রাম্পের অভিষেকের অল্প পরেই সময়টা এগিয়ে এনে দেখান হয় যে মধ্যরাত হতে আড়াই মিনিট বাকি। ১৯৫৩ সালের পর চূড়ান্ত ধ্বংসের এটাই হলো সবচেয়ে কাছাকাছি সময়। এ সময়ের মধ্যে বিশ্লেষকরা পারমাণবিক যুদ্ধের ক্রমবর্ধমান হুমকিই শুধু বিবেচনায় নেননি, পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটানোর প্রতিযোগিতা ত্বরান্বিত করতে রিপাবলিকান সংগঠনের দৃঢ় নিষ্ঠার কথাও বিবেচনায় নিয়েছেন। পেরি সঙ্গত কারণেই আতঙ্কিতবোধ করেছেন। আমাদের সকলেরও আতঙ্কিত বোধ করা উচিত এবং সেটা বন্দুকের ঘোড়ায় আঙ্গুল দিয়ে রাখা ব্যক্তিটি ও তার পরাবাস্তববাদী সহযোগীদের কারণেই যে শুধু তা নয়। জর্জ ইয়ান্সি : তারপরও তিনি কি করে বসেন সে ব্যাপারে আগে থেকে কিছুই বলতে পারা সম্ভব না হলেও ট্রাম্পের রয়েছে একটি শক্তিশালী ভিত্তি। এই ধরনের ক্রীতদাসতুল্য বশ্যতা কি কারণে হয়েছে? নোয়াম চমস্কি : ‘ক্রীতদাসতুল্য বশ্যতা’ সঠিক শব্দ প্রয়োগ হলো কি না সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই বেশকিছু কারণে। যেমন ধরুন, এই যে ভিত্তির কথা বলা হলো এরা কারা? বেশিরভাগ সমর্থক অপেক্ষাকৃত বিত্তবান, তাদের তিন-চতুর্থাংশের আয় ছিল মাঝারি মাত্রার আয়ের ওপরে। প্রায় এক-তৃতীয়াংশের আয় ছিল বছরে এক লাখ ডলারের বেশি এবং এই কারণে ব্যক্তিগত আয়ের দিক দিয়ে তারা ছিল শীর্ষ ১৫ শতাংশের মধ্যে। এদের মধ্যে শীর্ষ ৬ শতাংশের ছিল শুধু হাই স্কুল শিক্ষা। এদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গ। বেশিরভাগই বয়ষ্ক। সেই কারণে ইতিহাসগতভাবে অধিক সুবিধাভোগী অংশ। সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস
×